সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এক অন্য পিনোশিওর গপ্পো

আজ বেশ কিছুদিন পরে কলেজস্ট্রিটের প্রিয় বইয়ের দোকানটায় আবার ঢুঁ মারলেন অজিতেশ বাবু। এই কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ায় ঢুকলেই পুরোনো বইয়ের লাজুক লাজুক গন্ধটা প্রতিবারই তাঁর অলফ্যাক্টরি সেন্সকে বেজায় উত্তেজিত করে। স্কুল-কলেজবেলায় রীতিমতো বইয়ের পোকা ছিলেন তিনি, কলম ও চালাতেন একটু-আধটু। এখন আর অফিসে কাজের গুঁতোয় বইয়ের সাথে মুখোমুখি দেখাসাক্ষাৎ খুব একটা হয়ে ওঠে না।

এমনিতে মাঝে মাঝে তাঁকে এখানে আসতেই হয়। স্ত্রী বেলাদেবীর জন্য, দেশি-বিদেশী ম্যাগাজিনের নেশা তাঁর। আজকে অবশ্য আসার কারণটা অন্য। আজ তুতুলের বার্থ'ডে। এইবার দস্যিটা ছয়ে পা দিল। জামা-জুতো এমনকি খেলনাবাটির নেশাও তার নেই বললেই চলে। বাপ-মায়ের মতো সেও পাক্কা বইপোকা। এই বয়সেই তার পড়াশোনার পরিধি রীতিমতো ঈর্ষণীয় !
ডিসি মারভেল কমিক্স থেকে শুরু করে হ্যারি পটার, অ্যাস্টেরিক্স, টিনটিন, ম্যাজিক ট্রিয়াকল,.... আরো কত কী... অর্ধেকের নাম অজিতেশ বাবু নিজে এই বয়সেও শোনেননি, সঅব একরত্তিটার নখদর্পণে।

দোকানে দীর্ঘদিন যাতায়াতের সূত্রে মালিক অমল বাবুর সাথে তাঁর বেশ একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক স্থাপন হয়ে গেছে। তার ওপর প্রায় সমবয়সী। তাই দূর থেকে অজিতেশ বাবুকে দোকানের দিকে আসতে দেখে অমল বাবু দরাজ গলায় বলে উঠলেন,
- " আরে আসুন মশাই আসুন ! অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই যে !"
অজিতেশ বাবু এক-গাল হেসে বললেন,
- " কোথায় ? এই গেল মাসের গোড়াতেই তো এলুম ! মিসেসের জন্য ম্যাগাজিন কিনে নিয়ে গেলুম কিনা !"

- " তা আজ ও কি ম্যাগাজিন দেখাব ?"

- " না, না.....ছয় সাত বছরের বাচ্চাদের পড়ার মতো ভালো ইংরেজি গল্প বই থাকলে দেখান তো !"

- " এই গেল বিষ্যুদবার দোকানে বেশ ভালো কয়েকটা বাচ্চাদের বই এসেছে ! দাঁড়ান মশাই ! দেখাই !"

বলেই অমল বাবু দোকানের পেছন দিকের গুদামঘরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক পরে ফিরে এলেন, হাতে বেশ মোটা দুটো বইয়ের বান্ডিল।
দড়িগুলো খুলতে খুলতে অমল বাবু বললেন,
- " দেখুন মশাই ! বিলিতি জিনিস সব, কভার পেজ গুলো দেখেছেন ? পছন্দ হয়ে যাবে নিশ্চয়ই !"

বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন অজিতেশ বাবু। সত্যিই ভেতরে গপ্পো যাই থাক, বইয়ের প্রচ্ছদগুলো ভারী চটকদার ! পাতাগুলো ও আর্ট পেপারের উল্টো দিকের মতো। চকচকে আর তেলতেলে। তাতে যত টা না গল্প লেখা, তার চেয়ে বেশি আঁকা ইলাস্ট্রেশন। বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে মাঝে মাঝেই ছোট্টবেলার হাফ-প্যান্ট পরা খুদে অজু এসে বুড়ি ছুঁয়ে যাচ্ছিল বছর চল্লিশের অজিতেশ বাবুকে। তখন এত কালার প্রিন্টিং এর বাহার ছিল না, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটেই ডানা মেলতো কচিকাঁচাদের কল্পনার পক্ষীরাজ !
প্রায় দেড়-ঘণ্টা ধরে নাড়াঘাঁটার পরে অবশেষে দুটো বই তাঁর পছন্দ হল। প্রথমটা কার্লো কলোডির কালজয়ী বই
' অ্যাডভেঞ্চার অফ পিনোশিও', সাথে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট এনরিকো ম্যাজেন্টির চোখ-ধাঁধানো ইলাস্ট্রেশন ! প্রথম দেখাতেই তিনি বইটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। শেষমেষ সাড়ে চারশো দিয়ে কিনেই ফেললেন। দামটা অজিতেশ বাবুর মধ্যবিত্ত বাজেটের পক্ষে ঠিক পকেট ফ্রেন্ডলি হল না বটে, কিন্তু কুছ পরোয়া নেই ! বিলিতি অ্যান্টিক বই, দাম তো হবেই !

আর দ্বিতীয় বইটা হল, জোনাথন সুইফটের বহুচর্চিত 'গালিভার্স ট্রাভেলস'। দীর্ঘদিন ধরে বইটা তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার ইচ্ছে ছিল, এই সুযোগে কিনে ফেললেন। একটু বড় হলে তুতুল ও পড়তে পারবে।

রঙিন কাগজে মোড়া বইদুটো বগলদাবা করে অজিতেশ বাবু যখন বাড়িমুখো হলেন, তখন বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে হয় হয়। ট্রাফিক পেরিয়ে ফ্ল্যাটে পৌঁছুতে আরো ঘণ্টা খানেক লেগে গেল। শেষমেষ যখন পৌঁছুলেন, তখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে সাতটা ছুঁই ছুঁই।
গল্ফগ্রীনে তাঁদের ছোট্ট দুই কামরার ফ্ল্যাট। কাজেই নিমন্ত্রিতের সংখ্যাও বেশি নয়। তুতুলের চার-পাঁচ জন বন্ধু আর দাদু-ঠাম্মি।
তুতুল আজ ভারী সুন্দর দেখতে একটা গাউন পরেছে। হালকা নীল সাদা রঙের। মাথায় বার্থডে ক্যাপ। গোটা বাড়িটাই বেলাদেবী ভারী সুন্দর করে সাজিয়েছেন, ক্যান্ডেললাইট আর এলইডি বাল্ব দিয়ে। তুতুলের বন্ধুদের মাথাতেও লাল-নীল বার্থডে ক্যাপ। সবমিলিয়ে বার্থডে পার্টি জমজমাট।

দরজার বাইরে বুটের শব্দ পেয়েই একছুট্টে বেরিয়ে এলো তুতুল। অজিতেশ বাবুকে দেখতে পেয়ে একলাফে উঠে পড়লো তাঁর কোলে। ঠোঁট ফুলিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে অনুযোগের সুরে বলল,
- " আজ আমার বার্থডে, তুমি ভুলে গেছিলে বাবাই ?"

- " আজ আমার তুতুল মাম্মামের জন্মদিন ! এটা কি ভুলে যাওয়া যায় ?"
- " তবে দেরি কল্লে কেন ?"
-" তোমার গিফট কিনতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল যে !"
এবারে তুতুলের মুখের দুঃখ দুঃখ ভাবটা কেটে গিয়ে হাসি ফুটে উঠলো।
- " কই আমার গিফট দেখি !"
অজিতেশ বাবু চোখ পাকিয়ে বললেন,
- " উঁহু, উঁহু ! আগে বার্থডে গার্লের কেক কাটা হোক ! তারপরে গিফট !"

অজিতেশ বাবুর হাত ধরে ঘরে ঢুকলো ছোট্ট তুতুল। মোমবাতি নিভিয়ে যখন কেকের গায়ে ছুরি ছোঁয়ালো, তখন সবাই হ্যাপি বার্থডে গান ধরেছে। মাম্মাম-বাবাই, দাদু-ঠাম্মি, আর বন্ধুরা সব্বাই খুব হাততালি দিচ্ছে। তুতুলের আজ ভারী মজা। মা আজ তুতুলের ফেভারিট বিরিয়ানি রান্না করেছে। কেক খাওয়া শেষে সবাই কব্জি ডুবিয়ে বিরিয়ানি খেলো।

সবাই চলে যাওয়ার পরে রাত্তির বেলা তুতুল গুণতে বসলো, দেখলো, সব মিলিয়ে মোট পনেরটা গিফট পেয়েছে সে।
একটা একটা করে যখন সবগুলোর মোড়ক খুলতে শুরু করল, তখন দেখল, একমাত্র মা-বাবা আর দাদু-ঠাম্মি ছাড়া কেউ আর তাকে গল্পের বই দেয়নি। বন্ধুরা কেউ কেউ মোটা মোটা টেডিবিয়ার, আবার কেউ বার্বি ডল দিয়েছে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল তুতুলের। সে তো বড় হয়েছে নাকি ? এখনো তার বসে বসে টেডি খেলার টাইম আছে ?
তবে তুতুলের সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে বাবাইয়ের দেওয়া পিনোশিওর বইটা। কী সুন্দর সুন্দর কার্টুন আঁকা ! আর পিনোশিও ছেলেটাকেও কী মজার দেখতে ! টিভিতে ফ্রোজেন কার্টুনটা এই কিছুদিন আগেই দেখেছে তুতুল। সেখানে এলসা আর অ্যানার ফ্রেন্ড, সেই ওলাফ বলে কার্টুনটাকে মনে আছে ? সেই গাজরের নাকওয়ালা ওলাফকে ভারী পছন্দ হয়েছিল তুতুলের। পিনোশিওর নাকটাও পুরো ওই রকম। গাজরের না হলেও ঐরকম ছুঁচলো ! নাঃ, বইটা তাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে !

- " তুতুল ! এই তুতুল !"
- " যাই মা !"
- " ঘুমোতে এস ! অনেক রাত হয়ে গেছে !"
- " আসছি !"

আজকের মত গবেষণা স্থগিত রেখে ঘুমোতে চলে গেল তুতুল। কিন্তু তার পুরো চিন্তা জুড়ে এখন শুধুই পিনোশিও !

পরদিন থেকেই শুরু হয়ে গেল মিশন পিনোশিও ! এখন তো স্কুল ছুটি। সামার ভ্যাকেশন কিনা ! কাজেই পড়ার চাপ ও বিশেষ নেই। প্রতিদিন রাত্তির বেলা অনেকটা সময় করে বইটা পড়ে তুতুল।

সাড়ে দশটা বেজে গেছে। তার চোখে এখনো ঘুমের নামগন্ধ নেই ! উপুড় হয়ে শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে সে পিনোশিওর গোল্ডেন গুজ গল্পটা পড়ছে।

- " মা, ও মা !"
তুতুল ডেকে ওঠে।
- " বল !"
- " তুমি এই পিনোশিওর গল্পগুলো পড়েছ ?"
- " পড়েছি বটে, কিন্তু সে তো অনেক ছোটবেলায়। এখন অত মনে নেই !"
- " আচ্ছা মা, পিনোশিওর নাকটা ওরকম কেন ?"
- " আসলে মিথ্যে কথা বললেই, ছেলেটার নাক টা ঐরকম লাল হয়ে যেত আর একটু একটু করে বড় হতো !"
- " কেন ?"
- " আসলে ওর নাকটা খুব সেনসিটিভ ছিল তো, অনেকটা লাই-ডিটেক্টরের কাজ করতো !"
- " আচ্ছা, এটা আমাদের ও হতে পারে ?"
- " হতে পারে কী রে ? হয় তো !"
- " হয় ?"
- " আলবাত ! অনেক মানুষই যখন মিথ্যে কথা বলে, তখন তাদের নাকের ডগাটা জোকারদের পমপমের মতো লাল-টুকটুকে হয়ে যায়। আর বাকিরা ঠিক ধরে ফেলে তখন, যে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে !"
- " ও !"
- " ডাক্তারি ভাষায় এর একটা গালভরা নাম ও আছে !"
- " কী নাম ?"
- " পিনোশিও সিনড্রোম !"

একসপ্তাহ হয়ে গেছে। পিনোশিওর সব গল্পগুলো পড়ে ফেলেছে তুতুল। কিন্তু মায়ের কথাটা শোনার পর থেকে মনটা রোজ খচখচ করে। মিথ্যে কথা বললেই নাক লাল হয়ে বেড়ে যাবে ? যদি তার ও হয় ? বুকটা দুরুদুরু করে ওঠে তুতুলের। তাহলে এবার থেকে মা-বাবার কাছে টুকিটাকি গুল গুলোও দেওয়া যাবে না ? এই যেমন, পেন্সিল ভেঙে গেছে, ইরেজার হারিয়ে গেছে, এসব ? এক-দুবার টেস্ট করে দেখেছে তুতুল। মা আজকাল মিথ্যে বললে ওকে ঠিক ধরে ফেলে ! তারপর মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আয়না নিয়ে নাক পর্যবেক্ষণ করতে বসে যায় তুতুল। সত্যিই তো ! নাকটা তো বেশ লাল হয়ে উঠেছে ! ও মা ! নাকটা একটু বেড়েছে বলেও মনে হচ্ছে না ? এ তো ভারী মুশকিলে পড়া গেল !

 

*****

হপ্তা দুয়েক পর.....

ভ্যাকেশন শেষ। তুতুলদের স্কুল ও খুলে গেছে। এখন আর অত গল্প বই পড়ার টাইম পায় না তুতুল। তবু স্কুলের ব্যাগে মা-বাবাইকে লুকিয়ে একটা-অধটা গল্প বই পুরে নেয় সে। টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুদের সাথে লুকোচুরি না খেলে বইয়ের মধ্যে ডুবে যায়। বেশিরভাগ দিন টিফিনে দেওয়া খাবার ও শেষ করতে পারে না। মোটে আধঘণ্টার টিফিন পিরিয়ড ! তার মধ্যে সে খাবে না গল্পের বই পড়বে ?

টিফিনে স্প্যাগেটি তার প্রিয় খাবার। কখনো কখনো সেটাও শেষ করে উঠতে পারে না ! এই নিয়ে মায়ের কাছে কম বকুনি খায় না তুতুল। মাঝে মাঝে দুমদাম কিল ও খায় ! কিন্তু এসবে তার কোনো পরোয়া নেই !

আজকাল ছুটির পরে তুতুলের টিফিন বক্স সার্চ করতে গিয়ে প্রায়ই অবাক হয়ে যাচ্ছেন বেলাদেবী। যে মেয়ে কিনা কিল-চড় খেয়েও কোনোদিন হাফের বেশি টিফিন শেষ করতে পারতো না, তার লাঞ্চবক্স কিনা চেঁছে পুঁছে সাফ হয়ে যাচ্ছে ! ব্যাপারখানা ঠিক সুবিধের ঠেকছে না তো !

- " তুতুল ! অ্যাই তুতুল !"
তুতুলের গলা শুকিয়ে যায়।
- " কী মা ?"
- " তোর টিফিন গুলো আজকাল কার পেটে যাচ্ছে বলতো ?"
- " কেন, আমিই তো খাই মা ! তুমি বকতে বলে এখন পুরোটা খেয়ে নিই !"
বার দুই চোখ পিটপিট করে মুখ নিচু করে নেয় তুতল। ইশ ! নাকটা নিশ্চয়ই এখন বড় আর লাল টুকটুকে হয়ে গেছে ! মা দেখতে পেলে সব্বোনাশ হয়ে যাবে !

বেলাদেবী চোখ সরু করে তাকান তুতুলের দিকে।
- " তুতুল !"
- " হ্যাঁ, মা !"
গলার স্বর কেঁপে যায় তুতুলের।
- " টিফিনটার দান-খয়রাতি শুরু করোনি তো ?"
- " না মা !"

বেলাদেবী টিফিনবক্সটা ধুতে হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। তুতুলের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল যেন ! যাক বাবা ! এ যাত্রায় বাঁচা গেল !

ওদিকে বেলাদেবীর মনটা হপ্তা-দুয়েক ধরেই খচখচ করছে। টিফিনে অতটা খাবার তুতুল সত্যিই খেলে স্কুল থেকে এসে ওর খিদে পাওয়ার কথা নয়। অথচ, ইদানিং মনে হচ্ছে যেন, তুতুল স্কুল থেকে এসে আগের চেয়ে বেশিই খাচ্ছে। নাঃ, যা দেখা যাচ্ছে, তুতুলের পেছনে এবার একটা টিকটিকি না লাগালেই নয় !
বিকেলে তুতুল খেলতে বেরিয়ে গেলে, বেলাদেবী চুপিচুপি ওর বন্ধু শ্রুতির বাড়ি গেলেন, তারপর বুঝিয়ে দিয়ে এলেন পুরো ব্যাপারটা। গোয়েন্দাগিরির ভার পেয়ে শ্রুতি তো খুশিতে ডগমগ !
- " তুমি একদম চিন্তা করো না আন্টি ! আমি দু-দিনের মধ্যেই তোমায় পাকা খবর এনে দেব !"

বেলাদেবী শ্রুতিকে আদর করে দায়িত্ব বুঝিয়ে যথা সময়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তুতুল এসবের কানাকড়িও টের পেল না !

দিন-দুয়েক পর.....

- " আন্টি, আন্টি !"
- " আরে, শ্রুতি মা ! কোনো খবর পেলে ?"
- " একদম পাকা খবর আন্টি ! আই-উইটনেস পেয়েছি !"
- " কোথায় ?"
- " এই গোগোল ! এদিকে যায় ! আন্টিকে যেটা দেখেছিস বল !"
নাদুসনুদুস চেহারার গোগোল এগিয়ে এসে এবার বেলাদেবীকে বলল,
- " আন্টি, তুতুল না রোজ টিফিনের সময় এখন স্কুলের পেছনের রাস্তার দিকে চলে যায়, ওখানে একটা উশকোখুস্কো চেহারার পাগলী বুড়ি বসে থাকে। সে হ্যাংলার মতো তুতুলের কাছে খাবার চায়, আর তুতুল তার পুরো লাঞ্চবক্সটা পাগলিকে দিয়ে দেয় ! তারপর পাগলী চেটেপুটে সেটা সাফ করে আবার তুতুলকে ফিরিয়ে দেয় !
আমি পরপর দুদিন পেছন দিকে ক্রিকেট বল কুড়োতে গিয়ে এসব দেখেছি !"

এতক্ষণে তবে তুতুলের টিফিন রহস্যের সমাধান হল ! গোগোল আর শ্রুতিকে চকোলেট আর কেক খাইয়ে সেদিনের মতো বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন বেলাদেবী।

*****

পরের দিন স্কুলে.....

প্রতিদিনের মতো টিফিনবক্সটা নিয়ে তুতুল আজও চুপিচুপি পেছনের গেটের দিকে চলে গেল। আজ মা তাকে স্প্যাগেটি টিফিন দিয়েছে। তুতুলের মতো পাগলিটাও মায়ের হাতের স্প্যাগেটি খেতে বড়ো ভালোবাসে ! তাই তুতুল নিজে একটুও না খেয়ে পুরোটাই পাগলিকে দেয়। পাগলি যখন গোগ্রাসে খাবার গুলো গেলে, তখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তুতুল। কী খিদে রে বাবা ! মনে হয় সামনে অজগর সাপ পেলেও বুড়ি সেটাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে !
অবাক হয়ে যায় তুতুল। স্টিলের টিফিনটাকে পাগলি একদম ধোয়া বাসনের মতো চকচকে করে ফেরত দেয়। আর বিড়বিড় করে বলে,
- " তুমি তো ফেরেশতা আছো মা ! গরিব দুঃখীটারে দয়া করে দুটি খেতে দাও ! তোমায় আশীব্বাদ করছি মা, তুমি অনেক বড় হবে !"
পাগলীর মুখে কথাগুলো শুনলে ভারী আনন্দ হয় তুতুলের। ইচ্ছে করে, আরো একটু পেট ভরে খেতে দেয় ওকে।

