খি (Xi)একদিন শুকনো ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে শিকারের খোঁজে যাচ্ছিল। এমন সময় আকাশ থেকে তার সামনে কী যেন একখানা পড়ল। তেমন জিনিষ খি কেন, তার পরিবারের লোকজন কেউ কখনও দেখেছি, তেমন জিনিষের কথা শোনেওনি। তা, আকাশ থেকে যখন পড়েইছে, তখন সেটা নির্ঘাত ঠাকুর-দেবতারাই পাঠিয়েছেন,নইলে আর এল কী করে? তো খি সেই জিনিষটাকে নিয়ে তার বাড়ির পথে হাঁটা দিল। বাড়ি বলতে আবার গোছানো গ্রাম ভেবে বোসোনা। ভবঘুরে বুশম্যানরা আফ্রিকার মরুভূমিতে ঘুরে ঘুরে যেখানে যখন থাকে, সেখানে একখানা কুঁড়েঘর বানিয়ে নেয়, সেটাই তাদের বাড়ি।
বাড়ি নিয়ে গিয়ে দেখা গেল, জিনিষটা বড়ই কাজের । এমনিতেই দেখতে সুন্দর, আবার সেটা দিয়ে কত কাজ করা যায় - আগুন জ্বালানো যায়,নকশাকরা যায়,জিনিষ ভাঙা যায়, বাজনা বাজানো যায়, আরও নানারকম কাজ করতে সবার বড়ই সুবিধা হতে লাগল। তাই কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, দলের প্রত্যেকে সেটা নিজের কাছে রাখতে চাইছে বা বেশি ব্যবহার করতে চাইছে। এর ফলে, খি আর তার প্রিয় মানুষদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া- মান-অভিমানের পালা শুরু হল, লোভ দেখা দিল। সবাই বুঝতে পারল যে এই জিনিষটা পাঠিয়ে দেবদেবীরা খুব একটা ঠিক কাজ করেন নি। এটা তাঁদের ফেরত দেওয়া উচিত। কিন্তু মাটিতে পুঁতে বা আকাশের দিকের ছুঁড়ে যেহেতু ফেরত দেওয়া গেল না, তাই সিদ্ধান্ত হল যে সেটাকে একেবারে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। পরিবারের মাথা হিসাবে এই গুরুতর কাজের দায়িত্ব নিল খি - প্রায় কুড়ি দিনের পথ হেঁটে,পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে, এই খারাপ জিনিষটাকে ফেলে আসবে সে।
এতক্ষণে তো জানতেই ইচ্ছে করছে, সেই জিনিষটা আসলে কী? রোসো বাপু, বলছি। সেটা আসলে আর কিছু না, ছিল একটা ফাঁকা কাঁচের তৈরি কোকা-কোলার বোতল! মরুভূমির ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে যেতে যেতে এক শ্বেতাঙ্গ পাইলট সেটাকে অবহেলায় নীচে ছুঁড়ে দিয়েছিল। মরুভূমিতে শিকারী-ভবঘুরে জীবন যাপন করা খি এবং তার সঙ্গীদের কাছে সেটা ছিল একেবারেই অচেনা,অজানা এক বস্তু। আধুনিক, শহুরে সভ্যতার সঙ্গে তাদের কোনোও পরিচয় ছিল না। কিন্তু এহেন একখানা 'শহুরে, সভ্য' জিনিষকে জীবন থেকে বিদায় করতে গিয়ে খি কে যে সরাসরি সভ্যতার মুখোমুখি বেশ খানিকটা হতে হবে, সেটা কি সে জানত?
খি শেষ অবধি পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারল কি না, আর যাওয়ার পথে তার কী কী অভিজ্ঞতা হল,সেটা জানতে হলে দেখে নিতে হবে 'দ্য গড্স্ মাস্ট বি ক্রেজি' (The Gods Must Be Crazy)। পরিচালক জেমি উইসের এই ছবিটি ১৯৮০ সালে সাউথ আফ্রিকাতে মুক্তি পায়। বাণিজ্যিক ভাবে চূড়ান্ত সফল এই ছবিটি সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখানো হয়। সব জায়গাতেই ছবিটি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করে। তুমি এই ছবিটি অনলাইনে দেখতে পারো, ইউটিউব থেকে। ছবির যত মজাদার গল্প এখানে বলে দিলে তো দেখার মজাটাই চলে যাবে। তাই পুরো গল্প আর বলছি না। বরং এই ছবির ট্রেইলারটা দেখে নিলেই আন্দাজ পাবে, কত মজা লুকিয়ে আছে এই ছবির ভেতর। আমি বরং এই ছবির বিষয়ে কয়েকটা অন্য তথ্য দিয়ে রাখি।
গল্প এগিয়ে চলে প্রতিবেশী দেশ বোৎসোয়ানাতে। কাহিনিচিত্র হলেও, পুরো ছবির অনেকটাই তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্রের আদলে। কালাহারি মরুভূমি এবং আশেপাশের তৃণভূমি, সাধারণ মানুষের জীবন, ভবঘুরে বুশম্যানদের জীবনযাত্রা, সঙ্গে নানারকমের জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাওয়ার উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে অদ্ভূত সমস্ত মজাদার দৃশ্য - মাঝে মাঝে বনের জন্তুরা দারুণ সব কান্ড ঘটায়, আর মাঝেমাঝে মানুষেরা। আর পুরো ছবিটার বিভিন্ন ঘটনাকে এক্সুতোয় বেঁধে আমাদের বলে দিচ্ছেন একজন ন্যারেটর বা কথক, একেবারে তথ্যচিত্রের মেজাজে।
