অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রিয়া আর মৌনিকা। উফ যা টেনশান।
এখন কয়েকটা দিন শুধু মজা। রিয়া মৌনিকাকে বললো,"এবারের ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায় বলতো? "
মৌনিকা তখনি বললো, "আমি একটা সুন্দর জায়গা জানি। জায়গাটার নাম দেবপুর। সেখানে আমলকি গাছের ওপরে পাখিরা গান করে। নীচে পড়ে থাকা আমলকি কুড়োতে ভিড় করে কতশত কাঠবেড়ালী। মাঠ জুড়ে ঘুরে বেড়ায় হরিণের দল। দূর থেকে ভেসে আসে ঝরণার জলের ঝিরঝির শব্দ।" আনন্দে রিয়া লাফিয়ে উঠলো। মৌনিকাকে জড়িয়ে ধরে বললো, "কেমন করে আমরা যাবো দেবপুর?" মৌনিকা বললো, "কেন ট্রেনে করে। সেখানে তো আমার মাসির বাড়ি।"
বাড়ি গিয়ে বাবা -মা দের রাজি করানোটা অবশ্য একটু মুশকিল হল প্রথমে। দুই বাড়ির বড়োরা কেউ রাজি হচ্ছিলেন না দুজন কে একা একা ছেড়ে দিতে। কিন্তু শেষ অবধি মৌনিকা আর রিয়া ই জিতে গেল। দেবপুর লোকাল ট্রেনে ঘন্টাখানেকের পথ, আর ওখানে স্টেশনে মেসো নিতে আসবেন। তাছাড়া দুজনের কাছেই তো মোবাইল ফোন আছে, তাই চিন্তা কিসের? বাবা মা তো চাইলেই কথা বলতে পারবেন।
চারদিনের মাথায় সক্কালবেলা দুই বন্ধু রিক্সা চেপে মনের আনন্দে স্টেশনে পৌঁছোলো। মৌনিকা গেল লোকাল ট্রেনের টিকিট কাটতে আর রিয়াকে সব জিনিপত্র দেখার জন্য একটা বেঞ্চিতে বসতে বললো। রিয়া মৌনিকাকে বললো, "শোন টিকিট কিনে ফেরার সময় একটু ঝালমুড়ি কিনে আনিসতো। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।" মৌনিকা খিচমিচ করে উঠলো, "এইতো বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে লুচি,ফুলকপির তরকারি,নলেন গুড়ের সন্দেশ সব চেটেপুটে খেলি। আবার এখনি তোর ক্ষিদে পেয়ে গেলো?" রিয়া তবুও ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো। মৌনিকা বললো,"আচ্ছা বাবা নিয়ে আসছি। কিন্তু চুপটি করে বসে থাকবি কোথাও যাবি না।"
আসলে দুজনে একক্লাসে পড়লেও মৌনিকা একটু বেশি হম্বিতম্বি করে। রিয়া কিছু বলে না। আসলে ওরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু। একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারে না।
টিকিট কাউন্টারে গিয়ে মৌনিকা দেখলো বিশাল লাইন। সবাই বেড়াতে যেতে চাইছে। মৌনিকা সেই ভিড় লাইনে দাঁড়িয়ে ঝালমুড়িওলাকে খুঁজতে থাকলো। এমন সময় মৌনিকা শুনতে পেল প্রচন্ড গোলা-গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ। পিছনে ফিরে দেখে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে,চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে অসহায় মানুষ। মৌনিকা কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না। বাইরে বসে আছে তার প্রিয় বন্ধু রিয়া। সেখান থেকেই ছুটে আসছে আগুনের হল্কা,গুলির শব্দ। মৌনিকা ছুটে বাইরে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। একজন কম্যান্ডো অফিসার ততক্ষণে ধরে ফেলেছেন মৌনিকাকে। চেঁচিয়ে বলছেন, "কেউ ওদিকটায় যাবেন না। ব্যারিকেডের পাশের ঘরটায় চলুন। হ্যাঁ টিকিট ঘরের পেছনের ঘরটায়।" মৌনিকা কম্যান্ডো অফিসারকে বোঝাবার চেষ্টা করলো তার প্রিয় বন্ধু রিয়া বাইরে। অফিসার কোনো কথা শুনলেন না। বললেন,"আপনারা কেউ বাইরে বেরোবার চেষ্টা করবেন না। কেউ ডাকলেও দরজা খুলবেন না। জঙ্গীরা গোটা শহরটা ঘিরে ফেলেছে।"
ঘরবন্দি মৌনিকা বারবার রিয়াকে মোবাইলে ট্রাই করলো। কিন্তু পেল না। বাড়িতে ও করল, সেখানেও পেল না। গভীর চিন্তা আর অবসাদে তার সারারাত কাটলো। মোবাইলের নেটওয়ার্ক কখন চলে গেছে খেয়াল নেই। কারো খাওয়া নেই, ঘুম নেই। একটু খাবার জল নেই। বড় ঘরটায় শুধু নেই আর নেই এর বিলাপ। বাথরুমের গন্ধ। ঠিক কখন মনে নেই, হয়তো বিকেলের দিকে ঘরের বড় দরজাটা খুললো। সেই কম্যান্ডো অফিসার বললেন, "আপনারা সবাই বিপদ মুক্ত।" ঘর থেকে বেরিয়েই মৌনিকা ছুটলো সেই বেঞ্চির দিকে যেখানে রিয়া কাল সকালে বসেছিলো। কিন্তু কোথায় রিয়া? চারিদিকে শুধু চাপচাপ রক্ত, মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহ, পোড়া মাংসের গন্ধ। কিন্তু ওটা কি? আরে ওই তো রিয়ার লাল রঙের ব্যাগ। এগিয়ে যায় মৌনিকা। তারপর শুধু তাকিয়ে থাকে গুলিতে ঝাঁঝরা তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু রিয়ার নিথর দেহের দিকে।
ততক্ষণে মৌনিকাকে ঘিরে ধরেছে টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরা। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে যাচ্ছে একের পর এক। কী দেখেছো? তোমার কেমন লাগছে? আর কে কে ছিলো?মৌনিকা মাথা নীচু করে আস্তেআস্তে হাঁটছিলো। এবার সে দাঁড়িয়ে পড়লো। যারা এতক্ষণ তাকে প্রশ্ন করছিলো তাদের দিকে তাকিয়ে বললো, "আমি ঝালমুড়িওলাকে খুঁজছি। কাল রিয়া,আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ঝালমুড়ি খেতে চেয়েছিলো।" এই প্রথম মৌনিকা আর কথা বলতে পারলো না। তার চোখ আর গাল বেয়ে গড়াতে থাকলো সেই ঝিরঝিরে ঝরণাটা। যাকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিলো মৌনিকা আর রিয়ার।
সৃজনী লাহিড়ী
সপ্তম শ্রেণী,পাঠভবন,ডানকুনি