প্ল্যানটা অনেকদিন থেকেই করা হচ্ছিল। শুধু বাস্তবায়িত হয়নি বাবার অফিস আর দাদুর অসুস্থতার জন্য।
সেদিন সন্ধ্যেয় নির্মলকাকু এসেছিলেন আমাদের বাড়ি । নির্মল কাকু বাবার ছোটবেলার বন্ধু। আগে কর্মসূত্রে সিমলায় থাকতেন। সম্প্রতি কলকাতায় বদলি হয়েছেন।
জোরদার চলছিল আড্ডা । সে ফাঁকে বাবা জিজ্ঞেস করলেন- 'নিলু সিমলায় তোর একটা বাংলো আছে না ?'
-'হ্যাঁ রে। ওটা পড়েই আছে। একজন কেয়ারটেকার আছে যদিও।'
কথাটা শুনে বাবা মায়ের দিকে তাকালেন । মা ইশারায় সম্মতি দিলেন।
-' আসলে আমরা কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম পাহাড়ে যাব কিন্তু বাবার শরীর তো জানিসই ! আর সেই সঙ্গে এই হয়েছে আমার অফিস...কাজের ঠ্যালায় জীবন অন্ধকার।'
বাবার কথায় উৎসাহিত হয়ে নির্মলকাকু বললেন-' হ্যাঁ যা না। আরে ভাই একসপ্তাহের ছুটি নিলে কিচ্ছু হবে না। আমার বাংলোটা তো আছেই। কাকাবাবু আরামসে থাকতে পারবেন।'
নির্মলকাকুর প্রস্তাবটা সর্ব সম্মতে গৃহীত হল। ঠিক হল আগামি ২৩ শে ডিসেম্বর আমরা রওনা দেব। ওই মাঝে ক্রিসমাসের ছুটিটা পাওয়া যাবে তাই আর কী ।
যাওয়ার আগেরদিন সারারাত উত্তেজনায় আমার ঘুম হল না। এই প্রথম পাহাড়ে যাচ্ছি আমি, তাই হয়ত।
দমদম এয়ারপোর্ট থেকে শুরু হল আমাদের যাত্রা । প্রথমে ঠিক ছিল কালকা - সিমলা রেলওয়েতেই হবে ভ্রমণ কিন্তু দাদুর অসুস্থতার কথা ভেবেই বাবা ফ্লাইটেরই টিকিট কাটলেন।
একে সিমলা তারপর প্রথম প্লেন চাপার অভিজ্ঞতা -এ যেন রথ দেখা আর কলা বেচা একসাথে !
যাই হোক প্রথমে কলকাতা থেকে দিল্লি তারপর দিল্লি থেকে সিমলা এসে পৌঁছালাম আমরা। তখন প্রায় দুপুর দু'টো বাজে।
আহা ! কী অপূর্ব এই সিমলা রানী! দাদুর কাছে শুনেছিলাম দেবী শ্যামলার নামেই নাকি এই জায়গাটির নাম সিমলা । ডালহৌসির আমলে সরকারি কাজকর্ম এখান থেকেই হত।
একে ডিসেম্বর মাস তার উপর পাহাড়ি এলাকা। মা বললেন,' তুতুল গলাটা ঢাকা দাও ভালো করে।'
নির্মলকাকুর বাংলোটা বেশ। পাহাড়ের কোলে ।
বাবা কেয়ারটেকারটিকে জিজ্ঞেস করলেন, -' কুছ খানা মিলেগা কেয়া?'
-'জি স্যার,'
মিনিট পনেরো বাদে এল খাবার। সিমলার স্পেশাল ডিশ- পাতরে আর খরু। দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। খিদেও পেয়েছিল খুব তাই গোগ্রাসে পুরোটা সাবাড় করে দিলাম।
এদিকে আবার এতটা পথ এসে দাদুর শরীরটা একটু খারাপ হয়ে পড়ল । বিকেলে মা বাবা কে বললেন-' তুমি তুতুলকে নিয়ে একটু ঘুরে এস। আমি বরং বাবার কাছেই থাকি।'
আমি আর বাবা বেড়িয়ে পড়লাম । আমাদের বাংলোটা ছিল নিউ সিমলায় । কী অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা, যেন ভারতবর্ষের বুকে একটুকরো স্বর্গ । বাবা একজন টুরিস্ট গাইডের সাথে কথা বলে রাখলেন।
-'তুতুল আজ চল । তোমার দাদুর শরীরটা খারাপ। কাল বেড়াব '। ইচ্ছে ছিল না তাও ফিরে যেতে হল।
পরদিন সকাল থেকে শুরু হল শৈল শহর ভ্রমন। চারিদিকে পাহাড়ের প্রাচীর । আর মাঝে মাঝে রয়েছে সবুজের ছোঁয়া । কোথাও কোথাও উঁকি মারছে হিমাচলি রোদ্দুর ।
কোথাও আবার শ্বেতশুভ্র বরফের চাদর। মুক্তোর বিন্দুর মত শিশির এসে জমা হয়েছে পাহাড়ের গায়ে। চোখ আটকে যাবার মতই ছবি।
গাইড আমাদের প্রথমেই নিয়ে গেলেন জাখু পাহাড় দেখাতে । এটা নাকি সিমলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ । আহা ! একেবারে যেন হীরের মুকুটে সেজেছে জাখু রানি, সাদা বরফে ঢাকা !
গাইড আমাদের জানালেন এটি ধর্মীয় কারণে প্রসিদ্ধ । কথিত আছে হনুমানজি নাকি সঞ্জীবনী ঔষধি আনার পথে এই পাহাড়েই বিশ্রাম করেছিলেন। তাই জাখু নামের একটা মন্দিরও আছে সেখানে।দাদু খুব খুশি হলেন।
খুব খিদে পেয়েছিল আমার। সবাই মিলে চা আর প্যাটিস খেলাম। বেশ খেতে এখানকার ধাবার চা। শরীর একটু গরম হতেই আমরা আবার রওনা দিলাম।
এবার লক্ষ্য সিমলা ম্যল। বাজারঘাট, হোটেল, দোকান , রেস্তোরাঁয় গিজগিজ করছে গোটা এলাকা। মা তো মনের আনন্দে একটা পাত্তো কিনেই নিলেন। পাত্তো হল এই অঞ্চলের মহিলাদের সাবেকী পোশাক ।
ফিরলাম যখন প্রায় তিনটে বাজে। বেশ কর্মী ছেলে কেয়ারটেকারটি। দেখলাম আগে থেকেই জল গরম করে রেখেছে। সবাই মিলে গিয়ে একটু ফ্রেশ হতেই নিয়ে এল ভাত আর মুরগির ঝোল ।
সেদিন সন্ধেবেলায় আর বেরোলাম না। তাছাড়া এখানে ঠান্ডার জন্য খুব তাড়াতাড়ি জায়গাটা শুনশান হয়ে যায় ।
পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক পরদিন আমরা গেলাম কুফরি হিল স্টেশন । চোখ ধাঁধানো পাহাড় আর মাকড়সার জালের মত কুয়াশা । আবার ঘন সবুজের চাদর । মন ভরে গেল।
সেখানে একটা সুন্দর পার্কও আছে। কত ধরনের পশু পাখির মেলা সেখানে ! আহা ! একটা জায়গায় দেখলাম কিছু লোকজনের ভিড় । গাইডকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল এখন নাকি আইস স্কেটিং কার্নিভাল চলছে ।
আইস স্কেটিং কার্নিভাল মানে মোদ্দা কথায় যেটা হল বরফ ছোঁড়াছুড়ি খেলা। আমরাও সপরিবারে যোগ দিলাম সেই খেলায়। দাদুর অসুস্থতাও যেন কোথায় উবে গেল আনন্দে !
আমি আবার বায়না জুড়লাম টয়ট্রেন চাপব। বাবা সেইমত ব্যবস্থা করলেন । টয় ট্রেন থেকে সিমলার সবুজ চাদরটিকে যেন আরও সবুজ মনে হল।
দাদুর ইচ্ছে ছিল মানালি যাবে। মানালি সিমলা থেকে প্রায় সাত ঘন্টার রাস্তা। পরেরদিন আমরা রওনা দিলাম মানালি। সিমলা থেকে মানালি যেতে পথে মন কাড়ল প্রাকৃতিক শোভা ।
দুদিকে রয়েছে বড় বড় গাছের সারি আর তারই মাঝে নীল রঙ।
মানালিতে এসে পৌঁছালাম তখন দুপুর বারোটা বেজে গেছে। অপরূপা রাজকুমারী মানালি- কোথাও শ্বেতশুভ্র বরফ, কোথাও জল্প্রপাত। কোথাও বা নুড়ি পাথরের মেলা। দাদু খুব উল্লসিত।
কিন্তু এই উল্লাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। হটাত দাদুর বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গেল। মা বাবা খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন । এত ধকল বোধহয় দাদুর শরীর আর সহ্য করতে পারছে না।
গাইডের কথায় আমরা দাদুকে নিয়ে গেলাম একটা কাঠের কুটিরে। কোন এক আদিবাসী সম্প্রদায় থাকে সেখানে। তারা না বুঝল আমাদের ভাষা আর আমরা না বুঝলাম তাদের ভাষা।
তবুও ইশারায় আর গাইডের মাধ্যমে চলল কথাপকথন । বাড়িটিতে অনেক মানুষ । সবাই ইশারায় বলল ভিতরে আসতে । আমরা দাদুকে নিয়ে গেলাম ভিতরে।
কিছুক্ষণ পর জড়িবুটি নিয়ে এলেন এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা। দাদুকে খাওয়াবে্ন । মা বাবার দিকে তাকালেন ঘোরতর আপত্তিতে। মহিলাটি ইশারায় বোঝালেন এটা ওঁদের ঘরোয়া টোটকা । দাদুকে খাওয়ানো হল ওটা ।
ঠিক ছিল দাদু একটু সুস্থ হলেই আমরা এখানকার কোন একটা হোটেলে চলে যাব । কিন্তু বিকেলে শুরু হল প্রবল তুষার ঝড় । দাদুর গায়ে জ্বরও এল।
এই অবস্থায় সেই পরিবারের আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
দাদুকে ওঁরা নিজেদের ভাষায় 'বাবা' বলে ডাকছিলেন। বাড়ির মহিলারা খুব সেবা করলেন দাদুর। গরম কাপড়ে ঢেকে রাখলেন।
কথায় কথায় গাইডের কাছে জানতে পারলাম ওঁরা নাকি মানালির এক উপজাতি। এখানে আপেল জমিতে চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন।
রাত্রে কিছু বাচ্চা ছেলে আমার হাত ধরে টানাটানি করছিল। ওদের আবদার ওদের সাথে খেলতে হবে। আমি মায়ের দিকে তাকালাম। মা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন।
ওরা আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে আমি অবাক। কত ধরনের হাতের কাজ ! একটা বছর দশেকের ছেলে পাতা দিয়ে মাঝখানে মাঝখানে কাঠি সেঁটে বানানো একটা মূর্তি দেখাল। খুব অবাক হলাম এসব দেখে। কত প্রতিভা লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের কোণায় কোণায়-হয়ত বেশিরভাগই অজানা।
তিনটে বাচ্চা মেয়ে আমাকে নাচ দেখাল। এই নাচটা আমি আগেও দেখেছিলাম ইউটিউবে। বাবা বলেছিলেন এটাকে বলে বিরষু - নিরষু নাচ। এখানে নাকি খুব জনপ্রিয়।
ওদের আতিথিয়তা আর ভালবাসা মন ছুঁয়ে গেল। দাদুও এখন অনেকটাই সুস্থ।
এবার যাবার পালা। ডাক্তার কাকু বাবাকে ফোনে বলেছে দাদুকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কলকাতা ফিরে যেতে । তাই মানালি দেখা আর হল না।
ফেরার সময় ওদের সবার চোখে জল। ঝাপসা হয়েছে বাবার চোখও । অচেনা, অপরিচিত মানুষদেরও যে এত সহজে আপন করা যায় ওদের না দেখলে বুঝতাম না।
এগিয়ে এলেন সেই ভদ্রমহিলাটি যিনি দাদুকে জড়িবুটি খাইয়েছিল। দাদুর হাতের উপর হাত রেখে বোঝাল 'আবার আসবেন।' উত্তরে শুধু দাদুর দু ফোঁটা চোখের জল গিয়ে পড়ল মহিলাটির হাতে।
আজ প্রায় একমাস হল ফিরেছি কলকাতায়। কিন্তু তাও সেইদিনের সেই ক্যানভাসটা আজও টাঙানো আছে মনের দেওয়ালে -অতি সযত্নে ।
কে বলে দুনিয়ায় ভালোবাসা নেই ! ভালো করে খুঁজে দেখলে পাহাড়ের ভাঁজেও মেলে ভালোবাসা !
ছবিঃ পিক্সাবে