সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

(১)

ডিকু আজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর কোনদিন ফিরবেনা। মুন্নুদিদি থাক ওই ধুমসো গিব্বু কে নিয়ে। ওকেই আদর করুক, ওকেই কোলের কাছে নিয়ে ঘুমোক, আর ওকেই রোজ চুমু দিয়ে স্কুলে যাক ! ডিকু তো এখন পুরোনো হয়ে গেছে তাই না !

ব্যালকনির গ্রিল গুলো বেশ বড় বড়। তার মধ্যে দিয়ে একটু কায়দা করেই নিজেকে বাইরে গলিয়ে দিল ডিকু। খুব মনে পড়ছিল গত বছরের সেই রথের মেলার দিনটা। তাকে প্রথম দেখেই পছন্দ করে ফেলেছিল মুন্নুদিদি। তারপর ওর মা টাকা দিল দোকান-কাকুকে। আর কাকুও তাকে তুলে দিল মুন্নুদিদির কোলে। সেই থেকে সবসময় দুজন একসঙ্গে থেকেছে। এমনকি, পড়াশুনো করার সময়ও দিদি ওকে কোলে বসিয়ে রাখত। তাই নিয়ে কি কম বকুনি খেয়েছে মায়ের কাছে ?

ডিকুর মুখখানা খুব মিষ্টি! লাল টুকটুকে জামা গায়ে। মাথায় ফুরফুরে কালো চুল। একদম সত্যিকারের একটা বেবি-র মতো দেখতে। কিন্তু অত আদর কপালে সইল না তার। মুন্নুদিদির বাবা কয়েকদিন আগে  কোত্থেকে এক ধুমসো মতো ভালুক নিয়ে বাড়ি ফিরল। তারপরেই ...ডিকুর সব আদর গেল ! সারাদিন দিদি এখন শুধু গিব্বু গিব্বু করেই অস্থির ! ডিকু এখন খেলাঘরের তাকের উপর চুপচাপ পড়ে থাকে। আর মুন্নুদিদির কোলের কাছে  ওই পাজী গিব্বু বসে থাকে। এখনও বসে আছে।
         
ডিকু বেশ বড় একটা লাফ দিয়ে নেমে এল রাস্তায়। তারপর গুড়গুড়িয়ে চলতে লাগল ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে। বেশ রাত হয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে হুশ হুশ করে বড় বড় গাড়ি চলে যাচ্ছে। ওর কেমন ভয় ভয় লাগছিল। তাই রাস্তায় না গিয়ে বাড়ির পিছনের মাঠ বরাবর পা চালালো সে। কিছুদূর গিয়েই হাঁপ ধরে যাচ্ছে ! আহা রে ...কোলে চেপেই তো ঘুরতো এতদিন। ও বুঝি পারে অত হাঁটতে ? তাও থামে না ডিকু। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে চলতেই থাকে।
        
এমন সময় উপর থেকে বেশ জোরে একটা গুমগুম শব্দ শুনে চমকে গেল সে। তার পরেই কেমন জোরে জোরে হাওয়া বইতে লাগল। ডিকু জানে এটাকে ঝড় বলে। শুধু কি তাই ? বেশ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে যে!! বেচারা ডিকু কী করবে বোঝার আগেই রাস্তার সব লাইট নিভে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। ডিকু এলোপাথাড়ি ছুটতে ছুটতে একটা বড় গাছের কাছে এসে পড়েছিল। তারই একটা কোটরে ঢুকে পড়ল হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে।

(২)

ডিকু বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।হঠাত খুব ব্যথা পেয়ে জেগে উঠল। কারা যেন খুব জোরে জোর কামড়াচ্ছে ওকে ! অন্ধকারে দেখতে না পেলেও ওদের একজনের গায়ে হাত লেগে গেল তার। সে বুঝল এরা পিঁপড়ে । কিন্তু এত বড় পিঁপড়ে হয় নাকি ? আর কী জ্বালা তাদের কামড়ের ! সারা হাত পা ফুলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে বাইরে বেরিয়ে এল ডিকু। মুন্নুদিদিকে বড্ড মনে পড়ছে। সেই খেলাঘর,অন্যান্য পুতুল-বন্ধু...সব্বাইকে খুব মিস করছে সে। গাছের নীচে হাত পা ছড়িয়ে বসে উঁ উঁ করে কাঁদতে থাকে ছোট্ট ডিকু।
              
