আমার পাড়াতুতো ভাইপো বিরাজ ; তথা বিরাট । বছর এগারোর একটা ছেলে । ওর মা ওর বিরাজ নামটা রেখেছে । আর বাবার দেওয়া নাম হলো বিরাট । মা মৌমিতা বাংলা সাহিত্যের অনুরাগী । বাবা রণদেব ক্রিকেটের ভক্ত । বিশেষ করে ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের তারকা বিরাট কোহলির একান্ত অনুরাগী । সুতরাং ছেলের নামেও তাদের বাবা মায়ের পছন্দ অপছন্দের ছাপ স্পষ্ট ।
ছেলেটাকে আমি ডাকি লজেন বলে । আসলে ছোট্ট বয়সে আমাদের বাড়িতে যখন ও আসতো ; বলতো , ' পিসি লজেন দাও ' ।
আমি ওর হাতে লজেন্স ধরিয়ে দিতাম । তার পরেই ওর বাঁধা বুলি ছিল , ' পিসি লজেন দিয়েছে । পিসি ভালো , পিসি ভালো । '
সেই থেকে আমি ওকে ডাকি লজেন বলে । আর ও আমায় ডাকে ভালো পিসি নামে ।
একদিন ও আমার কাছে এসে কেঁদে পড়লো , ' ভালো পিসি আমি আর বাড়ি যাবো না । '
— ' সে কি লজেন , বাড়ি যাবে না কেন ! '
— ' দুর্ ঐ বাড়িতে কেউ থাকে ! '
—' কেন , কি হলো ? '
আমার প্রশ্নের উত্তরে লজেন বলে , ' ঐ বাড়িতে কেউই থাকবে না । '
—' কেন , থাকবে না কেন ? '
লজেন বলে , ' শোনো তাহলে , আমি সকালে উঠি ছটায় । দাঁত মেজে ব্রেকফাস্ট করি সাড়ে ছটায় । সাতটায় স্কুলে যাই । বাড়ি ফিরলেই মা আমায় স্নান করতে পাঠায় । ভালোপিসি বলো তুমি , স্নান করাও তো একটা কাজই না । '
— ' তা ঠিক বলেছিস লজেন । স্নান করা , ভাত খাওয়া --- সবই তো ঝামেলার ব্যাপার । রোজ রোজ একই কাজ । আমারও ভালো লাগেনা । '
— ' তাহলেই দেখো , তুমি এইটুকুতেই হাঁফিয়ে যাও আর আমাকে আরো কত কি করে যেতে হয় । আমাকে তো মা এইসব করোনা রোগ , লকডাউন ফাউনের আগেই পাড়ার বিমলকাকুর আবৃত্তি ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিল , সেটা কি জানো ? '
— ' তাই না কি ! সে তো খুব ভালো কথা রে লজেন । কেমন সুন্দর করে কবিতা বলা শিখবি । স্টেজে উঠে ফাংশনে কবিতা বলবি । ভালোই তো হবে । আমরা শুনতে যাবো ।
— ' হ্যাঁ , খুব ভালো হবে । ' লজেন তার ছোট্ট চেহারা দুলিয়ে বিদ্রূপের সুরে বলে ।
আমি প্রশ্নের ঢঙে চোখ নাচিয়ে এমন করার কারণ জিজ্ঞাসা করি ।
লজেন প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে বলে , ' বিমলকাকু কত কত কবিতা মুখস্থ করতে দেয় । সেসব বাড়ি এসে মুখস্থ করতে হয় । মা কবিতা মুখস্থ হলে ধরে । না পারলেই কান মুলে দেয় । ইস্কুলের পড়া , কবিতা পড়া ! আর বিমলকাকুর বাড়ি পাড়াতে বলে লকডাউনেও ছুটি পাইনি । আর এখন তো ওসব উঠে গেছে । সপ্তাহে দুদিন করে বিকেলবেলায় যেতেই হবে । এছাড়াও আবার মিলিদি এসে বুধবার বুধবার আঁকা শেখায় । কি না বিজ্ঞানের খাতায় ভালো করে আঁকতে পারবো ! '
আমি বলি , বোঝানোর সুরে , ' বুঝলি লজেন পড়াশোনার সঙ্গে একটু আধটু অন্যরকম করলে তোর ভালোই লাগবে দেখিস । আর কবিতা বলা , আঁকা এসবতো ভালোই । '
চোখ মুখ পাকিয়ে বছর এগারোর লজেন বলে ,' হ্যাঁ হ্যাঁ সব আমার মঙ্গলের জন্য ; আমি জানি সেটা । তোমাকে আর আমায় বোঝাতে হবে না ভালোপিসি । এরপর আবার বাবা ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি করে দেবে বলেছে । সারাটা বিকেল ধরে — ' লজেন কথা শেষ করতে পারে না । কেঁদে ফেলে ।
বুঝতে পারি অনেক কষ্ট , ক্ষোভ ওর মনের ভিতর জমা হয়ে রয়েছে । কাছে গিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই লজেন আমার গায়ের কাছে ঘেঁষে আসে । খাটের ধারে বসে , ওকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করি , ' হ্যাঁরে লজেন এতসব করতে করতে হাঁফিয়ে যাস তাই না রে ? '
— ' যাই-ই তো । প্রত্যকদিন সকাল , বিকেল , সন্ধ্যে একটা না একটা কিছু করে যেতে হয় , বাবা মা যেমন যেমন বলবে । ভালো লাগে না আমার । '
লজেনকে জড়িয়ে ধরে বলি ,' তোর নিজের কি করতে ভালো লাগে রে লজেন ? '
— ' জানো ভালোপিসি দাদু যখন ছাদে টবে টবে গাছ লাগায় , মাটি খুঁড়ে দেয় ; আমার খুব ভালো লাগে দেখতে । আমিও জল দিই মাঝে মাঝে । যেদিন বিকেলবেলা কিছু থাকে না সেইদিন শুধু । '
—' তোরও গাছের শখ আছে বুঝি ? নাতিরও দাদুর মত শখ । তোর দাদু কি বড় বড় জুঁই ফুল ফুটিয়েছে গাছে ! দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় । তোর দাদুকে একটা জুঁইয়ের চারা দিতে বলিস তো আমাকে । আমি বারান্দায় রাখবো । '
লজেন এবার খুব সন্তর্পণে কথা বলার ঢঙে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলে ,' ভালো পিসি তুমি আমার বাবা মাকে একটা কথা বলবে ? '
—' কী কথারে ? '
— ' আমার না এইসব আবৃত্তি করা , ক্রিকেট শেখা এসব তেমন ভালো লাগে না । আমার খুব নাচ শিখতে ইচ্ছে করে । টিভিতে দেখেছো তুমি , মুখে মুখোশ পরে মা দুর্গা সেজেছে , বাঘ সিংহ সেজে নাচে -- পুরুলিয়ার ছৌ নাচ । এই লাফিয়ে ওঠে , বাঁই বাঁই পাক খায় । আমার দারুণ লাগে । ওই নাচটা শিখতে আমার খুব ইচ্ছে করে । বাবা মাকে বলেওছিলাম । '
— ' কী বললো তোর বাবা মা ? '
— ' ওরা সোজা না বলে দিলো । বললো সাধারণ ছেলেরা ওসব নাচ ফাচ শেখে না । আর ঐ সব ছৌ নাচ টাচ গাঁয়ের লোকেরা করে । শহরের ছেলেরা যা শেখে সেটাই তুমি শিখবে । '
— আমি বুঝে উঠতে পারিনা লজেনকে কি বলবো । ওর বাবা মায়ের মান্ধাতার আমলের চিন্তা ভাবনার কথা শুনে বুঝতে পারি ওদের মনের বদ্ধমূল ধারণাগুলোকে নির্মূল করা যাবে না । মেয়েরা নাচ শেখে , ছেলেরা ক্রিকেট , ফুটবল । ছেলেরা খেলনা বন্দুক নিয়ে খেলবে , মেয়েরা পুতুল । গাঁয়ের লোকেরা লোকনৃত্য করবে , শহরের লোকেরা ওসবের দিকেও যাবে না— উফ্ কতরকমের ভেদাভেদ আমাদের !
লজেনকে দেখে আমি খুশি হই । ছেলেটা বেশ অন্যরকম তো ! টিভিতে দেখে দেখে ওর ছৌ নাচ ভালো লেগেছে । ঐ নাচ শিখতে চায় ও । ভালোই তো । কত অন্যরকমের ইচ্ছে বাচ্ছাটার ! আমরা উদয়শঙ্করের নাচ দেখে অভিভূত হই । উনি বাঙালি ছিলেন বলে গর্ব অনুভব করি । অথচ নিজেদের ঘরের ছেলে ছৌ নাচ শিখতে চাইলে আপত্তি করি ! আমি ওর বাবা মা কে নিশ্চয়ই বলবো । বোঝাতে হবে ওদের ।
লজেনকে বলি , ' তোর কোনো চিন্তা নেই আমি তোর বাবা মাকে গিয়ে বলবো তোর ইচ্ছের কথা । ওরা আমাকে দিদি বলে । আমার কথা ওরা শুনতে বাধ্য । '
আমি মজা করে বলি , ' আমার লজেন সোনার দুঃখ হলে , ভালো না লাগলে , তার উপর ওরা চাপ দিলে -- সেটা একটা বড়সড় অপরাধ । সে যা বলবে সেটাই তাকে শেখাতে হবে । নচেৎ আমরা ঐ বাড়ির সামনে অনশন করবো । " চলবে না চলবে না লজেনের উপর জুলুম করা চলবে না চলবে না । " ঠিক বলেছি তো লজেন ? ' আমি ওকে পেটে বুকে কাতুকুতু দিতে থাকি । ছেলেটা খিলখিল করে হাসতে হাসতে খাটের উপর শুয়ে পরে প্রায় । সরল , ঝলমলে হাসিতে ওর চোখ মুখ খুশিতে ঝিকমিকিয়ে ওঠে । আমার ভালো লাগে । ওর মন থেকে মেঘ সরে গেছে ।
আমি মনে মনে ঠিক করি , ওর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে লজেনের ছৌনাচের ইচ্ছেকে নিশ্চিত পূরণ করবো । এটা একটা রীতিমতো সামাজিক কর্তব্য বলে মনে হয় আমার । দুটো চকোলেট ব্যাগ থেকে বার করি আমি । একটা মিশনে নামার আগে আমি আর লজেন শক্তি সঞ্চয় করার লক্ষ্যে মন দিয়ে চকোলেট খাই ।
ছবিঃ পেক্সেল ও উইকিপিডিয়া