সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আমাদের পৃথিবী মায়ের খুব অসুখ। খুব জ্বর হয়েছে মনে হয়। গা একেবারে তেতে-পুড়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হওয়ার লক্ষনটি পর্যন্ত নেই। পন্ডিতেরা বলছেন, এ অসুখ সারার নয়। যত দিন যাবে ততই বাড়তে থাকবে। বলছেন, যা অত্যাচার চালাও মায়ের ওপরে, তার আর কি দোষ- আর কতই বা সহ্য করতে পারে সে? একদিন না একদিন তো অসুস্থ হবেই। আর এই অসুখ কোন ওষুধে সারার নয়। ওই ডাক্তার এসে লিখে দিল, দুটো ট্যাবলেট জল দিয়ে টক করে গিলে ফেললাম, আর পরের দিন জ্বর ছেড়ে খেলার মাঠে দৌড় দিলাম, এ সেরকম ব্যাপার নয়। এই অসুখের ওষুধ একটাই- সবাই মিলে যত্ন করে, আদর করে এইটুকুই ব্যবস্থা করা, যাতে মায়ের শরীর আরো বেশি খারাপ না হয়ে যায়। যাতে তার ক্ষতগুলি ধীরে ধীরে সেরে ওঠে। যাতে তার শরীরের তাপমাত্রা আরো না বাড়ে। যাতে মা বেঁচে থাকে, সুস্থ থাকে। যাতে মায়ের সাথে সাথে আমরা, মায়ের সন্তানেরাও বেঁচে থাকি।


৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতি বছর আমাদেরকে পরিবেশ সম্পর্কে, প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন করে সচেতন করিয়ে দেয় এই দিন। পৃথিবীর সমস্ত দেশেই নানাভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশ সচেতনতা নিয়ে নানান অনুষ্ঠান হয় এই দিনে। আজকের দিনে, সারা বিশ্বের সমস্ত দেশগুলিই পরিবেশ-জলবায়ু-আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে নানারকমের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সারা পৃথিবী জুড়েই উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। অনেক বেশি গরম দিন বা গরম রাতেই ক্ষান্তি নেই, গরম হাওয়ার পরিমাণও অনেক বেড়ে গেছে। আবার অন্যদিকে, পৃথিবীর যে সমস্ত অংশ জুড়ে মাটি, সেখানে বৃষ্টি এবং তুষারপাতের পরিমাণও আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, একই সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে খরা হওয়ার প্রবণতাও বেড়ে গেছে অনেক বেশি। এর কারণ কি জান? এর কারণ হল, উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে সমুদ্রের জল অনেক বেশি বাষ্পে পরিণত হচ্ছে। ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বৃষ্টি বা তুষারপাত বেশি হচ্ছে। আবার অন্যদিকে, উষ্ণতা বেশি হওয়ার কারণে মাটির আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে, ফলে বৃষ্টি কম হলেই খরার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।


উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সুমেরু এবং কুমেরু অঞ্চলের জমাট বাঁধা বরফ, এবং অন্যান্য অঞ্চলের হিমবাহগুলি ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে সুমেরু সাগরে গ্রীষ্মকালে বরফের পরিমাণ খুব বেশিরকম কমে যাবে; আর ২০৪০ সালের মধ্যে সুমেরু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে আর বরফ দেখা নাও যেতে পারে। এর ফলে সুমেরু অঞ্চলে বসবাসকারী প্রাণী যেমন পোলার ভালুক, অবলুপ্তির পথে চলে যেতে পারে। আবার অন্যদিকে গ্রীনল্যান্ড, আন্টার্কটিকা- এইসব অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধি করছে। এইভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে যে সমস্ত শহর -জনপদ সমুদ্রের ধারে গড়ে উঠেছে, যেমন নিউ ইয়র্ক বা মুম্বই, সেগুলির অনেক অংশ বা পুরোটাই জলের তলায় চলে যেতে পারে।


উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই বদল হচ্ছে জলবায়ুর; প্রাণী এবং উদ্ভিদ সাম্রাজ্যেও দেখা যাচ্ছে নানাধরণের পরিবর্তন। পরিবর্তন হচ্ছে শস্য ফলনের সময়, উৎপাদনের পরিস্থিতি। এমনও হতে পারে, আর কিছুদিন পরে অনেক শস্য উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে শুধুমাত্র তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য। গত এক দশকে, শুধুমাত্র প্রচন্ড গরম এবং খরার ফলে কানাডা, আলাস্কা, এবং রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে দাবানল হয়ে বিস্তৃত বনভূমি পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। এত গাছ পোড়ার ফলে ওই সব অঞ্চলে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।


এদিকে ঠাণ্ডা আবহাওয়ার খোঁজে, অনেক পশু, পাখি এবং পোকামাকড়, এমনকি গাছপালাও ক্রমশঃ উত্তরের দিকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন দেশের শীতল অঞ্চলগুলিতে নানাধরণের প্রাণী এবং গাছপালা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যেগুলি আগে দেখা যেত না। এইভাবে জীবনযুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করতে থাকা বেশ কিছু প্রজাতির প্রাণী খুব তাড়াতাড়ি একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, তুষারপাত এবং বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রোগবাহী পোকা এবং মশার উপদ্রব ক্রমশঃ বেড়ে যাচ্ছে। সেই কারণে পৃথিবীর যেসব জায়গায় মশার প্রকোপ বেশি, সেখানে ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গুর মত রোগ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।


সমুদ্রতলের প্রাণও স্বস্তিতে নেই। বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড-এর মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে সমুদ্রের জলের রাসায়নিক গঠন পালটে যাচ্ছে। আর এমনিতেই সমুদ্রের জলের তাপমাত্রাও বেড়ে গেছে। এর ফলে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্রের তলায় থাকা প্রবালেরা। অনেক ধরনের প্রবাল এর মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বা অসুস্থ হতে শুরু করেছে।


এইরকম পরিস্থিতিতে, সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষজন, বিশেষত দেশনেতারা কি ধরণের ভাবনা চিন্তা করছেন?


সারা পৃথিবী জুড়ে যে ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলি সমুদ্রের বুকে ছড়িয়ে আছে, তাদের অবস্থা এই মূহুর্তে খুবই সঙ্কটজনক। সুমেরু ও কুমেরু অঞ্চলের বরফের স্তর ধীরে ধীরে গলতে শুরু করেছে। ক্রমশঃ একটু একটু করে বেড়ে উঠছে সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা। এর সাথে যোগ কর বায়ু এবং জল দূষণ, আবর্জনা বৃদ্ধি, ভাবনা চিন্তা না করে সমুদ্রের রসদ নষ্ট করা, পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। এই ভাবে আগামি কয়েক দশকের মধ্যেই হয়ত আমাদের চোখের সামনেই হারিয়ে যেতে পারে একটা গোটা দেশ। তার সাথে হারিয়ে যেতে পারে তার সভ্যতা-সংস্কৃতি- ইতিহাস- অর্থনীতি। এক মূহুর্তে জলের নিচে তলিয়ে যেতে পারে তার যত প্রগতির চিহ্ন। এই ধরণের সমস্যার মুখে পড়তে পারে পলিনেশিয়ার ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্র নাউরু বা নিউই, বা ভারত মহাসাগরের মাদাগাস্কার এবং মলডাইভ্‌স্‌ দ্বীপপুঞ্জ। এই কারণেই, রাষ্ট্রসঙ্ঘের (ইউনাইটেড নেশ্‌ন্‌স্‌) জেনারেল অ্যাসেম্বলি ২০১৪ সালকে ঘোষণা করেছে International Year of Small Island Developing States (SIDS), বা ক্ষুদ্র উন্নতিশীল দ্বীপ রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বছর হিসাবে। এই সারাটা বছর ধরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলি চেষ্টা করে যাবেন এই ধরণের ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলির প্রকৃতি পরিবেশের বিভিন্ন সমস্যাগুলির সমাধান এবং সুরাহা করার।


এছাড়া এই বছর, ২৩-২৭শে জুন, নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রথম পরিবেশ নিয়ে সম্মেলন (UN Environment Assembly) । এই সম্মেলনে যোগ দেবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী এবং নেতারা। এই সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়গুলি হবে বন্যপ্রাণীদের নিয়ে বেআইনী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা, এবং পরিবেশের স্থিতাবস্থা বজায় রেখে চাষ-বাস ও খাদ্য উৎপাদন ।এছাড়া মারাত্মক রাসায়নিক বর্জন করা, এবং চোরাশিকারের মত বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হবে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থেকে প্রায় ১২০০ সদস্য এই সম্মেলনে যোগ দেবেন।


কিন্তু এতো গেল অনেক বড় মাপের কাজকর্মের কথা। সার্বিকভাবে পৃথিবীর পরিবেশ, সম্পদ, অর্থনীতির উন্নয়নের কথা। কিন্তু তুমি, আমি, যারা এইরকম গুরুগম্ভীর আলোচনাসভায় যাচ্ছি না, স্কুল, পড়াশোনা, অন্যান্য কাজের চাপে আর আলাদা করে পৃথিবীর কথা, পরিবেশের কথা ভাবার সময় পাই না, আমরা কি কিছুই করতে পারি না আমাদের পৃথিবী মায়ের জন্য? নিজেদের মত করে, ছোট করে? সেই যে কথায় বলে -
"ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল
গড়ে তোলে মহাদেশ , সাগর অতল"
-হ্যাঁ, ঠিক তাই। এই বিরাট পৃথিবীতে বসবাস করে যে জনসমুদ্র, আমরা প্রত্যেকে তার একটা করে বিন্দু, তাই নয় কি? আর আমরা প্রত্যেকেই একটু করে , নিজের মত করে, চেষ্টা করতে পারি।কি কি ভাবে আমরা পৃথিবীমাকে একটু শীতল , একটু সুস্থ রাখতে পারি, সেই নিয়ে নানা জায়গায় নানাধরণের লেখা পড়তে পাবে। তোমার স্কুলেও নিশ্চয় এই বিষয়ে নানা আলোচনা হয়। তাই সেই বিষয়ে আর বিস্তারিত বলতে চাই না। আমি নিজে কি কি করি, সেটাই বরং তোমাকে বলিঃ

১। আমি রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার সময়ে যদি কোন খাবার খাই, তাহলে তার মোড়ক বা প্যাকেট সবসময়ে কোন নির্দিষ্ট ডাস্টবিন, বা ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলি। যদি সেরকম কিছু খুঁজে না পাই, তাহলে সেই ঠোঙা বা প্যাকেট ভাঁজ করে নিজের ব্যাগে ভরে নি। বাড়িতে এসে, বাড়ির ডাস্টবিনে ফেলে দি। এইভাবে আমি চেষ্টা করি পরিবেশকে নোংরা না করতে।
২। বাড়িতে প্রয়োজন না থাকলে ঘরের আলো বা পাখা জ্বেলে রাখি না। এতে শুধু আমার বিদ্যুতের বিল কম আসে তাই না, একটু হলেও আমি আমার পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখতে পারি।
৩। আমি আমার বাড়ির বারান্দাতে টবে গাছ পুঁতেছি। এই গাছগুলি শুধু আমার বন্ধু নয়, এরা আমাকে আমার অক্সিজেনের যোগান দেয়। বদলে আমার শরীর থেকে বের হওয়া ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে নিজেদের খাদ্য তৈরি করে।
৪। আমি খাবার নষ্ট করি না। রেস্তোরাঁ বা নেমন্তন্ন বাড়িতে চেষ্টা করি যেটুকু খেতে পারব, সেটুকুই খাবার নিতে। আজকের পৃথিবীতে এত যে পরিবেশে ভারসাম্যের অভাব, বনের বা সমুদ্রের প্রাণীদের জীবন বিপন্ন, এমনকি মানুষে মানুষে যুদ্ধ-হানাহানি- সে সমস্ত কিছুর জন্য অনেকটাই দায়ী মানুষের পেটের খিদে। তাই সবার জন্য যথেষ্ট খাবার যোগান দেওয়াই শুধু নয়, সেই খাবার যেন নষ্ট না হয়, সেইদিকেও সবার লক্ষ্য থাকা উচিত।


একটু আগে যে নাইরোবিতে হতে চলা যে প্রথম পরিবেশ সম্মেলনের কথা বলেছি, সেই সম্মেলনের স্লোগান হল- A Life of Dignity for All - সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ জীবন। সেই মর্যাদাপূর্ণ জীবনের ধারণা শুধু কাগজে-দলিলে ছাপার অক্ষরে না রেখে, এবার হাতে-কলমে করে দেখাবার সময় এসেছে। একটা মর্যাদাপূর্ণ, সুস্থ, সুদীর্ঘ জীবনের অধিকার সবার থাকা উচিত- প্রতিটা মানুষের, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা প্রাণী, এবং স্বয়ং পৃথিবীর, তাই না?

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা