শিকারের কথা বললেই মনে আসে বাঘ, সিংহ, হাতি বা চিতা বাঘ শিকারের কথা। আর শিকারির কথা উঠলে প্রথম যে নামটা মনে আসে সেটি হল জিম করবেট- এর নাম। জিম করবেট শুধু ভারতবর্ষ নয় সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় শিকারি ছিলেন। কেন? ওঁর শিকার কাহিনি নানান বইতে লিখে রেখে গেছেন। যেমন, দুটি বই হল 'রুদ্রপ্রয়াগের চিতা' ও 'জাঙ্গল লোর'। এই ধরনের অনেক অনেক বই লিখেছেন, প্রতিটি বইতে প্রকাশ পেয়েছে বন্য প্রাণীর প্রতি ওঁর ভালোবাসা। অপ্রয়োজনে শিকার করতেন না। অনেক বাঘ এবং চিতাবাঘ শিকার করেছেন, ভারতবর্ষের মাটিতেই শিকার করেছেন, কিন্তু সেগুলো প্রয়োজনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঘ আর চিতাবাঘগুলো নরখাদক হয়ে গিয়েছিল এবং মানুষ মারতে শুরু করে দিয়েছিল। মানুষের কথা ভেবে বিশেষত পাহাড়ি মানুষদের কথা ভেবে উনি সেই সব বাঘ এবং চিতাবাঘ শিকার করেছেন। উনি নিজের প্রয়োজনের জন্য যতোটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই শিকার করতেন। ওঁর বইতে আছে এ রকমই একটি গল্প যেখানে উনি মাছ শিকার করতে গিয়ে বঁড়শি দিয়ে মাছ শিকার করলেন কিন্তু একটি মাছ শিকার করার পর দ্বিতীয় আরেকটি মাছ আর শিকার করলেন না, যদিও ওখানে অজস্র মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কারণ, খিদে মেটানোর জন্য একটি মাছই যথেষ্ট। এরকমই ছিল তাঁর চরিত্র।
এই মুহূর্তে, আমি যে শিকারের গল্প বলবো সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য শিকার। সেখানে রয়েছে থ্রিল। সব সম্পূর্ণ সত্যি ঘটনা। এই শিকারিরা একেকজন রহস্যভেদী গোয়েন্দা। তাহলে শুরু করা যাক সেই গল্প।
স্থান মঙ্গোলিয়ার গোবি মরুভূমির এক বিস্তীর্ণ প্রস্তরময় অঞ্চল। সময় ১৯৭১ সাল। একদল শিকারি শিকারের খোঁজে এখানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে কিন্তু বন্দুক পিস্তল নেই। তার জায়গায় রয়েছে নানারকম হাতুড়ি, ছেনি, কোদাল, বেলচা থেকে শুরু করে ঝাঁটা পর্যন্ত। সঙ্গে গাড়িতে শিকারকে বন্দী করার জন্য বড়ো বড়ো ক্রেট। এঁরা ডাইনোসর শিকারি অর্থাৎ পুরাজীববিজ্ঞানী। ইংরেজিতে প্যালিয়েন্টোলজিস্ট। আসলে এঁরা প্যালিয়েন্টোলজিস্ট ঠিকই, কিন্তু ভার্টিব্রেট প্যালিয়েন্টোলজিস্ট। মেরুদন্ডী প্রাণীর ফসিল, যেমন ডাইনোসরের ফসিল যাঁরা খুঁজে বেড়ায় শিকারের জন্য তাদেরকে ভার্টিব্রেট প্যালিয়েন্টোলজিস্ট বলা হয়। হঠাৎই তাঁরা সেই জায়গায় দেখলেন পাথরের উপরের স্তর ক্ষয়ে গিয়ে তার নিচের ক্রিটেশিয়াস যুগের পাথরের স্তর অর্থাৎ ৮ থেকে ১০ কোটি বছর আগেকার পাথরের স্তর উন্মুক্ত হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তাতে কোন ফসিলের অল্প খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। শিকারিরা তাঁদের ইপ্সিত শিকার খুঁজে পেয়ে উল্লসিত হয়ে উঠলেন।
এই গল্পের শুরু বহু কোটি বছর আগে, ধরা যাক ৮ থেকে ১০ কোটি বছর আগে। এখন মঙ্গোলিয়া যেখানে রয়েছে তার বেশ কিছু অংশ জুড়ে সেই সময় বিস্তীর্ণ মরুভূমি অঞ্চল ছিল। মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যানও ছিল এখনকার মতই। এখানে ছোট আকৃতির এক ধরনের তৃণভোজী ডাইনোসর থাকতো। এদের নাম প্রোটোসেরাটপ (Protoceratop)। এরা এখনকার দিনের ভেড়াদের মতোই দলবেঁধে ঘুরে বেড়াত। এদের প্রধান শত্রু ছিল ওদের থেকেও বড়ো মাপের একদল ভীষণ হিংস্র মাংসাশী ডাইনোসর যারা শিকারি বুনো কুকুরের মতই দলবেঁধে ঘুরত। এদের নাম ছিল ভেলোসির্যাপ্টর (Velociraptor)। এই ভেলোসির্যাপ্টর দের কাণ্ডকারখানা স্পিলবার্গের 'জুরাসিক পার্ক' , 'দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড- জুরাসিক পার্ক' , 'জুরাসিক পার্ক-থ্রি' বা অতিসম্প্রতি রিলিজ্ করা সিনেমা 'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড' এবং তার পরবর্তী খন্ড আগের বছরে রিলিজ্ করা সিনেমা 'জুরাসিক ওয়ার্ল্ড –দা ফলেন কিংডম', সব সিনেমাতেই পরিষ্কার ভাবে দেখানো হয়েছে। এরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ডাইনোসর ছিল।
মরুভূমি অঞ্চলে খাদ্যভাণ্ডার কখনোই অফুরন্ত নয়। তাই, একটি ভেলোসির্যাপ্টর খাদ্যের জন্য ইতি উতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল হয়তো কিছুটা স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবেই। কারন সে বেশ কিছুদিন ধরেই প্রায় না খেয়েই আছে। শিকার জোটে নি। হঠাৎই দূরে একটা প্রোটোসেরাটপকে দেখতে পেল। যথেষ্টই লোভনীয় খাবার। তাই দ্রুত ধেয়ে গেল শিকারের দিকে। প্রোটোসেরাটপও বিপদ বুঝে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা! আগেই বলেছি ভেলোসির্যাপ্টর ডাইনোসরের মধ্যে বুদ্ধিমান প্রাণীদের একজন। ও জানে কী করে শিকারকে কব্জা করা সোজা। তাই খুব একটা অসুবিধা হলো না - ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রোটোসেরাটপের উপর। প্রোটোসেরাটপটি আত্মরক্ষার জন্য সরে গিয়ে কামড়ে ধরল ভেলোসিরেপটরের পিছনের একটি পা। তারপর? দুর্দৈব!
বিজ্ঞানীরা পাথরের মধ্যে বহুকষ্টে দীর্ঘদিন চেষ্টার পর ধীরে ধীরে ফসিল উদ্ধারে সমর্থ হলেন। দেখলেন বেলেপাথরের স্তরে দুটি ডাইনোসরের ফসিল রয়েছে একটি ভেলোসির্যাপ্টর আর অপরটি প্রোটোসেরাটপ। প্রোটোসেরাটপটি ভেলোসিরেপটরের পিছনের পা কামড়ে রয়েছে আর ওই অবস্থাতেই তাদের হঠাৎ মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে হঠাৎ করে দুজনের মৃত্যু! শুধু তাই নয়, তারপর ঐ অবস্থাতেই তাদের ফসিলে রূপান্তরিত হওয়া! কোনো রকম ভাবে কোনো হাড় ভেঙে ছিটকে দূরে সরে যায় নি! তাই বা কী করে হয়! সাধারণত, মেরুদন্ডী প্রাণীদের আস্ত কঙ্কালের জীবাশ্ম একদমই পাওয়া যায় না, ভাঙাচোরা অবস্থায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাওয়া যায়। এখানে শুধু একটি প্রাণীর পূর্ণ কঙ্কালের ফসিল নয়, দু-দুটো ডাইনোসরের পূর্ণ কঙ্কালের ফসিল, যার মধ্যে একটি অপরটির পিছনের পা কামড়ে রয়েছে এবং সেই অবস্থাতেই তারা ফসিলাইজড্ হয়েছে! বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলল। তাঁরা কারণ অনুসন্ধান শুরু করলেন।
শিল্পীর কল্পনায় ভেলোসির্যাপ্টর আর প্রোটোসেরাটপের যুদ্ধ
বিজ্ঞানীরা এই রহস্যের জট খুলবার চেষ্টা শুরু করলেন। আসলে ওঁরা অনেকটা ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলুদা, শার্লক হোমস বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দাদের মতো। ওঁদের এমন কিছু এধরনের রহস্য উদঘাটনে নজির রয়েছে যা শুনলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বাঘা বাঘা গোয়েন্দারাও হতবাক হয়ে যাবেন। শুরু হলো সূত্র-সন্ধান; বালি পাথরের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের গঠন এবং সেই সময়কার ওই অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জলবায়ু সম্বন্ধে তাঁদের সঠিক ধারণা এই ব্যাপারে কাজে এল। শেষ অবধি বিভিন্ন সূত্র থেকে এই রহস্য উদঘাটিত হল।
ভেলোসির্যাপ্টর টি প্রোটোসেরাটপকে আক্রমণ করতেই প্রোটোসেরাটপ ঘুরে গেল। চেহারা ছোট হলেও বেশ গাট্টা গোট্টা চেহারা হওয়ায় চেষ্টা করল ছাড়িয়ে নিতে। তারপর দুই শিকারি ও শিকার যখন আক্রমণ ও আত্মরক্ষার চেষ্টায় মগ্ন, তখন হঠাৎ আত্মরক্ষার জন্য প্রোটোসেরাটপটি ভেলোসিরেপটরের পিছনের পা কামড়ে ধরল। ঠিক সেই সময়ই শুরু হলো মরু অঞ্চলের বালির ঝড়। সেই মরুঝড়ের সাংঘাতিক প্রকোপ কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে এখনকার দিনের মরুঝড় দেখলে। কিছু বোঝার আগেই, দুজনের দেহই ঢাকা পড়ে গেল বালিতে। ওই অবস্থাতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু হল একই সঙ্গে দুজনের। তাই, বহু কোটি বছর বাদে, অবিকৃত অবস্থায় ফসিল হিসাবে কিছু ডাইনোসর শিকারি তাদেরকে শিকার হিসেবে তাঁদের ক্রেটে বন্দী করতে সমর্থ হলেন।
উপরের গল্পটি কিন্তু বানানো গল্প নয়, আদ্যোপান্ত সত্যি ঘটনা। বিজ্ঞানী লুই সিহয়োস-এর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ফসিলটি থাকলেও পরবর্তীকালে সেটিকে উনি আমেরিকান মিউজিয়াম অফ্ ন্যাচারাল হিস্ট্রিকে দিয়ে দেন। বর্তমানে সেটি আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির সম্পত্তি। পৃথিবীতে যত অ্যামেজিং ফসিল বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন তাদের মধ্যে থেকে সেরা ১০ টি কে বিজ্ঞানীরা নির্বাচিত করেছেন। এই নির্বাচিত আমেজিং ফসিলের মধ্যে এই ফসিলটির স্থান প্রথমে।
বিজ্ঞানীরা ওই ১৯৭১-৭২ সালেই অনুসন্ধান করতে করতে আরও একটি আশ্চর্য ও অদ্ভুত ফসিল খুঁজে পান। যাকে বিজ্ঞানীরা রোমিও জুলিয়েট ফসিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গোবি মরুভূমিতেই তাঁরা অভিরেপটর বলে একটি পাখি সদৃশ ডাইনোসর আবিষ্কার করেন। অনেক ফসিলের মধ্যে একটি আশ্চর্য ফসিল তাঁরা পান যেখানে একই সঙ্গে পুরুষ এবং স্ত্রী অভিরেপটর রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন তারা অর্থাৎ ওই দুটি অভিরেপটর স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল। এ কারণে তাঁরা শেক্সপিয়ারের 'রোমিও জুলিয়েট' অবলম্বনে ফসিলটির নাম দেন 'রোমিও জুলিয়েট' ফসিল।
ফসিল হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের ডিম
যত বড়োই শিকারি আসুক না কেন, ডাইনোসর শিকার কিন্তু বড্ড কঠিন এবং পদ্ধতিও আলাদা। এখনকার যুগে ডাইনোসর-শিকারি হলেন পুরাজীববিজ্ঞানীরা। তাঁরাই একমাত্র জানেন, কোথায় কীভাবে কেমন করে তাদের পাওয়া যাবে ও কী করে তাদের শিকার করতে হবে। ভূবিজ্ঞানীরা পৃথিবীর নানান প্রান্তে পাথরের ধরন অনুযায়ী মানচিত্র তৈরি করেন। পুরাজীববিজ্ঞানীরা জানেন কোথায় কোন পাথরে ফসিল পাওয়া যেতে পারে। তাঁরা এও জানেন, মেসোজোয়িক যুগের পাথরে ডাইনোসরের জীবাশ্মের খোঁজ করতে হবে এবং সেই পাথর পৃথিবীর কোথায় কোথায় আছে। কারণ মেসোজোয়িক যুগই হল ডাইনোসরদের রাজত্বকাল। মেসোজোয়িক যুগের পাথর পৃথিবীর কোথায় কোথায় আছে ভূবিজ্ঞানীদের তৈরি মানচিত্র হল তার পথনির্দেশিকা। এছাড়া তাঁরা এও জানেন যে জীবাশ্মের খোঁজ করতে গেলে স্তরীভূত পাললিক শিলার মধ্যে অথবা আরো ভালোভাবে বলতে গেলে বালি-পাথর, কাদা পাথর বা শ্লেট পাথরে বা চুনাপাথরে খোঁজ করতে হবে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে সমস্ত শ্লেট পাথর, বালি পাথর বা চুনাপাথরে ফসিল পাওয়া যাবে। যে কোন প্রাণীর মৃত্যুর পর কতগুলো বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তবেই জীবাশ্মে রূপান্তরের সম্ভাবনা থাকে। প্রথমে জীবজন্তু মারা যাওয়ার পর যখন মাটি বা বালি চাপা পড়ে তখন প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই চামড়া ও শরীরের অন্যান্য নরম অংশ পচে গলে যায়। শুধু হাড় বা কঙ্কালটি পড়ে থাকে। যত দিন যায়, ততই চাপা দেওয়া পলি/মাটি বা বালির পরিমাণ বাড়তে থাকে। বহু বছর বাদে, চাপে ও তাপে, ওই বালি/মাটি পাথরের রূপান্তরিত হয়। একই সঙ্গে ওই মাটিতে থাকা জীবজন্তুর কঙ্কাল, জীবাশ্ম বা ফসিলে রূপান্তরিত হয়। একই পদ্ধতিতে গাছের কান্ডও জীবাশ্মে রূপান্তরিত হতে পারে। খুব অল্প ক্ষেত্রেই জীবজন্তুর গায়ের চামড়ার নকশার জীবাশ্ম পাওয়া যায়। আসলে চামড়া পচে গলে গেলেও ওই চামড়ার নকশা অনেক সময় নরম কাদার মধ্যে থেকে যায়। যা পরে পাথরের রূপান্তরিত হলেও ওই নকশা অটুট থাকে, যা থেকে বিজ্ঞানীরা চামড়ার স্বরূপ বুঝতে পারেন। তবে এ ধরনের ঘটনা খুব অল্প ক্ষেত্রেই ঘটে। বিজ্ঞানীদের কাছে ডাইনোসর শিকার কিন্তু খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য তাঁদেরকে মাঠে, পাহাড়ে, খাদে বা খুব বিপদ সঙ্কুল অঞ্চলেও যেতে হয়। তাঁবু খাটিয়ে হয়ত অজানা-অচেনা জনমানবহীন কোন জায়গাতে দিনের পর দিন থাকতে হয়। জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়ার জন্য অনেক বিপদের ঝুঁকিও নিতে হয়। এই শিকারের জন্য নানা মাপের ট্রাক, গাড়ি থেকে শুরু করে উট; ছেনি, হাতুড়ি বা ওই জাতীয় জিনিস এমনকি ঝাঁটা বা ঝাড়ু অবধি লাগে। ডাইনোসর শিকার সন্ধানী বিজ্ঞানী ভীষণ কষ্টসহিষ্ণু হন। তাঁদের শিক্ষিত চোখের হাত থেকে পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটু হাড়ের জীবাশ্মও এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। আবার, অনেক সময় ভাগ্য তাদের সহায়তা করে। অবশ্য কখনো কখনো উল্টোটিও হয়। যখনই তারা জীবাশ্মের সন্ধান পান তখনই তাদের আসল কাজ শুরু হয়। পাথরের মধ্য থেকে সেই ভঙ্গুর হাড়ের জীবাশ্ম ধীরে ধীরে উদ্ধার করা খুবই কঠিন কাজ। অনেক সময় পুরো পাথরটি ব্লক করে কেটে নিয়ে যেতে (তা সে যত বড়োই হোক না কেন) হয়। পরে ল্যাবরেটরীতে গিয়ে তাকে উদ্ধার করা হয়। সমস্ত শিকার অভিযানেই তাঁদের সঙ্গে রাখতে হয় বড় বড় কাঠের ক্রেট এবং প্রচুর পরিমাণে খড়। এই ক্রেটগুলো হচ্ছে ডাইনোসরদের খাঁচা। এখানে খড় বিছিয়ে তাদের বন্দি করে রাখা হয়। খুব সাবধানে নিয়ে আসতে হয়, একটু ঝাঁকুনি বা নড়াচড়াতেই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্রেটে ভালোভাবে প্যাক করেও পাহাড়ি বা মালভূমি অঞ্চলে গাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ সাধ্য কাজ নয় কিন্তু। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তো ওইসব অঞ্চলে রাস্তাঘাটের বালাই থাকে না।
বিজ্ঞানীদের মানসিকতা ডাইনোসর শিকারের সময় কীরকম হয় তার একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। একদল বিজ্ঞানী এশিয়া মহাদেশের গোবি মরুভূমি অঞ্চলে ডাইনোসর শিকারের উদ্দেশ্যে এক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। এটি প্রথমে বলা ১৯৭১ সালের আগের ঘটনা। তাঁদের সঙ্গে অজস্র উটের এক বাহিনী ছিল। এই ক্যামেল ক্যারাভান নিয়ে তারা অনেক আশ্চর্য আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁরাই প্রথম ডাইনোসরের ডিম আবিষ্কার করেন। তাঁরা এত ডাইনোসরের জীবাশ্ম পেলেন যে তাঁদের সেই সব ফসিল জড়ানোর জন্য সমস্ত খড়ই শেষ হয়ে গেল। তখন তাঁরা ফিরে না এসে নিজেরা ওই মরুভূমি গরমে রোদে খালি গায়ে থেকে নিজেদের জামা কাপড় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে তাই দিয়ে ফসিলগুলো প্যাকিং করলেন। তারপর, সেই প্যাকিংগুলো মজবুত করার জন্য মরুভূমির মতো জায়গায় তাঁদের কাছে যার মূল্য সবচেয়ে বেশি হওয়া উচিত, সেই জল ও ময়দা দিয়ে মন্ড তৈরি করে তাই দিয়ে ফসিলের চারপাশে শক্ত আবরণ তৈরি করলেন। সে সময়, হঠাৎই তাদের খাদ্যবস্তু, জল ইত্যাদির সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা বিপদে পড়ে গেলেন। তখন দলনেতা এক সভা ডেকে অন্য সদস্যদের কাছে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব রাখলেন। অন্য সদস্যরা সবাই এক বাক্যে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে না খেয়ে ফসিল খোঁজার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করলেন। কারণ তাঁরা কেউই ওই ডাইনোসরের ফসিলের রত্ন ভান্ডার ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। সৌভাগ্যক্রমে অবশ্য কয়েকদিন বাদেই তাদের খাবার, জল ও পেট্রোল এসে পৌঁছায় তাঁদের কাছে। মরুঝড়ের জন্য উটবাহিনীর খাবার-দাবার পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল। অবশ্য ওই ঝড়ে বহু উট মারা গিয়েছিল এবং তাঁদের বহু ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছিল। তবে, সেই যাত্রায়, তাঁদের বেশিদিন অভুক্ত থাকতে হয় নি।
জাদুঘরে পাশাপাশি টিরানোসরাস আর ট্রাইসেরাটপ
এবারে একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধের গল্প বলা যাক। সাত থেকে আট কোটি বছর আগের কথা। বিশাল এক হ্রদের পাশে ফুলে ভরা গাছ ও ফার্ন জাতীয় গাছে ছাওয়া সবুজ একটি অঞ্চল। দূরে একটি আগ্নেয়গিরি থেকে ধোঁয়া বেরিয়েই যাচ্ছে অর্থাৎ বিপদের পূর্ব লক্ষণ। যে কোন সময় অগ্নুৎপাত শুরু হতে পারে। মনের আনন্দে ট্রাইসেরাটপ, অ্যাঙ্কিলোসরাস, হংসচঞ্চু ডাইনোসরের দল ফুলে ভরা গাছ আর ফার্ন গাছ খাচ্ছে। এমন সময় দূরে বিপদের পদধ্বনি শোনা গেল। একটি ভয়ঙ্কর মাংসাশী ডাইনোসর, টিরানোসরাস রেক্স তাদের দিকে তেড়ে আসছে। হংসচঞ্চু ডাইনোসররা দ্রুত দৌড়ে গেল হ্রদের দিকে, লাফিয়ে পড়ল জলে, যাতে সাঁতরে দূরে বিপদ সীমার বাইরে চলে যেতে পারে। অ্যাঙ্কিলোসরাস ভ্রুক্ষেপও করলো না। কারণ পৃথিবীর ভয়ংকরতম প্রাণী টিরানোসরাসও তাদের ভয় পায় তাদের গায়ের বর্মের আবরণ আর ছুঁচোলো কাঁটার জন্য। বাকি রইল ট্রাইসেরাটপের দল। তারা খাওয়া বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। এই সময় টিরানোসরাস রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলো, তাকিয়ে দেখলো পুরো দৃশ্যটা। শরীর ঘুরিয়ে হাঁ করে তেড়ে গেল অ্যাঙ্কিলোসরাসদের দিকে, বেছে নিল তাদের একজনকে তার শিকার হিসেবে। তেড়ে গিয়ে কামড়ে ধরলো অ্যাঙ্কিলোসরাসের বর্মাবৃত শরীর। কিন্তু কিছুই হলো না তাতে অ্যাঙ্কিলোসরাসের। উল্টে সে তার ভারী হাড়ের মন্ড লাগানো কাঁটা ভর্তি লেজ দিয়ে আঘাত করল টিরানোসরাসের মুখে। ভেঙে গেল টিরানোসরাসের একটি দাঁত। যন্ত্রণায় সে পিছিয়ে গেল, বুঝতে পারল একে মারা কঠিন। বেছে নিল ট্রাইসেরাটপের একজনকে। সে তখন মনের আনন্দে গজেন্দ্র গমনে একটি ঝোপের পিছনে যাচ্ছিল। পায়ের আওয়াজে মুখ ঘুরিয়ে দেখল টিরানোসরাস কে। সে কিন্তু পালিয়ে গেল না, তার ভয়ঙ্কর তিনটে খড়্গ তাকে পালিয়ে যেতে শেখায় নি। সে মাথা নিচু করে রুখে দাঁড়াল শত্রুর দিকে। টিরানোসরাস মুখ খুলে দাঁত বার করে তেড়ে গেল তাঁর শিকারের দিকে। তারপর তিনটে খড়্গ বিঁধে গেল টিরানোসরাসের শরীরের নরম অংশে আর তার ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো খুঁজে পেল তাদের লক্ষ্য। কিন্তু কেউই তাদের ভারী শরীরের জন্য পড়ে গেল না। লড়াই তাই চলল বহুক্ষণ ধরে। পৃথিবী কেঁপে উঠল এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে। তারপর একসময় শিকার ও শিকারি দুজনেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে, মাটিতে। তাদের কঙ্কাল পরে বহু বহু লক্ষ বছর বাদে রূপান্তরিত হল ফসিলে। উপরের ঘটনাটি কিন্তু বানানো গল্প নয়। কিছুটা সত্যি, বাকিটা সত্যির উপর নির্ভর করে কল্পনা। পুরাজীববিজ্ঞানীরা বিশেষত ভার্টিব্রেট প্যালিয়েন্টোলজিস্টরা পাথরের বুকে দুজনের জীবাশ্ম ও তাদের অবস্থান দেখে বাকিটা কল্পনা করে নিয়েছেন। অবশ্যই, বিভিন্ন সূত্রের উপর নির্ভর করে এই কল্পনা তৈরি হয়েছে। এই ভাবেই অবশ্য তাঁদেরকে আদিম পৃথিবীর প্রাণীদের স্বভাব-চরিত্রের ধারনা করতে হয়। এইখানেই শেষ করা যাক এই গল্প। তবে, একটা তথ্য না বলাটা অন্যায় হবে। উপরে বর্ণিত গল্পে টিরানোসরাসকে যতটা ভয়ঙ্কর বলা হয়েছে তা কি সে সত্যিই ছিল? এ সম্বন্ধে অবশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। প্রথমে বলা হয়েছিল এরা পৃথিবীর ভয়ংকরতম প্রাণী। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা বললেন এরা এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না। এরা কামড়ের সাথে বিষ শিকারের শরীরে দিয়ে দিত, সেই বিষে প্রাণীটির মৃত্যু হলে তারপর তাকে খেত। কারণ, এদের সামনের ছোট্ট হাতদুটো শিকার করার পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। সাম্প্রতিকতম মতবাদ হল, এরা স্ক্যাভেঞ্জার ছিল। অর্থাৎ, অন্যের শিকার করা প্রাণী তাদের থেকে কেড়ে নিয়ে খেত, ঠিক যেমন আজকালকার দিনের হায়না।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া
গ্রাফিকঃ মিতিল