আর একদিন পরেই সরস্বতীপুজো। বাঙালির ঘরে ঘরে সারা বছর যে নানারকমের পালাপার্বণ লেগেই থাকে, তার মধ্যে অন্যতম এক অনুষ্ঠান। সরস্বতী পুজো আবার যত না বড়দের পুজো, তার থেকে অনেক বেশি ছোটদেরই পুজো। মা সরস্বতীকে আমরা বিদ্যার দেবী বলে জানি। সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের আশাভরসা তিনি, কারণ তিনি তুষ্ট থাকলেই ছাত্ররা ভালোভাবে পড়াশোনা করে পরীক্ষায় ভালো ফল করবে, এটাই বিশ্বাস। তাই বেশিরভাগ স্কুলে, অনেকের নিজেদের বাড়িতেই সবাই ধূমধাম করে সরস্বতী পূজা করে। আজকাল অবশ্য বারোয়ারীভাবেও পাড়ায় পাড়ায় সরস্বতী পুজো হয়ে থাকে।
মা সরস্বতীকে দেখতে কিরকম , জিজ্ঞাসা করলে সবাই প্রায় চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে- শ্বেতবরণ অঙ্গ, হাতে বীণা, বাহন রাজহাঁস,সাদা পদ্মফুলের আসন। ডানহাতে বরাভয় মুদ্রা -যেন বলছেন- ভয় নেই বাছা, ভয় নেই- মন দিয়ে অঞ্জলি দে, অঞ্জলি দেওয়ার আগে কিন্তু কুল খাসনা, আর পুজোর দিনে কিছুতেই পড়ার বই নিয়ে বসবি না- বছরভর পরীক্ষায় তোর ভাল রেজাল্ট নিশ্চিত ! শান্তশিষ্ট সরস্বতী ঠাকুরকে দেখে খুব একটা ভয়ও করে না, কিন্তুতিনি রেগে গেলে পড়াশোনা গোল্লায় যেতে পারে - কারণ আমরা সবাই জানি, তিনি বিদ্যা, জ্ঞান, সংস্কৃতি, কলার প্রতীক। কিন্তু জান কি - সরস্বতী এক সময়ে শুধুমাত্র বিদ্যার দেবী রূপেই পরিচিত ছিলেন না, তিনি ছিলেন জীবনদায়িনী নদীরূপে পরিচিত; সাথে ছিলেন অন্নদায়িনী, এমনকি শত্রুবিনাশিনী রূপেও পরিচিত ! এবছর পুজোর সকালে অঞ্জলি দেওয়ার আগে, এস জেনে নিই, সরস্বতী কিভাবে হয়ে উঠলেন হিন্দু ধর্মের জ্ঞানদায়িনী দেবী।
তুমি হয়তো শুনলে অবাক হবে যে, মানুষ যখন দ্বিপদ প্রাণী হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করল, তখন ধর্ম বা দেবদেবী কিছুই ছিল না। তোমার ইতিহাস বই-এর ভাষায় এ হল প্রস্তর যুগের কথা। তখন ছিল নিজেকে টিঁকিয়ে রাখার যুগ। তারপর মানুষ যত স্থিত হয়েছে, নিজেরাই খাদ্য, বস্ত্র তৈরী করে জীবন কিছুটা সহজ করতে পেরেছে, তাদের চারপাশ দেখার অবকাশ হল, তারা দেখল, প্রাত্যহিক জীবনে অনেক প্রাকৃতিক সহায়তা তারা পেয়ে থাকে। কখনও শ্রদ্ধায়, কখনও বা ভয়ে তারা নানা প্রাকৃতিক শক্তিকে মর্যাদা দিল। প্রকৃতির বিভিন্ন অংশ- জল , বায়ু, মাটি, আলো থেকে শুরু করে গাছ, ফুল, পশু, পাখিদের বিভিন্ন শক্তির প্রতীক রূপে আরাধনা করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে সময়ের পথচলার সাথে সাথে এই সমস্ত আরাধ্য শক্তিগুলি চেহারা, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট বদল হতে থাকে। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিচিত এবং উপাসিত হতে হতে বদলে যেতে থাকে তাঁদের চেহারা, বাহন, আসন এবং ক্ষমতা। বিশ্বের সমস্ত সভ্যতাতেই এই ধরণের বহু বহু উদাহরণ আছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা এবং হিন্দু ধর্মও এই বদল প্রক্রিয়ার বাইরে নয়। যদি অকারণ গোঁড়ামি আর বাজে ধর্মান্ধতাকে বাদ দিয়ে সেই সব বদলের কথা নিয়ে একটু পড়াশোনা কর, তাহলে দেখবে সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে ধর্মের এবং দেবদেবীদের ধারণার বিবর্তনও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়!
হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তী যুগে দীর্ঘ মরুভূমির পথ পেরিয়ে মানুষের যে দলটি পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ নদীবহুল অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তারা নিজেদের আর্য নামে অভিহিত করেছিল। নদী তাদের জীবনে সর্বরকম সহায়তা করে এতটাই স্বস্তি দিয়েছিল যে তারা আন্তরিকভাবেই এই নদীরূপা শক্তিকে বন্দনা করেছিল। এভাবেই বৈদিক সভ্যতার পত্তন হল, শুরু হল ঋষিদের মননসমৃদ্ধ বৈদিক ধর্মচিন্তার, যার ফসল হল ঋক্, সাম যজুঃ ও অথর্ব নামক বেদসমূহ।
যে কোন কাজেই শক্তি বা তেজের প্রয়োজন বা প্রয়োগ অবধার্য। খোলা চোখেই দেখা যায় সূর্য হল এই পৃথিবীর পক্ষে এক অফুরন্ত তেজের আধার। তাই স্বাভাবিকভাবেই সূর্য আমাদের প্রথম দেবতা। কিন্তু তোমরা তো জানো, শুধু বাবাতে আমাদের মন ভরে না, মাকেও চাই। আসলে মায়ের আদরই তো আমরা প্রাণ ভরে উপভোগ করি। তাই একজন মাতৃরূপা দেবীরও আবশ্যক হল। যে বিশাল জলধারা মাতৃস্নেহে আর্যজাতিকে জীবনের সব ক্ষেত্রে লালন করেছিল, তিনিই তো হতে পারেন আমাদের প্রথম দেবী। এই দেবীর নাম হল সরস্বতী, কারণ সরস্ শব্দের অর্থ জল।
শুধু জলযুক্ত বলেই দেবীর নাম সরস্বতী তা নয়, বৈদিক যুগের প্রথমে পুণ্যসলিলা সরস্বতী প্রধানা এবং সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী হিসেবেও গণ্যা ছিলেন। নদী হিসেবে গঙ্গা বা যমুনার প্রাধান্য তখনও স্বীকৃত হয়নি। সরস্বতীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় অন্তর্গত সিমুর পর্বতে। চলার পথে তীরে তীরে প্রসিদ্ধ তীর্থক্ষেত্রের সমাহার। এর তীরে অনুষ্ঠিত যজ্ঞের নাম সারস্বত যজ্ঞ, নদীর জলে পিতৃতর্পণ বিহিত ছিল।
তবে নদীরূপা ছাড়াও ঋক্ বেদে সরস্বতীর আরেকটা পরিচয় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। সরস্ শব্দের আদি অর্থ জ্যোতি। সূর্যরশ্মির তিনটি রূপ ইরা, ভারতী ও সরস্বতীর একত্রিত রূপ হল সরস্বতী। ইনি ত্রিলোকের সর্বত্রব্যাপী সূর্যতেজের স্ত্রীশক্তি। ইনি স্বর্গ-মর্ত্যকে দীপ্তি দ্বারা ব্যাপ্ত করে বিরাজমান। বেদে জ্যোতিরূপা সরস্বতীর উদ্দেশ্যে অনেক শ্লোক উৎসর্গ করা হয়েছে। একটা অদ্ভুত কথা বলা হয়েছে যে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী কুব্জা ছিলেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, এই বর্ণনা একই সঙ্গে সূর্যতেজোময়ী সরস্বতী এবং নদীরূপা সরস্বতীর ইঙ্গিত দেয়। আলো যেমন এঁকেবেঁকে যেতে পারে, তেমনই নদীর স্রোতও আঁকাবাঁকাভাবেই চলে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, আকাশের ছায়াপথ নামক অংশটিই হল দিব্য বা জ্যোতিরূপা সরস্বতী। কিন্তু এই মতকে সব পন্ডিতের মেনে নেন না।
