ছোটবেলাকার কথা যদি বলতেই হয় তাহলে আচার-দিদার কথা বাদ দিলে চলবে না। আচার-দিদা নামটা থেকেই বুঝতে পারছ, যাঁকে নিয়ে এই লেখা তিনি যথেষ্ট বয়স্কা এবং আচার তৈরিতে বিশেষ পারদর্শী। ঠিক তাই। এই দিদা থাকতেন আমার মামার বাড়ির একদম পাশেই। আমার দিদিমার সাথে তাঁর খুবই হৃদ্যতা ছিল। প্রতিদিন বিকেলবেলা আমার দিদিমা চায়ের কাপ নিয়ে যে সকল প্রতিবেশিনী বান্ধবীদের সাথে ঘন্টাখানেক সময় কাটাতেন, তাঁদের মধ্যে আচার-দিদা ছিলেন অন্যতম।
আমি যাঁকে নিয়ে গল্প লিখতে চলেছি তাঁকে আচার-দিদা নামকরণ না করে নাড়ু-দিদা বললেও ভুল হ'ত না। কিন্তু আচার-দিদা নামকরণটা বেশি ঠিক হবে বলেই আমার মনে হয়েছে, তাই এই গল্পের মুখ্য চরিত্র অনুযায়ী এর নামকরণ 'আচার-দিদা' দেওয়াটা সমীচীন বলে মনে হ'ল।
আমার স্কুলে গরমের বা পূজোর ছুটি পড়লে কিংবা অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেলে মায়ের সাথে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে যেতাম। বাবা আমাদের ওখানে রেখে পরের দিনই কলকাতায় ফিরে আসত। ছুটি শেষ হলে আবার গিয়ে নিয়ে আসত। আর ততদিন আমার অবাধ স্বাধীনতা। "মামার বাড়ি ভারী মজা, কিল-চড় নাই।"
আচার-দিদার কথা উঠলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লম্বা দিঘির পাড়ে টালির চাল ছাওয়া ইঁটের দেওয়ালের কয়েকটি ঘর গাছের ডালের বেড়া দিয়ে ঘেরা। চারিপাশে বড় বড় আম, কাঁঠাল, নারকেল গাছের ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশ আর মাটির নিকোন দাওয়া ও উঠান। একটা বাঁশের আগল ঠেলে উঠানে ঢুকে হাঁক পাড়তাম, "ও দিদা, কোথায় গেলে গো?"
আমার গলা শুনলেই দিদা যেখানেই থাকুক না কেন একগাল হাসি নিয়ে বেড়িয়ে এসে বলত, "ওমা, রত্না, কবে এলি রে?"
দিদা থান কাপড় পড়তেন আর হাসলেই সামনের দুটি বড় দাঁত বেরিয়ে পড়ত ।
-এই আজই এলাম গো। তুমি ভালো আছ দিদা?
-হ্যাঁ রে। ভালো আছি। বোস, দাওয়াতে বোস।
বলেই আবার ঢুকে যেত ভিতরে। কয়েক মিনিট বাদেই হাতে করে চিনামাটির একটা প্লেটে গোটা কয় নারকেল নাড়ু আর এক গ্লাস জল নিয়ে বেড়িয়ে আসত । বলতেন, "খা।"
দিদার সেই নারকেল নাড়ু খেতে গেলে অদ্ভুত সুন্দর স্বাদ ও গন্ধ পেতাম। আমার মনে হ'ত নাড়ু গুলো নারকেল বাটা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। আর কী ঠান্ডা! ঠিক যেন ফ্রিজ থেকে বের করে এনেছে। অথচ তখনকার দিনে রেফ্রিজারেটর মধ্যবিত্তের আয়ত্তের বাইরে ছিল। দিদার বাড়িতেও ছিল না।
আচার-দিদা দুপুর বেলা চুপি চুপি আমার দিদিমাকে ঢাকা দেওয়া বাটি করে কী যেন দিয়ে যেত। ভাত খেতে বসে নানা রকম সুখাদ্যের সঙ্গে পেতাম তিন-চার রকমের আচার।
আমের মিষ্টি আচার, কুলের টক ঝাল আচার, লেবুর টক টক আচার, আবার কুলের নাড়ু। এই কুলের নাড়ু আমার বিশেষ প্রিয় ছিল। পাকা কুলকে শুকিয়ে হামানদিস্তায় গুঁড়িয়ে তাকে গুড় ও বাটা চিনির বিশেষ পাকে তৈরি করা হ'ত সেই কুলের নাড়ু এবং সবচেয়ে আশ্চর্য হ'তাম যখন সেই নাড়ু খেতে খেতে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে একটা আস্ত কুলের বীজ।