এমন সময় গ্রররররর করে কানের কাছে কে যেন ডেকে উঠল। ওমা ! এযে একটা বেশ বড় মোটাসোটা কুকুর! তারপরেই ওর ঘাড়টা কামড়ে কুকুরটা শুন্যে তুলে নিল ওকে। ব্যথায় আর ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল  ডিকু। কেমন আবছা আবছা মনে হল- ওকে মুখে করে হেলেদুলে চলছে বিচ্ছিরি কুকুরটা। কিন্তু তারপরেই আর একজন কে এসে বিকট স্বরে ঘাউ ঘাউ ভাউ ভাউ করে পাড়া কাঁপিয়ে এমন চিৎকার শুরু করল যে সেই মোটকা কুকুর ওকে মুখ থেকে ফেলে পালিয়ে গেল।

আস্তে আস্তে চোখ খুলে ডিকু থেকে ওর মুখের খুব কাছে মুখ এনে একটা রোগামতো সাদা কুকুর ওকে দেখছে। ভয়ে সে আবার চোখ বুজে ফেলল। কুকুরটা খুব নরম করে বলে উঠল- "তুমি কে গো ? কোন বাড়িতে থাকো ? কোন খুকুর পুতুল তুমি ? হারিয়ে গেছো বুঝি ? "

এতক্ষণে একটু স্নেহের ছোঁয়া পেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল ডিকু। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল-" আমি বাড়ি থেকে রাগ করে পালিয়ে এসেছি। আমাকে বাড়ি দিয়ে এসো। আমি মুন্নুদিদির কাছে যাব "।

কুকুর বলল-" এত রাতে তোকে নিয়ে কোথায় ঘুরব বলতো ? তার চেয়ে আমার ঘরে থাক আজ রাত্রিটা। কাল দেখা যাবে কী করা যায় ।"

আলতো করে ওকে মুখে করে নিয়ে কুকুরটা একটা বাড়ির সিঁড়িঘরে এসে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে চারটে কুকুরছানা ওদেরকে ঘিরে নাচানাচি শুরু করে দিল-" ও মা, এটা কাকে এনেছো ? এই,তোমার নাম কী? আমাদের সঙ্গে খেলবে ?"
     
ওদের মা বলল- " না রে বাছারা, আজ ওর শরীর ঠিক নেই। ওই কেলে কুকুরটা ওকে খেয়েই ফেলছিল। আমি না থাকলে আর বাঁচত না।" তারপর কানগুলো খাড়া করে লেজ নেড়ে বলল-" লোকে বলে এই পাড়ায় ভুলির মতো গলার জোর কারো নেই ! অনেক গুন্ডা কুকুরকে স্রেফ চেঁচিয়ে শায়েস্তা করেছি আমি ,বুঝলি ?"

ছেঁড়া চটের উপর শুয়ে ডিকু দেখল- একটা লোক এসে ভুলি-মাসি আর তার বাচ্চাদের জন্য ভাত আর মাছের কাঁটা দিয়ে গেল একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে। বাচ্চারা ওকে আড়াল করে রাখায় ওই লোকটা দেখতে পায়নি। খুব আনন্দ করে ওরা ডিনার করছিল। একটা বাচ্চা ডিকুকেও ডাকল খাওয়ায় জন্য। কিন্তু সে কী এসব খেতে পারে ? খাওয়া দাওয়া সেরে ভুলি-মাসি ওকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল-" তুই বরং দুধ খা একটু।" খিদের চোটে তাই খানিকটা চুকচুক করে খেল সে।

(৩)

পরদিন সকাল হতেই ভুলি-মাসি কোথায় যেন বেরিয়ে গেল।ওর বাচ্চারা পাহারা দিচ্ছিল ডিকুকে। সারারাত ঘুমিয়ে শরীরটা বেশ ভালো লাগছে ডিকুর। শুয়ে শুয়ে সে নতুন বন্ধুদের কাছে তার সেই ফেলে আসা খেলাঘরের গল্প বলছিল।

একটু পরেই বেশ ব্যস্ত হয়ে ভুলিমাসি এসে বলল- " চল ডিকু, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুই তো বাড়ির রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিস! তাই চিল্কাদাদা তোকে পিঠে নিয়ে অনেক উপর দিয়ে উড়বে। তুই তখন নিশ্চয়ই তোর বাড়ি চিনতে পারবি। আমার মনে হয় এই পাড়াতেই তোদের বাড়ি। বেশিদূর আসিসনি তুই" !

ডিকু ভয়ে ভয়ে বলল- "চিল্কা-দাদা আবার কে ? আমায় কামড়ে দেবে না তো ? "

ভুলি-মাসি হ্যাশ হ্যাশ ফ্যাশ ফ্যাশ করে খুব খানিকটা হেসে নিয়ে বলল-" তোর কোনো ভয় নেই। ওই চিল্কা-দাদা একবার ডানায় চোট পেয়ে পড়ে গেছিল রাস্তায়। আমি গিয়ে কামড়ে ধরেছি ... তখন খালি দুই ডানা জোড় করে বলছিল- "আমায়  ছেড়ে দাও গো ,তোমার উপকার করব।" ...  তো দিলাম ছেড়ে। আজ গিয়ে সেই কথা মনে করিয়ে দিলাম। ব্যাস! চিল্কাদাদা রেডি ! এবার চল..."

কুকুর বন্ধুরা একে একে এসে ছলছল চোখে চুমু দিল ডিকু কে। তারপর ভুলি মাসি তাকে মুখে করে নিয়ে ফাঁকা মাঠে আসতেই মস্ত এক চিল এসে তাকে পিঠে তুলে নিয়ে সোঁওওওও করে বেশ অনেকটা উপরে উঠে গেল। বলল- " দেখ দেখি নিচে তাকিয়ে , বাড়ি চিনতে পারিস ?" ডিকু আনন্দে ছটফট করে উঠল-" ওই যে চিল্কা-মামা, ওই হলুদ বাড়িটা ! ডানদিকে চলো-"

ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে ডিকুকে পড়ে থাকতে দেখতে পেল মুন্নুদিদিদের কাজের মাসি। তারপর তাকে তুলে নিয়ে ঘরে এসে বলল-" এই দেখো, মুন্নু বোধ হয় পুতুলটাকে ছাদে ফেলে এসেছিল। তারপর সেকথা ভুলে গিয়ে এখন সারাবাড়ি তে খুঁজে বেড়াচ্ছে।"  

ডিকু চমকে উঠল ! মুন্নুদিদি ওকে খুঁজেছে? আর সে কিনা বোকার মতো বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিল ?

(৪)

অনেক অনেক আদর খাওয়ার পর দুপুরে মুন্নুদিদির পাতে ভাত খেয়ে কোলের কাছে শুয়ে আছে ডিকু। দিদি ঘুমিয়ে পড়তেই অন্যপাশ থেকে ফিসফিস করে গিব্বু  বলল-"তুই আমার উপর রাগ করে চলে গেছিলি,তাই না ? মুন্নুদিদি কাল রাতে কত খুঁজল তোকে! ভালো করে ঘুমোয় নি। আজ সানডে...সারা সকাল তোকে এদিক ওদিক খুঁজেছে আর কেঁদেছে ! আজ থেকে তুই বরং দিদির কাছে শুবি...আমি খেলাঘরে থাকব।"

ডিকু হাত বাড়িয়ে গিব্বুর  ফুলো ফুলো হাতটা ধরে বলল-" না ভাই। তুই কোথাও যাসনা। আমরা দুই বন্ধু মিলে দিদির দুই পাশে শুয়ে ঘুমোবো, কেমন ? তারপর ডিকু বলতে থাকে তার কাল রাতের অ্যাডভেঞ্চারের গা-ছমছম করা গল্প! গিব্বুর নরম লোমগুলো খাড়া হয়ে ওঠে। গোলগোল চোখ দুটো আরো বেশি গোল করে সে বলে ওঠে-"তারপর কী হল ভাই ?"

ছবিঃ মহাশ্বেতা রায়

কম্পিউটার সায়েন্সে নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কয়েকবছর শিক্ষকতা করেছেন। ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালোবাসেন। ছোটদের জন্য ছড়া লিখতেও খুব ভালো লাগে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা