রূপুর একদম মন ভালো নেই। ষ্টেশনের পাশ দিয়ে বুড়িমার বাগানের গা ঘেঁষে সরু ঝুপসি গলিটা দিয়ে ইটের রাস্তাটায় উঠে যায় সে। ইট পাতা লাল রাস্তাটা বর্ষার জল পড়ে আরো লাল টুকটুক করছে। এই রাস্তাটা দিয়ে বাঁ হাতে কিছুটা গেলেই তাদের ইস্কুলটা ; বিদ্যাসাগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। উঁচু দালানের উপর পরপর ছ'টা ঘর। মাথাটায় পাকা ছাদ। আগে ইস্কুলের ছাদটা ছিল করোগেটের। এখন পাকা হয়ে গেছে ।
রূপু হাতে একটা কঞ্চি নিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে ঠুকতে ঠুকতে ইস্কুলের দালানে উঠে পড়ে লাফিয়ে। প্রায় দেড়বছর হতে চললো তাদের ইস্কুল বন্ধ। করোনা রোগের জন্য লকডাউন। সব বন্ধ। শুধু মাঝে মাঝে একবার করে খোলে। মিড ডে মিলের দিন। মাষ্টারমশাইরা আসেন । তার বাবা সনাতন দাস যায়। আরো সকলের বাবা মা যায়। মিড ডে মিলের চাল, আলু, ডাল, ছোলা নিতে। মাঝে মাঝে সয়াবিনের বড়ি দেয় ইস্কুল থেকে। সেইসব নিয়ে এক মুখ হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরে রূপুর বাপ ।
রূপু তখন লাফিয়ে পড়ে বাবার ঘাড়ে। তার মুখে তখন বিরাট চওড়া হাসি। তার ইস্কুল থেকে দিয়েছে বলে কথা ! বেশ দু-চারদিন রান্না-বাড়া হয় সেই চাল, ডাল, আলু দিয়ে। যতবার খায় ভারি তৃপ্তি হয় রূপুর। ভাতটা মনে হয় ভারি মিহি। ডালটার সোয়াদ বেশি পায়। বারবার মায়ের থেকে চেয়ে খায়। আহ্ কী দারুণ ! শেষপর্যন্ত মায়ের বকুনি খেয়ে থামে সে ।
রূপু ইস্কুলের দালানে উঠে ঘোরাফেরা করছিল। দেখে চারিদিকে আগাছায় ভরে গেছে। কাগজে নাকি লিখেছে পুজোর পর ইস্কুল খুলে যাবে। — এদিকে এই এত আগাছা !
রূপুর হঠাৎ মন কেমন করে অন্য বন্ধুদের জন্য ইস্কুলের জন্যে। কতদিন ইস্কুলে আসেনি ! বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়নি। ইস্কুলের স্যারেদের জন্যেও মন কেমন করে রূপুর। তাদের ইংরেজি পড়াতেন ভৌমিক স্যার। স্যারের এই ভুঁড়ি ! প্যান্টের ভিতর গুঁজে লাল নীল শার্ট পরেন স্যার। রূপুদের খুব মজা লাগে দেখতে। স্যার খুব ভালোবাসেন তাদের। আর হেডস্যার তো যেমন রাগী তেমনি আবার কী সুন্দর করে পড়ান। বুঝিয়ে বুঝিয়ে গল্প বলে পড়ান স্যার। রূপু মনে মনে আওড়ায় স্যারের আবৃত্তি করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা —" আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে । "
রূপু গাছের ডাল দিয়ে আগাছার উপর ঝপাৎ ঝপাৎ করে মারে। লাফিয়ে নামে দালান থেকে। আম গাছের তলায় দুটো কাঁচা আম পড়ে আছে ; দৌড়ে গিয়ে তুলে নেয়। পকেটে পুরে হাঁটা দেয় বাড়ির দিকে। পথে যেতে যেতে দেখে সাইকেলে চড়ে অবুদা যাচ্ছে বাজারের দিকে। অবুদা ছেলে মেয়েদের বাড়ি গিয়ে পড়ায়। সে অবুদার সাইকেলের পিছনে দৌড়োয়। ডাকে "অবুদা ও অবুদা কোথায় যাচ্ছো ? '