আমার দিদিমাও রান্নায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আমি বরাবরই দিদিমার তৈরি আম, কুল ও লেবুর আচারের ভক্ত ছিলাম। তার সাথে আচার-দিদার হাতের চালতার আচার, কুলের নাড়ু, লাল লাল ঝুরো কুলের রসালো আচার, তেঁতুলের আচার ইত্যাদি নানা ধরনের জিভে জল আনা বৈচিত্র্যময় আচারের সম্ভার ছেড়ে কলকাতা ফেরা আমার পক্ষে খুবই কষ্টকর ছিল। তাই যতদিন পর্যন্ত সম্ভব আচার খাওয়ার স্বর্গসুখ থেকে বঞ্চিত হতে চাইতাম না। উপরি পাওনা হিসেবে মাঝে মধ্যে আচার-দিদার বাড়িতে তৈরি আমস্বত্ত্বের টুকরো পেলে নিজেকে আরো ভাগ্যবান বলে মনে হ'ত।
কলকাতা থেকে পোস্টকার্ডে বাবার চিঠি এলে বুঝতাম এবারে আমাদের গোছগাছ করতে হবে। মা বাজার থেকে নানা রকম জিনিস আনাত - সোনামুগের ডাল, বড়ি, পাঁপড় ইত্যাদি । সেসব নাকি কলকাতায় মেলা ভার। দিদিমা দিতেন শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি, সরভাজা, সরপুরিয়া, আম ও কুলের আচার ইত্যাদি।
বাড়ি ফেরার নির্দিষ্ট দিনে সকাল বেলায় আচার-দিদা কাঁচের শিশি ভর্তি কুলের নাড়ু দিয়ে যেত। আমার লক্ষ্য থাকত কখন মায়ের নজর এড়িয়ে সেই নাড়ু গোটা কয়েক আমার উদরস্থ হবে!
আচার-দিদার বাড়ির সামনে দিয়ে স্টেশনের দিকে যাবার সময় দেখতাম দিদা বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে। মা প্রণাম করতে গেলে মায়ের চিবুকে হাত দিয়ে বলত, "থাক মা থাক। আবার আসিস।"
এরপর অনেকদিন কেটে গেছে, আমি ফ্রক ছেড়ে চুড়িদার, শাড়ি পড়তে শুরু করেছি। হঠাৎ শুনি দিদিমা-দাদু কৃষ্ণনগরের মামার বাড়ির পাঠ চুকিয়ে মামার কর্মস্থলে চলে যাবেন। কারণ তাঁদের মত বয়স্ক মানুষদের পক্ষে একা একা থাকা সম্ভব নয়। ছুটি থাকলেই মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দ আর আচার-দিদার আচার দিয়ে রসনাতৃপ্ত করার আনন্দ থেকে চিরতরে বঞ্চিত হ'লাম।
এর বহুদিন পর আমার এক মাসতুতো দাদা দিল্লি থেকে বেড়াতে এসেছিল। আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম একদিন মায়াপুর-নবদ্বীপ ঘুরে আসব। এক রবিবার সকালে আমি আমার কর্তা আর মেয়েকে নিয়ে দাদার সাথে রওনা হয়ে গেলাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। ঠিক করা হল যাওয়ার পথে একবার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়ির বর্তমান হাল-হকিকৎ একবার স্বচক্ষে দেখে আসা যাক।
সেই মত যাওয়া হ'ল সেখানে। নিজের মামার বাড়ির সাথে চারিদিকে কত স্মৃতি। ওই বাড়ির বর্তমান বাসিন্দারা আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। ফেরার পথে আমি সকলকে দাঁড়াতে বলে একবার খোঁজ নিতে গেলাম আচার-দিদার। জায়গাটা চিনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ আশপাশের সব কিছু বদলে গেছে। তবু আন্দাজ করে গিয়ে দেখি গাছপালা ঘেরা টালির চালের বাড়িটা আর নেই। তার পরিবর্তে সেখানে নতুন একতলা একটি বাড়ি হয়েছে। তবে দু'একটা পুরোনো গাছ যেমন নারকেল, কাঁঠাল ইত্যাদি বাড়ির পিছনের দিকে আছে দেখলাম। বারান্দায় এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, "দাদা, এখানে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা থাকতেন, তিনি কোথায় গেছেন বলতে পারেন?"
-কতদিন আগের কথা বলছেন বলুন তো?
-তা প্রায় ত্রিশ বছর আগে?
-তাহলে আমি বলতে পারব না। কারণ আমি বছর ছয়-সাত আগে একজনের কাছ থেকে এই জমিটা কিনেছিলাম।
-ও, তখন এখানে কোন টালির চালের বাড়ি ছিল?
-নাঃ, তবে কিছু বড় বড় গাছপালা ভর্তি একটা জমি ছিল।
আচার-দিদার খোঁজ না পেয়ে দুঃখিত হৃদয়ে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি বাজারের ব্যাগ হাতে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ধীরে ধীরে হেঁটে আসছেন দীঘির পাড়ের রাস্তা ধরে। মাথার চুলগুলো সব সাদা, চামড়া কুঁচকে গেছে। কিন্তু তাঁকে খুব চেনা চেনা লাগছে! কে উনি? নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। আরো কাছে আসতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, "অরূপ মামা!"
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে পড়লেন। চশমাটা খুলে আমার মুখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "কে বলতো?"
আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললাম,
-তোমার ভাগ্নি রত্না গো!
-রত্না? কতদিন পর দেখলাম তোকে! কেমন আছিস মা?
-আমি ভালো আছি মামা । তুমি কেমন আছো?
-আর এই বুড়ো বয়সে থাকা না থাকা! গত বছর দাদা চলে গেছে! তোর মা কেমন আছে? এখানে কোথায় এসেছিস?
ততক্ষণে আমার পিছনে আমার পরিবার এসে গেছে। তাদের সাথে আমাদের একদা অতি নিকট প্রতিবেশী অরূপ মামার আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলাম। অবশ্য আমি ছাড়াও দাদা তাঁর পূর্ব পরিচিত, তাই তার ও মাসির খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিলেন। আমার মায়ের কথাও বললাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচার-দিদার কথা।
অরূপ মামা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, "ও তুই কাকিমার কথা বলছিস? বয়সকালে তাকে দেখার কেউ ছিল না বলে ছেলে এসে কর্মস্থলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে থাকতে পারত না। আবার চলে আসত এখানে। বলত, দূর বাপু, ওখানে ওই ছোট্ট ঘরে কি থাকা যায়? আচার, বড়ি, পাঁপড় রোদে দিতে পারি না। শেষবার যখন এসেছিল তখন বেশ বয়স হয়েছে। শরীরটাও ভালো ছিল না। এখানে একদিন ম্যালেরিয়া হ'ল। ছেলে খবর পেয়ে আসতে আসতেই সব শেষ।"
অরূপ মামার পীড়াপিড়িতে তাঁর বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্য একটু যেতেই হল। এতদিন পরে ভাগ্নে- ভাগ্নি, ভাগ্নি-জামাই আর নাতনীকে পেয়ে মামা কিছুতেই জল-মিষ্টি না খাইয়ে ছাড়বেন না। সেজন্য সময় কমে যাওয়ায় আমাদের আর নবদ্বীপ যাওয়া হল না। তাই ঠিক হল শুধু মায়াপুর থেকেই ঘুরে আসা হবে ।
অরূপ মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই দীঘির পাড় ধরেই ফিরে আসছিলাম আমরা। হঠাৎ পিছন ফিরে সেই নতুন বাড়িটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখি আচার-দিদা দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমন বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকত আমার ছোটবেলায়। চোখটা মুদে আবার তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। তবে কি আমার মনের ভুল? গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল!
আমার কর্তা তাড়া দিল -
-আবার দাঁড়ালে কেন? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো?
-হ্যাঁ, চলো।
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