আমাদের ঠান্দি খুব সুন্দর আনন্দনাড়ু বানাতে পারেন | ময়দা, তিল, গুড়, চিনি, নারকেল কোৱা এসব মিশিয়ে নাড়ু বানিয়ে কড়াইতে ফুটন্ত সরষের তেলে যখন ভাজতে থাকেন তখন এতো সুন্দর একটা গন্ধ ছাড়ে যে আমরা রান্নাঘরের সামনে ঘুড়ঘুড় না করে পারি না ! ক্রমশ সুগন্ধটা সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ! ছাদ থেকে নতুনদি শুকনো কাপড়চোপড় নিয়ে নামতে নামতে বলে, "দিদি, আজ আনন্দনাড়ু বানাচ্ছ নাকি ?" ঠান্দির কাছে শুনেছি, অনেক বাড়িতে শুধু আনন্দ অনুষ্ঠান হলেই আনন্দনাড়ু বানানো হয় | কিন্তু আমাদের সে নিয়ম নেই | যখন খুশি ভাজলেই হলো ! আনন্দ করে খাও !
তেলে নাড়ু ছাঁকা হবে আর ঢালা হবে একটি ঝুড়িতে, তেল ঝরাবার জন্য | ঝুড়ির নিচে ডেকচি তেলে ভরে উঠবে | সেই তেল আবার ঢালা হবে কড়াইতে | জনতা স্টোভে কেরোসিনের আঁচে আধ কড়াই তেলে ফুটছে আনন্দনাড়ু ; আর সেই সাথে বাড়ির ছোটরাও ফুটছে আনন্দে ! আজ বিকেল থেকে সন্ধ্যে অবধি শুধুই আনন্দনাড়ু খাওয়ার আনন্দ !
রান্নাঘরের পশ্চিমদিকের জানালা দিয়ে নিম, নারকেল, কাঁঠালগাছের ডালপালা ভেদ করে পড়ন্ত সূর্যের আলো নানারকমের নকশা কেটেছে মেঝে জুড়ে ! দক্ষিণদিকের জানালা দিয়ে ভেসে আসছে গন্ধরাজের সুগন্ধ ! বড়োসড়ো গন্ধরাজ গাছটি সাদা ফুলে ঢেকে আছে ! এখনই মুখুজ্জে ঠাকুমা এলো বলে ! রোজ সে ফুল নিতে আসে ! সাজি ভরে নিয়ে যায় গন্ধরাজ ফুল !
বলতে বলতেই সদর দরজার বাইরে হাঁক পারলো, "কইগো দিদি, কি করছেন ?"
- আসুন, আসুন, এই আজ একটু আনন্দনাড়ু ভাজছি !
ঠান্দি রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয় | মুখুজ্জে ঠাকুমা দালানে সাজিখানি রেখে রান্নাঘরে এসে একটা কাঠের পিঁড়ি নিয়ে ঠান্দির মুখোমুখি বসেন |
- বাহ্ ! আপনাদের নাড়ুগুলি বেশ তো !
- একটা খাবেন না কি ?
- না, না, এই তো ভাত খাওয়া হলো |
- খান না একটা, খেয়ে দেখুন !
- আবার প্লেট কেন ? হাতেই দিন না !
মুখুজ্জে ঠাকুমার হাতে ঠান্দি দুটো গরম নাড়ু দেয় | মুখুজ্জে ঠাকুমা একটুখানি খেয়ে বলেন, "বাহ্, এতো বেশ খাস্তা হয়েছে ! আমাদের গুলো এমন হয় না ! এতে কি কি দিয়েছেন দিদি ?"
- এই তো ময়দা, নারকোলকুঁড়ো, তিল, গুড়, চিনি, একটু চালগুঁড়ি - এইসব আর কি !
- খেতে খুব ভালো হয়েছে কিন্তু !
- বাড়ির জন্য নিয়ে যান না !
- না, না, আবার বাড়ির জন্য কেন ? এই তো বেশ খেলুম !
- তা হোক, আপনার ছেলে, বৌমা, মেয়ে আর নাতি-নাতনিদের জন্যও একটু নিয়ে যান !
এলুমিনিয়ামের ছোট একটি ডিবেতে ঠান্দি আনন্দনাড়ু ভর্তি করে দিলো | মুখুজ্জে ঠাকুমা এবারে ফুল তুলতে বাগানে গেলেন | গৌরীমাসি পুকুর থেকে ধুয়ে বাসনের গোছাটা রান্নাঘরের চৌকাঠের কাছে নামিয়ে রেখে বললো, "মা, এট্টু সরষের তেল দাও | লোহার কড়াইতে মাখিয়ে দিয়ে যাই, নাহলে মরচে ধরবে |"
- এই নাও, হাত পাতো |
পিতলের পলা দিয়ে চিনামাটির কৌটো থেকে সরষের তেল বের করে গৌরীমাসীর হাতে দেয় ঠান্দি | তারপর বলে, "গৌরী, যাবার সময়ে দুটো আনন্দনাড়ু নিয়ে যেও ছেলেপুলেদের জন্য !"
গৌরীমাসি একগাল হাসে ! বলে, "তুমি তো ভালো কিছু হলেই দাও আমাকে !"
ঘরমুছে বাড়ি যাবার সময়ে গৌরীমাসি কাগজে মোড়ানো নাড়ুগুলি আঁচল ঢাকা দিয়ে নিয়ে যায় | মুখুজ্জে ঠাকুমা লোহার আঁকশিটা উঠোনের একপাশে রাখতে রাখতে বলেন, "দিদি, আজকে আপনাদের গাছে অনেক ফুল ফুটেছে ! ফুল তুলে আমার মন ভরে গেছে !"
মুখুজ্জে ঠাকুমা এবারে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, "কি রে, তুই আনন্দনাড়ু খেয়েছিস ?"
আমার গালে নাড়ু, হাতে তখনও বাটিটা রয়েছে | ঘাড় নাড়ি, খেয়েছি | আমি তো সব কিছু আগেভাগেই পাই ! শুধু খাওয়ার পর আবার কিছু তুলে খেতে গেলে ঠান্দি বলে, "এঁঠো করিস না ! সবাই খাবে তো ?"
নারকেল-তিল আর গুড় সহযোগে সেই আনন্দনাড়ুর স্বাদই আলাদা ! ঠান্দি আজ আর নেই, নেই সেই আনন্দনাড়ু ! কিন্তু ছোটবেলাকার সেই স্মৃতি আজ অমলিন !
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