বন-জঙ্গল, মরুভূমির বাসিন্দা সরল মানুষদের জীবনের পাশে পাশে রয়েছে ছকে বাঁধা শহুরে জীবনের ছবি। ছবির অনেকটা অংশ জুড়েই দুই ধরনের জীবনের তুলনা করা হয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে তৈরি এই ছবিতে বুশম্যানদের জীবন যেমন দেখানো হয়েছে, আসলে সেই সময়ে কিন্তু তার থেকে অনেকটাই বদলে গেছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ী ঘরবাড়ি বানিয়ে কৃষিকাজ বা পশুপালন করতেন। তবে শহুরে জীবনের সঙ্গে তফাত তো ছিলই।
'দ্য গড্স্ মাস্ট বি ক্রেজি' তৈরি হওয়ার পরে নানারকমের সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে, যে সময়ে এই ছবি তৈরি হয়েছিল, সেই সময়ে সাউথ আফ্রিকাতে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন চলছে। এই ছবিতে সেসব বিষয়ের কোনোও ছায়া দেখা যায় না। কিন্তু সেসব আলোচনা আমরা আপাতত করব না, বরং আরও বড় হয়ে করব। কারণ এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সব সমালোচনার ওপরে উঠে সহজ সরল মানুষ খি এবং খি এর রোমাঞ্চকর অভিযান আমাদের সবার মন ছুঁয়ে গেছে।
খি-এর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তাঁর নাম কাও কোমা (N!xau / Gcao Tekene Çoma)। তিনি নিজে আদতে একজন সান গোষ্ঠীর মানুষ বা বুশম্যান ছিলেন। কাও কোমা পরে এই ছবির সিকোয়েলে অভিনয় করেন। তা ছাড়াও, তাঁর চরিত্রটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে অন্যান্য বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেন । কাও কোমার সরল হাসি আর অকপট অভিনয় এই ছবির এক বিশেষ প্রাপ্তি।
২০২০ সালে সারা পৃথিবীর মানুষ এক কঠিন বিপদের মুখোমুখি। নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপে আমরা সবাই আপাতত ঘরবন্দী। দেশে দেশে 'লকডাউন' চলছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে, একবার ফিরে দেখাই যেতে পারে এই চল্লিশ বছরের পুরনো ছবিটি। আমাদের মধ্যে অনেক মানুষের অভ্যাস আছে, হেলিকপ্টারের পাইলটের মত ভাবনা চিন্তা না করে রাস্তা-ঘাটে, যেখানে খুশি খালি খাবারের প্যাকেট বা বোতল ফেলে দিই। ভেবেও দেখিনা সেটা অন্য কারোর অসুবিধা করছে কি না। কিংবা রাস্তা পানের পিক বা মুখের থুতু ফেলে অনেকে। তারাও ভাবে না এতে অন্য মানুষের বা জীবজন্তুর ক্ষতি হচ্ছে কি না। কিন্তু আজ যখন আমাদের দেশে গত এক সপ্তাহ ধরে লকডাউন চলছে, আমাদের বাইরে বেরোনো,খেলা করা, বেড়াতে যাওয়া বারণ, তখন আমরা নিজেরাই দেখতে পাচ্ছি, আকাশ অনেক বেশি নীল,বাতাস একটু কম গরম, চারদিকে কত পাখির ডাক শুনছি,খবর দেখছি মুম্বইয়ের সমুদ্রে ডলফিনেরা দেখা দিয়েছে, বা ওড়িশার ফাঁকা বেলাভূমিগুলিতে অলিভ রিডলি কচ্ছপের দল ডিম পাড়তে ফিরে এসেছে --- শুধুমাত্র মানুষেরা কম গাড়ি,কম এ সি,ব্যবহার করছে বলে, কম ভীড় জমাচ্ছে বলে অন্যান্য পশুপাখিরা যেন অনেকদিন পরে একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে।
তার মানে কি এই যে,পরিবেশের স্বার্থে আমরা নিজেদের যাবতীয় আনন্দ বাতিল করব? না, তেমন করতে চাইলেও করা সহজ নয়। বরং খি এর থেকে আমরা একটা জিনিষ শিখতে পারি।
খি এবং তার পরিবারের মানুষদের মত আমাদের ভেবে দেখতে হবে, আমাদের জীবনে কোন কোন জিনিষগুলি সত্যিই প্রয়োজনীয়, আর কোন গুলি শখের কারণে জরুরী হয়ে উঠেছে। চিনে নিতে হবে আমাদের জীবনের কোন কোন জিনিষ সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায়। কারণ যে জিনিষ ভাগ করে নেওয়া যায় না, সেই জিনিষ, সেই সুবিধাগুলিই আমাদের মনের মধ্যে রাগ, হিংসা, ঘৃণার জন্ম দেয়।