সে অনেককাল আগের কথা। মোগলরা দেশটা কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে, এদিকে কোম্পানিও পুরো গুছিয়ে বসতে পারেনি, তাই দেশজুড়ে চলছে অরাজকতা। তার সঙ্গে আবার ছিল বর্গীদের ভয়। কিছুকাল আগেই তাদের হানায় হানায় জেরবার হয়েছে মানুষজন। বর্গী, মোগল, ইংরেজদের ভয়ে বদলে যাচ্ছে বাংলার গ্রামজীবন, সমাজ জীবন। মেয়েরা ঘরে বন্ধ থাকতে, পর্দার আড়ালে, দরজার পেছনে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মেয়েদের পড়াশোনা করার যে এক উজ্জ্বল ইতিহাস ছিল, সেসব ধুয়ে মুছে সবাইকে বোঝানো হয়ে গেছে যে মেয়েরা পড়াশোনা করলে বিয়ে হবেনা কিংবা বিয়ে হলেও তাড়াতাড়ি বিধবা হবে। তার সঙ্গে রয়েছে আরও কত জাতপাতের বিধিনিষেধ আর সামাজিক নিয়মের বেড়াজাল, তার হিসেব রাখা ভার।
এমনই এক সময়ে, বোলসিদ্ধি গ্রামে বসবাস করতেন পন্ডিত কালীগতি তর্করত্ন। পন্ডিত কালীগতি তর্করত্নের কিশোরী মেয়ে জয়াবতী। সে ডানপিটে, ভূত-ডাকাত-মোগল-বর্গী কাউকেই ভয় পায় না। অন্য মানুষ, সে তিনি যেই হোন না কেন, কোনো উপদেশ বা আদেশ দিলে, যদি তার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে, তাহলে সে নিজের মনের কথা বলতে, তর্ক করতে পিছপা হয় না। মেয়েদের জন্য, বিশেষ করে বিধবাদের জন্য বানানো যত সামাজিক নিয়ম কানুন নিয়ে সে প্রশ্ন তুলতে ভয় পায় না। সে নানারকমের হাতের কাজে পারদর্শী, তার মত লেখার কালি কেউ বানাতে পারে না। তবুও, এহেন মেয়ে জয়াবতীকে তার বাবা অক্ষর পরিচয় করান নি। কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন পূর্বপুরুষের বিধান — লেখাপড়া শিখলে মেয়ে বিধবা হবে। তবে একটা ভালো ব্যাপার — যদিও জয়াবতীর মা তার বিয়ে দিতে খুবই ব্যস্ত, তার বাবা তাঁর এই উজ্জ্বল সন্তানটিকে সহজে বিয়ে দিয়ে চোখের আড়াল করতে চান না।
জয়াবতী অবশ্য লেখাপড়া না শেখার পারিবারিক বিধান মেনে নেয় নি। বাবাকে না জানিয়ে নিজের বালবিধবা সই পুণ্যির কাছ থেকে সে বাংলা পড়তে শিখে গেছে। আর একদিন যখন তার বাবা, মা আর বাড়ির রাঁধুনী হঠাৎ জ্বরে বেহুঁশ , তখন সে পুণ্যির সাহায্যেই এক প্রাচীন পুথি দেখে ওষুধ তৈরী করে তাঁদের সবাইকে সারিয়ে তুলল । এমন কাজের পরে তাকে লেখাপড়া করার অনুমতি আর বদ্যি হওয়ার শিক্ষা দিতে পাঠানো ছাড়া আর উপায়ই বা কী থাকে? তাই পুণ্যিকে সঙ্গে নিয়ে জয়াবতী চলে গেল তিনটে গ্রাম পেরিয়ে সোনাটিকরিতে — বিখ্যাত বৈদ্য দীননাথ সেনের কাছে থেকে চিকিৎসাবিদ্যা শিখতে।
সোনাটিকরিতে জয়াবতী শুধু চিকিৎসাবিদ্যাই শিখল না। সেন মহাশয়ের আদরে-শাসনে এবং সহযোগিতায় পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শিখল ঘোড়ায় চড়া, লাঠি খেলা, আর কাজের প্রয়োজনে সুবিধাজনক পোষাক পরা। ক্রমে ক্রমে তার অনুশাসনে বাঁধা জীবনে পুণ্যি ছাড়াও বন্ধু হয়ে এল পেরজাপতি আর উমাশশী, আর পন্ডিত মশাইয়ের রোগা ছেলে পানু।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই পেল তার সাহস আর যুক্তিভরা বুদ্ধির পরিচয়। চোর ধরা থেকে শুরু করে সতীদাহপ্রথার বলি হতে চলা বালিকাকে উদ্ধার — এমন নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরে উঠল তার ঝুলি।
তৃষ্ণা বসাকের কলমে 'জয়াবতীর জয়যাত্রা' এক অন্যধারার অভিযানের গল্প। লেখিকার কথায়, 'আমাজনের জঙ্গলে বা আটলান্টিকে নয়, কুসংস্কার ভরা সমাজের বদ্ধ জলার ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে একটি মুক্তমনা মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলার দুঃসাহসিক এবং একইসঙ্গে মজার কাহিনি...'। সত্যিই তাই! এই ছোট্ট উপন্যাসের যেটা সবথেকে ভালো ব্যাপার সেটা এই যে, প্রধান চরিত্রে রয়েছে পাঁচটি উজ্জ্বল, বুদ্ধিমতী, গুণবতী মেয়ে। সমবয়সী একমাত্র ছেলে চরিত্র পানু বরং সবদিক থেকে তুলনায় অনেক সাদামাটা।
এই বইয়ের দ্বিতীয় ভালো ব্যাপার হল, ছোট্ট ছোট্ট ঘটনার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুসংস্কার এবং মেয়েদের জীবনযাত্রা নিয়ে জয়াবতীর প্রশ্ন তোলা এবং তার সহজ সমাধান দেওয়া। কখনও সেসব প্রশ্নের সমাধান দিয়েছেন সেন মহাশয়, কখনও বা তাঁর মা, কখনও জমিদারমশাই আর বেশিরভাগ সময়ে জয়াবতী নিজেই।
উনবিংশ শতক থেকে প্রচলিত ছোটদের জন্য এক ইংরেজি ছড়া ছিল এইরকমঃ
What are little boys made of?
What are little boys made of?
Snips and snails
And puppy-dogs’ tails,
That’s what little boys are made of.
What are little girls made of?
What are little girls made of?
Sugar and spice
And everything nice,
That’s what little girls are made of.
মানে ছোট্ট ছেলেরা জলে-জঙ্গলে ঘুরে দস্যিপনা করবে, আর ছোট্ট মেয়েরা হবে শান্তশিষ্ট, মন দিয়ে রান্না-বান্না-ঘরকন্না করবে । বাংলা ছোটদের ছড়াতেও থাকে তেমনি গল্প — ,মেয়েদের 'বর আসবে এখনই, নিয়ে যাবে তখনই'; তারা রাঁধবে, বাড়বে, পুকুরে জল তুলতে যাবে, চুল বাঁধবে, গান গেয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়াবে। আর খোকারা মাছ ধরতে যায়, কিংবা নৌকা চেপে বিদেশ পাড়ি দেয়। এমন ভাবনা কিন্তু আজকের দিনেও আমাদের সমাজের অনেকখানি জুড়ে রয়েছে। কিন্তু 'জয়াবতী' চরিত্রটি এইরকম ছকে বাঁধা থাকে না, বরং তার ক্ষেত্রে অনেক হিসেবই উলটো। সে যেমন মা'কে ঘরের কাজে সাহায্য করে, তেমনই বাইরের নানা সমস্যার সমাধান করতেও পেছপা হয় না। তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং কাজকর্মের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সমাজে প্রচলিত লিঙ্গবৈষম্য — ছেলেদের আর মেয়েদের মধ্যে তফাৎ করার যে অভ্যাসগুলি আমরা আজকের দিনেও দেখেও দেখি না — সেগুলির কথা সহজভাবে উঠে এসেছে।