দেবী সরস্বতীকে আমরা জানি শুধুমাত্র বিদ্যাদায়িনী হিসেবে। কিন্তু বৈদিক যুগে আরো অনেক গুণের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। 'প্রণো দেবী সরস্বতী বাজেভির্বাজিনীবতী' -- তিনি বাজিনীবতী অর্থাৎ অন্নদায়িনী। সূর্যকরের সাহায্যে জল মেঘরূপে বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। পৃথিবী শস্যশালিনী হয়। এভাবেই দেবী সরস্বতী কৃষি ও পশুবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে অন্নদাত্রী হয়ে ওঠেন। ঋষিদের বারবার প্রার্থনা, সরস্বতী যেন তাঁদের ধন দান করেন। নদী সরস্বতীর জলে সিক্ত উর্বর মাটিতে আর্যদের কৃষিভিত্তিক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল; নদীর জল তাঁদের বাণিজ্যিক সম্পদেও বৈভবশালী করেছিল। তাই দেবী হলেন ধনদাত্রী। পরবর্তী কালেও সরস্বতীর এই গুণের কথা মুছে যায়নি। তন্ত্রশাস্ত্রে দেবীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁর কাছে ঐশ্বর্য প্রার্থনা করা হয়েছে।
তিনি দানবদলনী। যে ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আর্যসভ্যতার বিকাশ, সেখানে নদী সরস্বতী প্রাকৃতিকভাবেই প্রহরীরূপে বিরাজিত ছিলেন। তাই আত্মরক্ষার জন্য আর্যরা সরস্বতীর কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পৌরাণিক যুগেও দেবীর এই শত্রুদলনী রূপটি বর্তমান ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে 'সরস্বতীমনুভজে শুম্ভাদিদৈত্যার্দিনীম্।'
সূর্যের তেজোরূপা হবার দরুণ সূর্যের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে তাঁকেই দান করা হয়েছিল। শুধু তাই নয় যখন যে দেবতা প্রাধান্য পেয়েছেন, তখন তাঁর গুণগুলিও সরস্বতীতে আরোপ করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই তিনি কখনও শত্রুদলনী, কখনও চিকিৎসকও বটে। এই কারণে তাঁকে সূর্য, ইন্দ্র, মরুৎ ও দেবচিকিৎসক অশ্বিনীকুমা্রদের স্ত্রী হিসেবেও উপস্থাপিত করা হয়েছে। পরবর্তী কালে তিনি ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর স্ত্রী বলে পরিচিতা হয়েছেন। ব্রহ্মা, পুরাণানুসারে বেদকে ধারণ করেছিলেন। জ্ঞানের উৎস এই বেদ, তাই ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত হলেন সরস্বতী বা সাবিত্রী। ত্রিদেব ধারণাতে বিষ্ণু ছিলেন প্রধান দেবতা, তাই প্রধানা দেবীকে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দেওয়াটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলেই ধরা হয়েছে।
দেবী সরস্বতীকে আমরা সবচেয়ে বেশি জানি বিদ্যার দেবী বলে। পরবর্তী বৈদিক যুগে সরস্বতী অন্য পরিচয় মুছে কেবলমাত্র বাগদেবী হিসেবে স্বীকৃতা হলেন। অথর্ব বেদে ও ব্রাহ্মণে তিনি বাগ্রূপা। 'বাক্ হি সরস্বতী / বাক্ বৈ সরস্বতী।' তিনি যজ্ঞরূপাও। এই হিসেবে এখন থেকে তিনি ব্রহ্মা বা বৃহস্পতির স্ত্রী বলে মান্যা হলেন।
অন্য সমস্ত গুণ সত্ত্বেও পরবর্তী কালে শুধুমাত্র বাক্ বা বাণীদেবী হওয়াকে পণ্ডিতেরা খুব অস্বাভাবিক মনে করেন না। বাক্য সমস্ত জ্ঞানের উৎস, জ্ঞানলাভে অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর হয়। তমসাবিদূরক বলতে, প্রাকৃতিক ও মানসিক দুই অন্ধকারই দূরকারী বলে সূর্যকে বন্দনা করা হত। তাই সূর্য ও পরবর্তীকালে বৃহস্পতির স্ত্রী বলে সরস্বতীকে জ্ঞানদাত্রী বলে চিহ্নিত করা অসঙ্গত নয়। এছাড়াও, যেমন প্রথমে বলেছিলাম, এই নদীর তীরে আর্যদের সভ্যতার ক্রমবিকাশ। এখানেই ঋষিরা লাভ করেছিলেন বেদ, নদীর তীর মুখরিত থাকত সাম মন্ত্রের উচ্চারণে। শ্রীরমেশচন্দ্র দত্ত মনে করেন, প্রথমে নদী দেবী বলে পূজিতা হলেন। পরে নদীর তীরে বিবিধ জ্ঞানযজ্ঞ ক্রমান্বয়ে অনুষ্ঠিত হতে হতে এই নদীই বিদ্যাদেবী হলেন।
অবশ্য সূর্যের কিরণস্বরূপা জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী যে নদী সরস্বতী হয়ে গেলেন, তার জন্য একটা সুন্দর গল্প ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পাওয়া যায়। বিষ্ণুর তিন স্ত্রী - লক্ষ্মী, সরস্বতী ও গঙ্গা। কে স্বামীর বেশি প্রিয়, সেই নিয়ে তিনজনের মধ্যে লেগে গেল ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত গঙ্গা সরস্বতীকে শাপ দিলেন, "যাও, পৃথিবীতে গিয়ে নদী হয়ে জন্ম নাও"। দেবী সরস্বতী নদী হয়ে নেমে এলেন আমাদের এই ধরায়।
যাই হোক্,এবার আসি সরস্বতীর রূপ-কথায়। যেখানেই সরস্বতীর কথা বলা হয়েছে, তাঁকে সর্বশুক্লা বলে অভিহিত করা হয়েছে। মনে হয়, সূর্যের শুভ্রজ্যোতির প্রতীক ও নদীর জলের স্বচ্ছতাই এই ধারণা তৈরী করতে সাহায্য করেছে। যদিও বৈদিক যুগে তাঁর চেহারা কেমন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তাঁর প্রাচীনতম মূর্তি দেখা যায় খ্রীঃ পূঃ দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী ভারহুত রেলিঙের গায়ে ।এই রেলিংটি কলকাতা জাদুঘরে রক্ষিত আছে। তুমি ইচ্ছে করলে দেখে এসো।
বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে তাঁকে 'সকলকলাত্মিকা' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই যখন তাঁর মূর্তি তৈরীর প্রশ্ন আসল, তখন কলাবিদ্যার প্রতীক হিসেবে তাঁকে একটা বীণা দেওয়া হল। বিখ্যাত তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সমস্ত শাস্ত্র ঘেঁটে সরস্বতীর যে ছয়টি ধ্যানমন্ত্রের উল্লেখ করেছেন, তাতে দেবীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ১) তাঁকে তুলনা করা হয়েছে কুন্দ, চন্দ্র ও তুষার অর্থাৎ বরফের সঙ্গে। মানে তাঁর বর্ণ এদের মত শুভ্র; সঙ্গে তাঁর পোষাক সাদা, তিনি বসে আছেন সাদা পদ্মফুলের উপর। এমনকি তাঁর বাহনও শ্বেতহংস। ২) বেশির ভাগ জায়গায় তিনি চতুর্ভুজা, পদ্ম, বীণা, বই, অক্ষমালা, কমণ্ডলু ও বরাভয় মুদ্রায় তাঁকে সাজানো হয়েছে। ৩) তিনি ত্রিনয়নী। এই তন্ত্রশাস্ত্রেই কোথাও তাঁকে দ্বিভুজা বলেও দেখানো হয়েছে। সরস্বতীর এক নাম সারদা। সাধারণতঃ তাঁর একটাই মুখ হলেও এই নামের পূজাতে তাঁর পাঁচটা মুখ এবং দশটা হাত।
মজার কথা হল, বৌদ্ধধর্মেও পরে যখন বুদ্ধ ছাড়াও অন্যান্য দেব-দেবীর আমদানি হল, দেখা গেল আমাদের সরস্বতী সেখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গিয়েছেন। অবশ্য তখন তাঁর নাম হল বজ্রতারা ও জাঙ্গুলীতারা। এছাড়াও ছিলেন সরস্বতীর আদলে কল্পিত বিদ্যার অধিষ্ঠাতা মঞ্জুশ্রী।
রাজা রবি বর্মার আঁকা সরস্বতী
জৈনধর্মেও সরস্বতী বেশ জনপ্রিয়। তিনি হলেন শ্রুত দেবতা - কেবল বা জ্ঞানের দেবী। কার্তিকী শুক্লাপঞ্চমীতে জৈনরা ধূমধাম করে এঁর পূজা করে থাকেন। এঁদের সরস্বতীর দুই হাত থেকে ষোলটি হাত পর্যন্ত দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে হাঁসের বদলে ময়ূরকে বাহন করা হয়েছে। লক্ষ্ণৌ মিউজিয়ামে পুস্তকধারিনী জৈনসরস্বতীর খুব প্রাচীন একটি মূর্তি আছে।
সাধারণভাবে রাজহাঁসকে আমরা সরস্বতীর বাহন হিসেবে জানলেও, মেষ, ময়ূর ও সিংহকেও বাহন হিসেবে দেখা যায়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মেষবাহনা মূর্তি আছে। মুম্বই অঞ্চলে ময়ূরবাহনা সরস্বতীর পূজা বেশি। পুরাতাত্ত্বিক কানিংহামের মতে প্রাচীনকালে সরস্বতীর তীরে ময়ূরের প্রাচুর্যই একে দেবীর বাহন করেছে। রাজা রবি বর্মা সরস্বতীর যে ছবি এঁকেছিলেন, সেখানেও সরস্বতীর বাহন রূপে রয়েছে একটি ময়ূর।
ওয়াশিংটনে দেবী সরস্বতীর মূর্তি
বহির্ভারতেও সরস্বতীর পূজা প্রচলিত আছে, বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, তিব্বত ও জাপানে। এছাড়াও গ্রীক দেবী আথেনা, মধ্যপ্রাচ্যের ইস্তার, রোমের মিনার্ভা ও আইরিশ ব্রিঘিদ্ প্রভৃতিদের রূপকল্পনায় সরস্বতীর প্রভাব দেখা যায়। একটা খবর হয়ত তুমি জান, তাও জানাই - আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি সি শহরে ম্যাসাচুসেট্স্ অ্যাভিনিউ বলে একটি রাস্তা আছে। এই রাস্তা এমব্যাসি রো নামেও পরিচিত, কারণ এই রাস্তায় এবং এর আশেপাশেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলি রয়েছে। প্রায় প্রতিটি দূতাবাস ভবনের সামনেই রয়েছে সে দেশের কোন না কোন বিখ্যাত মানুষের মূর্তি। ২০১৩ সালের জুন মাসে, ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে, কোন মানুষের বদলে স্থাপন করা হয় জ্ঞানের দেবী সরস্বতীর এক পনেরো ফুট উঁচু মূর্তি। সাদায় আর সোনালিতে সাজানো এই দেবীর পায়ের কাছে বসে বই পড়ছে তিনটি ছেলেমেয়ে।
বিভিন্ন পুরাণে সরস্বতীর রূপ বর্ণনায় শিবের মত মাথায় জটা ও কপালে চাঁদ দেখা যায়। আজকাল আমরা যেসব সরস্বতী মূর্তি দেখি তা শিল্পীরা এইসব বর্ণনাকে আশ্রয় করে মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরী করে থাকেন।
এত সব জানার পর, আমার ছোট্ট বন্ধু, মাঘমাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে সকালে স্নান করে সরস্বতীকে প্রণাম করে বলো, মনের বিদ্যাহীনতার সব অন্ধকার, সব জড়তা দূর হোক, জ্ঞানের আলোয় ভরে উঠুক তোমার ছোট্ট সরস মন।
'সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা'।
ছবিঃ পারিজাত ভট্টাচার্য্য, দাড়িদা, উইকিপিডিয়া