কিন্তু আজ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাগলিকে স্কুলের ত্রিসীমানায় খুঁজে পেল না তুতুল। গেল কোথায় বুড়িটা ?
তুতুলের মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল। টিফিনের স্প্যাগেটিটা ছুঁয়েও দেখলো না সে।

ছুটি হলে স্কুলবাস তুতুলকে ঘরের সামনে ড্রপ করে দিল। তুতুল দুঃখ দুঃখ মুখ করে বাড়িতে ঢুকলো। জুতো-মোজা খুলে যেই না সে রুমে পা দিয়েছে, অমনি তার চোখ-দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল ! এ কী ! স্কুলের পাগলি ঘরে এল কী করে ? সে দেখলো, পাগলি তাদের ডাইনিং টেবিলে বসে আয়েশ করে গরম গরম পোলাও খাচ্ছে ! আর মা হাসিমুখে সার্ভ করছেন ! খাওয়া শেষ হলে পাগলি মা-মেয়েকে অনেক আশীর্বাদ করে বিদায় নিল।

পাগলি যেতেই তুতুল মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো,
- " মা, মা, তুমি একে কোথায় পেলে ?"
- " পেলাম ! সে খোঁজে তোর কাজ কী ?"
- " বলো না মা !"
- " তোর নাক দেখে !"
- " মানে ?"
- " সেদিন যখন তুই আমাকে মিথ্যে কথা বললি, তখন তোর নাকটা পিনোশিওর মতো লম্বা আর লাল-টুকটুকে হয়ে গেছিল ! তখন বুঝতে পারলাম, তুমি আমায় মিথ্যে কথা বলছো ! এমনকি এখনো ক্ষমা চাওনি বলে, তোমার নাকটা ওরকমই রয়ে গেছে ! মনে নেই, সেদিন গোগোল আর শ্রুতিরা খেলার মাঠে তোকে দেখে এমনি এমনি হাসছিলো !"
তুতুল সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিংটবিল এর সামনে দাঁড়িয়ে নাক পর্যবেক্ষণ শুরু করলো। এ বাবা ! তাই তো ! নাকটাকে কী বিশ্ৰী রকম লম্বা আর লাল দেখাচ্ছে !

তুতুল এবার কাঁদো-কাঁদো হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
- " মা, ও মা ! আমার নাকটা কি আর কোনোদিন ও ঠিক হবে না ?"
- " কেন হবে না ? তুমি সত্যি টা বললেই নাক আবার আগের মত হয়ে যাবে !"
তুতুল এবার কাঁদতে কাঁদতে স্কুলের ঘটনাগুলো মা কে সব বললো। সব শুনে বেলাদেবী বললেন,
- " হয়েছে ! এবার তুমি চোখ বন্ধ কর তো !"

তুতুল সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এবার বেলাদেবী আস্তে আস্তে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন,
-" গিলি গিলি গিলি গিলি ফুসস !"

এক অন্য পিনোশিওর গপ্পো

চোখ খুলে আবার আয়নায় সামনে দাঁড়ালো তুতুল। এ বাবা ! নাকখানা তো আবার আগের মতো ছোট্ট হয়ে গেছে !
এবার সে আহ্লাদে আটখানা হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
- " কেমন করে করলে মা ?"
বেলাদেবী মুচকি হেসে বললেন,
- " সিম্পল ! ম্যাজিক !"

তুতুল হাসতে হাসতে মা কে জড়িয়ে ধরলো।

পুনশ্চঃ এখন প্রতিদিন তুতুল একটার জায়গায় দুটো লাঞ্চবক্স নিয়ে স্কুলে যায়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা