প্রিয় বন্ধু,
এই বাংলা নতুন বছরের শুরুতে, একটা ছোট্ট মেয়ের গল্প বলি তোমাদের। শুনে কী ভাবলে- বেশ তো , চাঁদের বুড়ি নববর্ষের সকালেই একখানা গল্প বলবে বুঝি? হ্যাঁ, বলতেই হবে, কারণ ইচ্ছামতী আবদার করেছে । আর পয়লা বৈশাখের সকালে তার কথা ফেলি কী করে?
চাঁদের বুড়ি আজকে একটা ছোট্ট মেয়ের গল্প বলবে। তার নাম...থাক না, নামে কী আসে যায়? ছোট্ট মেয়ে তো ছোট্ট মেয়েই হয়। তা সেই মেয়ের বয়স আট। এই আমাদের ইচ্ছামতীর থেকেও দুই বছরের ছোট সে। বড় সুন্দর এক জায়গায় থাকে সে। থাকে বলাটা অবশ্য ঠিক নয়, সেই মেয়েটা আসলে এক ভবঘুরে দলের সদস্য। সেই ভবঘুরে দলের মানুষেরা উঁচু উঁচু পাহাড়ের ঢালে আর দুই পাহাড়ের মাঝে উপত্যকায় সারা গ্রীষ্মকাল ঘোড়া চড়ায়, কাঠকুটো যোগাড় করে বেচে, বনের ফলমূল খায়, আর তারা বনের গাছপালা খুব ভালো চেনে। কোন গাছের কী গুণ, কোন লতায়, কোন পাতায় কী রোগ সারে, সব তাদের জানা। এইসব জ্ঞানে বড় বড় চিকিৎসকদেরও হার মানায় তারা। শীতের সময়ে যখন উঁচু পাহাড়ে বরফ পড়ে আর ঠাণ্ডা বেড়ে যায়, তখন সেই মানুষগুলো সমতলের দিকে জনবসতির কাছে নেমে আসে কয়েক মাসের জন্য।
আমাদের এই ছোট্ট মেয়েটার দলটা যথারীতি এক শীতে নেমে এসেছিল এক জনবসতির কাছে। কিন্তু সেই জনবসতিতে ভালো মানুষের অভাব ছিল, বরং সেই জায়গা ছিল মন্দ মানুষে ভর্তি। সেইসব হিংসুটে, খুব খারাপ কতগুলো মানুষ কিছুতেই এই ভবঘুরে দলটাকে মেনে নিতে পারল না। তাদের শহরের বাইরে, বনের মধ্যে কয়েকটা মানুষ কিছু তাঁবু খাটিয়ে শীতকালটা পার করতে চায়, এটা তাদের সহ্য হল না। নিরীহ ভালো মানুষগুলিকে কীভাবে জব্দ করা যায়, সেই বিষয়ে মন্দ মানুষগুলো সবাই মিলে একে অপরের সঙ্গে ফন্দী আঁটতে লাগল।
এদিকে আমাদের এই ছোট্ট আট বছরের মেয়েটা - কী সুন্দরই না তাকে দেখতে! বড় বড় টানা টানা চোখ, এক মুখ হাসি, মাথার দুইদিকে দুটো ঝুঁটি, সবাই তাকে কত ভালোবাসে, এমনকী তাদের পোষা ঘোড়াগুলোর সঙ্গেও তার খুব ভাব। সে রোজ ঘোড়াদের জঙ্গলে চড়াতে নিয়ে যায়। কী ভাবছ? -আট বছরের মেয়ে ঘোড়া চড়াতে জঙ্গলে যায় নাকি? স্কুলে যায়না? নাহ, এই মেয়েটা স্কুলে যেত কিনা কে জানে, তবে সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অনেক অনেক ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে আছে, যাদের সেই পাঁচ ছয় বছর থেকেই নানারকমের কাজ করতে হয়। সবার ভাগ্যে ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়া লেখা থাকে না।
এমনি একদিন, বনের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়া দুটো ঘোড়ার খোঁজ করতে ঢুকেছিল মেয়েটা। আর সেখানেই সে পড়ে গেল মন্দ মানুষদের খপ্পরে- সেই হিংসুটে, মন্দ মানুষগুলো, যারা চায়নি সেই ভবঘুরে দলের মানুষগুলো তাদের আশেপাশে থাকুক, এক সঙ্গে নিজেদের সুখ- দুঃখ ভাগ করে নিক। তারা সেই ছোট্ট মেয়েটাকে বন্দী করে নিল। তার দলকে শায়েস্তা করার জন্য সেই ছোট্ট মানুষটা হল কতগুলো মন্দ মানুষের শিকার।
তারপরে কী হল? তারপরে যেটা হল সেটা লিখতেও আমার হাত কাঁপছে। মন্দ মানুষগুলো সেই ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে একটা অন্ধকার গুহায় ঢুকিয়ে দিল। সেখানে কোথাও থেকে এক ফোঁটা আলো ঢোকে না। ওরা সেই ছোট্ট মেয়েটাকে খেতে দিল না, বরং তাকে খুব খুব ভয় দেখালো আর কষ্ট দিল। সেই অন্ধকার গুহায় বন্দী থাকতে থাকতে, মনের দুঃখে, ভয়ে, খিদে-তেষ্টায় কাতর হয়ে, সেই ছোট্ট মেয়েটা সাতদিন পরে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়ল। তখন সেই মন্দ মানুষগুলো গুহা থেকে বের করে এনে তার দেহটাকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিল।
এদিকে সেই ছোট্ট মেয়েটার পরিবারের লোকেরা তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেছে।। কেঁদে কেঁদে তাদের চোখ শুকিয়ে গেছে। জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ মেয়ের শুকিয়ে যাওয়া জীর্ণ শরীর দেখে তারা আর কী করবে ভেবে পেল না। তারা দেশের রাজার কাছে বিচার চাইতে গেল।কিন্তু রাজামশাই কোনোও ন্যায়বিচারই করলেন না। বরং তাঁর মন্ত্রী সান্ত্রীরা সেইসব দুঃখী মানুষগুলিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।
এই অবধি শুনে ইচ্ছামতীও জলভরা চোখে আমায় জিজ্ঞেস করল -" তারপরে কী হল?"
তখন তারা আর কী করবে? অসহায় মানুষগুলো ন্যায়বিচার পেল না। সবাই মিলে খুব কাঁদল, খুব খুব কষ্ট হল সবার। শুধুই তার কাছের মানুষেরা নয়, সেই ছোট্ট মেয়েটার জন্য তার প্রিয় ঘোড়াগুলোও কাঁদল; পথের ধারের ফুল, ফুলের ওপর উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি, বনের গাছ, গাছের পাখি, পাহাড়ি ঝর্ণা, বরফের মুকুট মাথায় দিয়ে দূরের পাহাড়, রাতের আকাশের তারারা, তারার দেশের পরীরা - সবাই কাঁদল। সঙ্গে কেঁদে উঠল কাছের দূরের যত পাহাড়-উপত্যকা-সমভূমি-মরুভূমি-বনভূমি-নদীতীর আর সমুদ্রতটের যত ভালো মানুষেরা।
তারপর... তারপর সেই আকাশ, পাহাড়, বন, ঝর্ণা, পশুপাখি, মানুষ - সবার অবিরাম কান্না মিলে মিশে এক জলধারা জন্ম নিল। দুনিয়ার যত ভালো মন, ভালো প্রাণেদের কান্না এসে জমে জমে ক্রমশ সেই জলধারায় যুক্ত হল। এইভাবে সেই ছোট্ট জলধারা একদিন ফুলে ফেঁপে এক বিশাল নদী হয়ে গেল। পাহাড়-উপত্যকা-সমভূমি বেয়ে ধীরে ধীরে নেমে এসে সেই কান্নাভরা ভালোনদী একদিন ভাসিয়ে নিয়ে গেল মন্দ লোকেদের সমস্ত বসতি। রাজার প্রাসাদেরও তোয়াক্কা করল না সেই নদী। যেখানে যত অন্যায়, যত অত্যাচার সব ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে দিতে এগিয়ে চলল সেই নদী।
আর সেই ছোট্ট মেয়েটা? আকাশ থেকে আলোর পথ বেয়ে এসে পরীরা তাকে আলোর দেশে নিয়ে গেছে। যেখানে যা কিছু ভালো, আলোর দেশে সে সব কিছু আছে, শুধু সেখানে মন্দ মানুষ নেই। সেইখানে সেই ছোট্ট আট বছরের মেয়েটা নির্ভয়ে খেলে বেড়ায়, তার নতুন বন্ধুদের সঙ্গে। আর মাঝেমাঝেই যখন তার ফেলে আসা বন্ধুদের কথা , পরিবারের কথা, তার প্রিয় ঘোড়াগুলোর কথা , আর সেই অন্ধকার গুহাটার কথা মনে পড়ে, কষ্ট হয়, কান্না পায়, তখন সে বাতাসের হাতে তাদের সবার জন্য কয়েক মুঠো আলো পাঠিয়ে দেয়।
"গুহাটার জন্যেও আলো পাঠায়?" অবাক চোখে প্রশ্ন করে ইচ্ছামতী।
পাঠাবে না? না পাঠালে গুহার ভেতরের অন্ধকার কাটবে কী করে? গুহাটার ভেতরে তো আলো দেওয়া জরুরী, যাতে মন্দ লোকেরা আর কোনোও ছোট্ট মেয়ে কিংবা ছেলেকে ওইরকম অন্ধকারের মধ্যে আটকে রাখতে না পারে।
"আর সেই নদীটা কী করল? যত মন্দ লোক আছে, সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল?"
নাহ, সব মন্দ লোককে কি আর এক সঙ্গে শাস্তি দেওয়া যায়? এক দলকে শাস্তি দিতে দিতেই আরেকদল অন্যরকমের মন্দ কাজ করে ফেলে। কিন্তু সেই ভালোনদী তার কাজ থামায় না। এই পৃথিবীর সব থেকে ভালো ব্যাপারটা হল, এখনও এখানে ভালো প্রাণেদের সংখ্যা মন্দ মানুষদের থেকে অনেক অনেক বেশি। তাই সেই নদীতে কখনও ভাঁটা আসেনা, সে এগিয়ে চলতেই থাকে।
এই অবধি শুনে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে ইচ্ছামতী আমায় জিজ্ঞেস করল, "তুমি পুরোটা গল্প 'একটা ছোট্ট মেয়ে' বললে কেন? গল্পের চরিত্রদের নাম দিতে হয়, জানো না?"
জানি তো, গল্পের চরিত্রদের নাম থাকতে হয়।কিন্তু সারা পৃথিবী জুড়ে এমন আরোও কত কত ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে আছে, যারা মন্দ লোকদের ভয়ে , মন্দ লোকেদের অত্যাচারে কষ্ট পায়, মরে যায়। আমি শুধু তাদের একজনের কথা তোমাদের বললাম। এখানে নামটা জরুরী নয়। জরুরী হচ্ছে এটা বুঝতে পারা, যে এরকম অন্যায় আমরা অন্য কারোর সঙ্গে কখনও করতে পারি না, বিশেষ করে ছোট ছোট মেয়েদের আর ছেলেদের সঙ্গে তো করতেই পারি না। তুমি আর তোমার বন্ধুরাও তো আর কিছুদিন পরেই বড় হয়ে যাবে, বয়সে, মনে এবং চেহারায়- তখনও তোমাদের মনে রাখতে হবে,যে নিজের স্বার্থে তুমি অন্য কাউকেই কষ্ট দিতে পারো না।
"তুমি নববর্ষের সকালে এরকম একটা মন ভার করে দেওয়া সত্যি গল্প শোনালে কেন?"
আমারও মন খুব ভার হয়ে আছে যে। ইচ্ছে থাকলেও মন থেকে বানিয়ে তোমাকে পছন্দসই রহস্য-রোমাঞ্চ কিংবা হাসির গল্প বলতে পারলাম না। নতুন বছরে তোমাদের সঙ্গে এই সত্যি গল্পটা ভাগ করে নিলাম।আর তোমরাই তো চাঁদের বুড়ির সবথেকে প্রিয় বন্ধু, তাই না? তাই আমার সত্যি গল্পের শেষে, স্বপ্নের মত যে কান্নাভরা ভালোনদীর কথা বললাম, সে তো তোমাদেরই ভরসায়। সব মন্দকে ধুয়ে মুছে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে যে ভালোনদী, তাকে সবসময়ে ভালোবাসার যোগান তো দিতে হবে তোমাকে, আমাকে, আমাদের সবাইকে, তাই না?
এসো, নতুন বছরে আমরা সবাই আরেকবার চেষ্টা করি নতুন করে ভালো থাকার পাঠ নিতে।
ভালো থেকো, সর্বদা সবাইকে ভালো রেখো ।
ছবিঃ পিক্সাবে