আর ঠিক এই কারণেই, 'জয়াবতীর জয়যাত্রা' শুধুমাত্র ছোটদের জন্য আরও একটা অভিযানের বই নয়, বড়দেরও নিজেদের মনের গহীনে নতুন করে অভিযান চালানোর রসদ ও যোগাবে।
মহালয়ার সকালে সেনমহাশয়ের পরিবারের সঙ্গে তর্পণ করতে গিয়ে জীবনে প্রথমবার গঙ্গানদীকে দেখল জয়াবতী। বিশাল চওড়া গঙ্গানদীকে দেখার পরে কিশোরী জয়াবতী সিদ্ধান্ত নিল সে একদিন ঠিক তার পরিবারের সবাইকে আর তার বন্ধুদের নিয়ে সাগর দেখতে যাবে, কারণ সাগর তো নদীর থেকেও বড় — না দেখলে চলে? জয়াবতী কি শেষ অবধি শ্রীক্ষেত্র যেতে পেরেছিল, সাগর দেখতে পেয়েছিল সবাইকে নিয়ে? সেটা জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত 'জয়াবতীর জয়যাত্রা'। উপন্যাসটি অবশ্য আগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে 'জ্বলদর্চি' পত্রিকাতে। এই উপন্যাসটি পড়ে মনে যদি প্রশ্ন জাগে, কুসংস্কারে ভরা অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলায় এমন যুক্তিবাদী, সাহসী মেয়ের থাকা সম্ভব ছিল কি? কিংবা দীননাথ সেন বা জমিদারমশাইয়ের মত উদারমনস্ক পুরুষ, যাঁরা মেয়েদের সমান সুযোগ পাওয়ায় বিশ্বাস করতেন বা করতে শিখেছিলেন? তাহলে উত্তর হবে — এমন সব মানুষ যে ছিল/ ছিলেন না, তাই বা নিশ্চিত হওয়া যায় কীভাবে? আমাদের দুর্ভাগ্য, ইতিহাসে সর্বদাই ছেলেদের কথা যত লেখা হয়েছে — সেই তুলনায় মেয়েদের কথা, তাদের স্বপ্ন-আশা-ইচ্ছে-অনিচ্ছের-সুবিধা-অসুবিধার কথা তার সিকিভাগও লেখা হয়নি। তাই জয়াবতীর মত আলোয় ভরা মেয়েরাও যে গ্রামবাংলার কোণায় কোণায় ছিল, কেবল তাদের কথা কেউ লিখে বা বলে যায়নি — সে কথাই বরং আমরা মেনে নিই। শুধুমাত্র কিংবা প্রধানত মেয়েদের মূল চরিত্র করে ছোটদের জন্য বাংলায় লেখা অভিযান বা রহস্য রোমাঞ্চের গল্প একমাত্র নলিনী দাশের 'গোয়েন্দা গন্ডালু'-এর গোয়েন্দাগিরির গল্পগুলো ছাড়া আমরা আর পাইনি বলেই জানি। তাই জয়াবতী এবং তার বন্ধুরা যদি আগামী দিনে আরও নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার খোঁজে আবার ঘোড়া আর পালকি চড়ে বেরিয়ে পড়ে, তাহলে আমার তো খুবই ভালো লাগবে।
বইটির মনোরম প্রচ্ছদটি এঁকেছেন পার্থপ্রতিম দাস। খুব সামান্য কিছু মুদ্রনপ্রমাদ আছে, পরবর্তী সংস্করণে সেগুলি ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে।
বইঃ জয়াবতীর জয়যাত্রা
রচনাঃ তৃষ্ণা বসাক
প্রচ্ছদঃ পার্থপ্রতিম দাস
প্রকাশকঃ সৃষ্টিসুখ
মূল্যঃ ১৮০/-