— "কে রে ? ও রূপু। শোন্ শোন্ তোর সঙ্গে কথা আছে । "
— "আমার সঙ্গে কথা ? কী কথা গো অবুদা ?" রূপুর গলা দিয়ে খুশি ঝরে পড়ে। ছুটতে ছুটতে অবুদার কাছে যায় ।
অবু অর্থাৎ অবিনাশ রায় রূপুদের গাঁয়ের এম এ পাশ করা যুবক। সে চাকরি বাকরির চেষ্টা করছে। খুব পরিশ্রমী। সারাটা দিন কিছু না কিছু করে যায়। ওই এক সাইকেল আছে তার । অবু বলে তার পক্ষীরাজ সব জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায় তাকে। তার কোনো চিন্তা নেই যতক্ষণ তার পক্ষীরাজ আছে ।
অবুর বাবা মারা যাওয়ার পর সে আর তার মা ; সংসারে এই দুটি মানুষ। সারাটা সকাল সাইকেলে চেপে টিউশন পড়াবার জন্য এমাথা থেকে ওমাথা চক্বর মেরে যায় অবু। আশপাশের দু'তিনটি গ্রামে ঘুরে ঘুরে সে পড়ায়। দুপুরে বাড়ি এসে খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম। সন্ধ্যে থেকে নিজের পড়াশোনা। চাকরির পরীক্ষার মোটা মোটা বই পড়ে অবু ।
রাস্তায় দেখা হতে অবু রূপুর কাঁধ জড়িয়ে বলে "শোন রূপু সামনের সোমবার থেকে আমি, অমিতদা আর শ্রাবণীদি রথতলার মন্দিরের সামনের মাঠে ছোটদের পাঠশালা খুলছি। পড়তে চলে আসবি বইপত্তর নিয়ে। করোনা ভাইরাসের ঝামেলায় তো বাচ্চাদের পড়াশোনা লাটে উঠেছে। বুঝলি না সব বাচ্চাদের বাড়িতে কি আর স্মার্ট ফোন অছে ! তোর বাবারও তো স্মার্ট ফোন নেই ?”
—"না গো অবুদা, নেই তো। বাবার এবছর তেমন রোজগারও হয়নি। স্টেশনের ভাতের হোটেলতো বন্ধই রয়েছে লকডাউনের জন্যে। যে ফোনটা ছিল সেটাও তো খারাপ হয়ে গেছে। ওটা অবশ্য সেই পুরনো ফোন ছিল। ইস্কুলের স্যারও সেদিন বাবাকে বলছিল বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের বাড়িতে স্মার্ট ফোন নেই বলে ইস্কুলে অনলাইন ক্লাস শুরু করতে পারছেন না। বাবাকে বলছিল কাছের কারোর যদি ওই রকম ফোন থাকলে তাকে পড়ার সময়টুকুর জন্যে সাহায্য করার কথা বলতে। কিন্তু কে আর কাজের জিনিস ব্যবহার করতে দেবে বলো অবুদা। তাই আর পড়া হচ্ছে না আমাদের। "
—"ঐ জন্যেই তো বলছি লেখাপড়া না করে যে খোলা ছাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস লেখা পড়া তো সব ভুলতে বসেছিস। সোমবার থেকে বিকেলে পড়তে চলে আসবি। আর তোর বন্ধুদেরও বলে দিবি আসবার জন্য। ঐ তোর সব বিচ্ছু বন্ধুরা ; কী যেন নাম সব ! ভুটু, বদ্রি, লক্ষী, বেলা, বিহারী, রমেশ — সব কটাকে যেতে বলবি।"
রূপু ভারি খুশি হয়। অবুদার হাতটা জড়িয়ে ধরে বলে"কী মজা অবুদা। তোমরা পাঠশালা খুলেছ আমাদের জন্যে ! আমরা কতদিন বাদে পড়তে যাবো ! খুব ভালো করেছো অবুদা আমি সবাইকে যেতে বলব। আমি এক্ষুনি সকলকে খবর দিতে যাচ্ছি।" রূপু ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে বলে "যাই অবুদা — তুমি বাজার ঘুরে বাড়ি যাও। আমরা ঠিক সময়ে তোমার পাঠশালায় পৌঁছে যাব। "
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