আশি বছর বয়সে ছোটবেলার স্মৃতি অনেক ফিকে হয়ে যায়। বিশেষ করে আমার বেলায় এই উপলব্ধিটা টের পাচ্ছি। আমাদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। সংসারের সদস্যরা ছাড়াও ছিল তিন-চার জন কবিরাজী শিক্ষার্থী, সংস্কৃত টোলের দুই-চার জন ছাত্র – তাছাড়া আমার দেখা দুই-তিন জন বিদ্যালয়ের ছাত্র যাদের এলাকায় স্কুল ছিল না। মা’র কাছে শুনেছি প্রতিদিনই সকাল ও সন্ধ্যায় পঞ্চাশ-ষাট জনের রান্নার ব্যবস্থা হত। আমাদের জন্মের পর থেকেই শুনতাম এটা কবিরাজ বাড়ি। আজও আমাদের বাড়ি ‘মসুয়া কবিরাজ বাড়ি’ বলেই পরিচিত। আশে পাশের ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দূরের লোকেদের কাছে আমাদের বাড়ি পরিচিত ছিল। এই কবিরাজী চিকিৎসা চার পুরুষ, অর্থাৎ প্রায় দেড়শো বছর ধরে চলছে। যদিও আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার। বাবার জীবনের শেষ দশ বছর তিনি আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পড়াশোনা ও গবেষণা করে নতুন নতুন ঔষধ আবিষ্কার করেছিলেন। যে খাতায় তিনি তাঁর গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নতুন ওষুধের কথা লিখেছিলেন, অবহেলায়, অযত্নে তা নষ্ট হয়ে গেছে।
আমরা খুড়তুতো, জ্যেঠতুতো ভাইবোন মিলে ছিলাম আট-নয় জন (অবশ্য এখানে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের কথা বলা হচ্ছে)। ফলে সারাদিন আমরা খেলাধূলা, আনন্দের মধ্যে সময় কাটাতাম। আমাদের মধ্যে আমি ছিলাম মারকুটে, - তাই সবাই গুন্ডা বলে ডাকত। বারো মাসে তেরো পার্বণের বাড়ি ছিল আমাদের। কবিগান, যাত্রা, থিয়েটার লেগেই থাকত। বিশেষ করে প্রতি বছর কৃষ্ণলীলার আসর বসত এক মাস ধরে। আমরা খুব উপভোগ করতাম। বিরাট সামিয়ানা টানিয়ে, নিচে বসার ব্যবস্থা করা হত। রাত জাগতে পারতাম না বলে ভাই বোনেদের সংগে যাত্রা – নাটক দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়তাম।
পড়াশোনা যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলে রাখি, আমাদের বাড়ির কোনও ছেলেমেয়ে তৃতীয় শ্রেণির আগে বিদ্যালয়ে ভর্তি হত না। তাই আট বছর বয়সে আমার বাবা আমাদের পাশের বাড়ির শিক্ষক দাদাবাবুর (শ্রীযুক্ত হরিপদ ভট্টাচার্য্য মহাশয়) সঙ্গে আমাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পাঠিয়ে দিলেন। তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রথম দিনটা আমার কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের। আসলে বিদ্যালয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। ক্লাশে আমার পাশে বসা ছেলেটির সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম। প্রথম পিরিয়ডে বাংলার ক্লাশ ছিল পন্ডিতমশাইয়ের। আমাকে ডাকলেন। আমি গেলাম এবং তিনি সজোরে আমার বাঁ গালে এমন চড় কষিয়েছিলেন যে হাতের পাঁচটি আঙুল গালে ফুটে উঠেছিল। বিদ্যালয় জিনিসটা যে কি সেটা আমি তখন কিছুটা উপলব্ধি করতে পারলাম। গর্ব করে বলছি না,- এরপর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত আর কোনওদিন কোনও কারণেই আমি মার খাইনি বা তিরষ্কৃত হইনি। বিদ্যালয়ের দিনগুলিতে মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবেই আমি পরিচিত ছিলাম।
আমার বাবা ছিলেন ডাক্তার। আমার কাছে তিনি ছিলেন আমার শিক্ষাগুরু। বইকে কী করে ভালোবেসে পড়তে হয় আমার অজান্তেই তিনি তা আমাকে শেখাতেন। মুখে মুখে অংক করার পদ্ধতি, বাংলা ও ইংরেজি বাক্যগঠন, আমাকে গল্পচ্ছলে শেখাতেন। এছাড়া আমার লেখাপড়ার পিছনে বাবার সার্বিক পরিশ্রম ছিল অনন্য। ভূগোল ভালো করে পড়তে ইচ্ছে করত না। বাবা তিন-চার দিন শুধু ভূগোল পড়িয়ে, বুঝিয়ে দিলেন। ব্যস্, পরীক্ষার সিলেবাসে উনচল্লিশ পৃষ্ঠা ভূগোলের পড়া পুরোটাই বাবাকে একটানা মুখস্থ করে শুনিয়েছিলাম। আমার প্রাপ্তি হয়েছিল নতুন শ্লেট ও পেন্সিল।
রাত জাগতে পারতাম না বলে আমি প্রায়ই আটটা, সাড়ে আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা প্রায় প্রতিদিনই আমাকে রাত আড়াইটা, তিনটার মধ্যে ডেকে দিতেন এবং তিনি জেগে থাকতেন এই কারণে যে আমি যদি কোনও কারণে ভয় পাই। আমি একটানা সকাল ছয়টা-সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত পড়তাম।
প্রতি বছর আমাদের গ্রামে পাঁচ-ছয়টি দুর্গাপূজা হতো। কিন্তু পূজার প্রকৃত আকর্ষণ ছিল আমাদের বাড়ির দুর্গাপূজায়। গ্রামের প্রায় সমস্ত লোকই আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রিত হতেন। তা ছাড়া বিসর্জনের বিশেষ আয়োজন ছিল আমাদের বাড়িতে। পুকুরের পূর্বদিকে বাজির গাছ বানানো হতো। গাছের কান্ড ও ডালপালা হতো বাঁশের। ঐ সব ডালপালায় রাখা হতো বাজিগুলি। দেখতে খুব সুন্দর লাগতো। বিসর্জনের সময় ঐ বাজিগাছে আগুন দিলে চারদিক থেকে বাজি ফাটতে শুরু করত। সে এক মজার দৃশ্য!
সুখের দিনগুলি চলতে চলতে হঠাৎ থেমে গেল। একান্নবর্তী পরিবারের সংসার ভেঙে গেল। প্রত্যেকের আলাদা সংসার হলো। জ্যেঠা মহাশয় বাড়ির উত্তরদিকে নতুন বাড়ি বানালেন। আমরা বলতাম – নয়া বাড়ি। সেজকাকা, ধনকাকাও তাঁদের নিজস্ব বাড়ি বানালেন। পুরানো বাড়িটাতে মূলতঃ আমরাই থাকতে লাগলাম। আলাদা আলাদা বাড়ি হলেও আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কোনও তিক্ততা কোনওদিনই হয় নি।
১৯৫০ সাল। আমাদের পরিবারে ভয়ংকর বিপদ নেমে এল। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে আমার বাবা মারা গেলেন। আমাদের দাদা থাকতেন কোলকাতায়। দেশ ভাগ হওয়ার পরেও আমরা থাকতাম একই জায়গায় – পূর্ব পাকিস্তানে। বলা হয়নি, আমার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে। মনীষী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়ের পিতৃভূমিই আমাদের গ্রাম। তখন অবশ্য বলা হত পূর্ব পাকিস্তান। দেশভাগের পর অনেক লোক নিরাপত্তার অভাব বোধ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে লাগলো। আমাদের গ্রাম থেকেও বহু লোক চলে গেল। বাবার মৃত্যু, গ্রাম ছেড়ে লোকজনদের চলে যাওয়ার মধ্যেই আমার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমার বয়স তখন মাত্র এগারো পেরিয়ে বারোর কাছে। মা একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। ঘরে ছিলাম আমরা তিনজন, - ছোটবোন, ভাই ও আমি।
মাকে ওষুধ খাওয়ানো, খাবার খাওয়ানো, মাথা ধোয়ানো, বেডপ্যান ব্যবহার করে প্রস্রাব ও পায়খানা করার দায়িত্ব কীভাবে পালন করেছিলাম তা এখন ভাবতেই পারি না। সারাদিন কীভাবে কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না। এদিকে ছোটভাই, যে আমার থেকে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট, হাঁপানিতে ভুগছিল। মাঝে মাঝে হাঁপানির টান বেড়ে গেলে খুবই দুশ্চিন্তা হতো। সংসারের রান্নার ভার গিয়ে পড়েছিল আমার ছোটবোনের ওপর – যার বয়স তখন মাত্র দশ বছর। কিন্তু খাবার জোগাড় করা ছিল আমারই কাজ। ধান বিক্রি করেই আমাদের সংসার চলত। মাঝে মাঝে দাদাও কিছু টাকা পাঠাত। মার চিকিৎসার কোনও খরচ ছিল না – আমার কাকাই চিকিৎসা করতেন। পুরো এক বছর আমার মা শয্যাশায়ী ছিলেন। মাকে যেদিন বিছানায় বসানো হল, কী আনন্দ যে আমাদের হয়েছিল! ঐ একটি বছর বিদ্যালয়ে যেতে পারি নি। কিন্তু ক্লাশে প্রথম হতাম বরাবর, তাই আমাকে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরের ক্লাশে প্রমোশন দিয়েছিলেন। এই একটা বছর আমার কাছে ছিল ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের।
ছোটবেলা থেকেই আমি আমার নিচের ক্লাশের ভাইবোনেদের পড়ায় সাহায্য করতাম এবং তাদের পরীক্ষা নিয়ে নম্বর দিতাম। বড় হয়ে শিক্ষকতা করব এই শপথ নিতাম। কিন্তু শেয পর্যন্ত কারখানাতেই চাকুরি নিতে হল। কিন্তু শিক্ষক হওয়ার সুপ্ত বাসনা আমাকে সব সময়ে সচল রাখত। হয়ত সেই কারণেই চাকুরি থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার পর নিজেদের বাড়িতে তৈরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে নিজের সুপ্ত বাসনাকে খানিকটা সম্মান জানাতে পারলাম।
যে গ্রামে আমি জন্মেছি সে গ্রামে হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। শীতকালে আমন ধান কেটে নেওয়ার পর ফাঁকা জমিতে আমরা সবাই ফুটবল খেলতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম। সেখানে ধর্মের কোনও বিভাজন ছিল না। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে নিজেরাই চাঁদা তুলে বনভোজন করতাম। কোনও বাধাই তো ছিল না। সবাই মিলে আনন্দটা ভাগ করে নিতাম।
গরমের ছুটিতে আম কুড়ানো, ঢিল দিয়ে গাছ থেকে আম পাড়া আর বড়দের শাসানি আমরা গায়েই মাখতাম না। বরং কিছু ছেলেমেয়ে এক হয়ে পরবর্তী দুষ্টুমির পরিকল্পনা করতাম। গরমের ছুটির আগে কিছুদিন সকালবেলায় আমাদের ইস্কুল হতো। সময়ের এই পরিবর্তন আমরা খুবই উপভোগ করতাম কারণ দুষ্টুমির জন্য সময় পাওয়া যেত বেশি।
আমার বয়স তখন সাত-আট বছর। পরপর দুটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে যে শিহরণের সৃষ্টি হয়েছিল তাও এখানে লিখছি। আজও মনের মধ্যে এ ঘটনাগুলি সংরক্ষিত আছে।
প্রথম ঘটনা – আমাদের প্রতিবেশিদের বাড়িতে কয়েকদিন আগে চুরি হয়েছিল। চোরদের সম্বন্ধে ছোটবেলায় আমাদের ভাইবোনদের চোখের সামনে একটি কাল্পনিক চেহারা ভেসে উঠত। বিরাট গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল,- হ্যাঁ, একটা দৈত্যের মতো মুখের বিদঘুটে চেহারার প্রাণি। তা চুরির ঘটনার দুই-তিন দিন পর চোর ধরা পড়ল এবং চোরকে নিয়ে আসা হল। আমরা সবাই মিলে দৌড়ে চোরকে দেখতে গেলাম। ওমা! চোর তো দেখি আমাদেরই মতো একটা মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে কল্পনায় থাকা একটা চোরের চেহারা সেদিনই বিদায় নিল।
দ্বিতীয় ঘটনা – ঐ একই বয়সে, বড়দের আলোচনায় শুনতে পেতাম ইংরাজদের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রাম করেন তাঁদের কাউকে কাউকে আন্দামানে নির্বাসন দেওয়া হত। শুনতাম ভীষণ সমুদ্রের মাঝখানে একটা দ্বীপ আন্দামান। বিপ্লবীদের শাস্তি দেওয়ার জন্যই ঐ নির্জন দ্বীপে পাঠানো হতো। ওরা ছিলেন বৃটিশ সরকারের চোখে ভয়ংকর যোদ্ধা। আমাদের জ্যেঠিমার এক ভাইপো কে আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি মুক্তি পেলেন। তিনি তাঁর পিসি অর্থাৎ আমার জ্যেঠিমার সাথে দেখা করতে আমাদের গ্রামে এলেন। আমরা ভাইবোন সকলে মিলে বড়দের সঙ্গে ওনাকে দেখতে এলাম। ভদ্রলোককে দেখামাত্র আমাদের উৎসাহ একেবারে চুপসে গেল। এই লোকটি কী করে ইংরাজ সরকারের চোখে এত বিপজ্জনক বুঝলাম না। তিনি তো আমার বাবা, কাকাদের মতোই একজন ভদ্রলোক মাত্র! আমাদের কাছে নিয়ে অনেক আদর করলেন। কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝেছিলাম, আন্দামান ফেরৎ একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে দেখেছি, খুব গর্ব হতো।
মাঝে মাঝে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। যখন আমি খুব ভোরের দিকে উঠে পড়াশোনা করতাম তখন একজন গ্রাম্য মুসলমান ভদ্রলোক আমাদের বাড়ির উঠান দিয়ে গান গাইতে গাইতে ভোরের বার্তা দিতেন,-“ ঘুম যাইও না, ঘুম যাইও না জাইগ্যা থাহো মন, একদিন ঘুমাইতে হইব জনমের মতন”। কোনও রকম পুঁথিগত বিদ্যার সাহায্য ছাড়াই মানবজীবনের মূল্যায়ণে তাঁর পান্ডিত্য বড় হয়ে অনুভব করেছি।
দীপাবলী পূজা উপলক্ষ্যে আমরা খুব হৈচৈ আনন্দ করতাম। কলাগাছ কেটে মাটিতে বসিয়ে তাতে আনুমানিক ছয়-সাত ইঞ্চি বাঁশের কাঠি ঢুকিয়ে রাখতাম। সন্ধ্যায় সেই কাঠিতে মোমবাতি বসিয়ে আগুন দিতাম। অনেকগুলি কাঠি থাকাতে দেখতে খুব ভালো লাগতো। তা ছাড়া কালীপুজো শুরু হওয়ার আগে অন্তত ছয়-সাতখানা হ্যাজাক লাইট জ্বালানো হত। বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে, পিছনের পুকুর পাড়ে ও বাড়ির দক্ষিণদিকে হ্যাজাক লাইট রাখা হত। ফলে সারা বাড়িটা আলোয় ভরে যেত। আমরা ঐ আলোতেই পুকুর পাড়ে সমস্ত ভাইবোনেরা লুকোচুরি খেলতাম। আমাদের কোনও ভয় হতো না। সারাদিন আনন্দ করতাম ঐ দিনটায়।
আমাদের বাড়ির প্রত্যেক ভাইবোনদের সাঁতার শেখা ছিল একটা অবশ্যকর্তব্য কাজ। সাত -আট বছর বয়সেই সেটা শিখতে হতো। বাড়ি থেকে তিন তিনটা উঠোন পার হলেই পুকুর। সে পুকুরটা ছিল বাঁধানো, লম্বা চওড়া বড় বড় সিঁড়িগুলো ছিল ওঠানামা এবং গল্প করার জন্য আদর্শ। সিঁড়ি শুরু হওয়ার আগের বড় চাতালে বসে বয়স্ক লোকেরা পাশা খেলতেন। আমরা শিশু বয়স থেকেই দেখে আসছি ঐ চাতালে রঙিন সিমেন্টে পাশা খেলার ঘর কাটা ছিল। যা হোক আমার সাঁতার শেখার গল্প একটু অন্য। আমাদের বড়মা ছিলেন বাল্যবিধবা ( আমার বড় জ্যেঠা মহাশয় কলকাতায় ডাক্তারি পড়তে এসে পাশ করেন কিন্তু দেশের বাড়িতে ফেরার দুই-তিন দিন আগে কলেরায় মারা যান। বড়মা তাই বাল্যবিধবা)। সেই বড়মার ঘাড়ে চড়ে পুকুরের এপার ওপার সাঁতার চলতো। পুকুরের জলের ভয় ধীরে ধীরে কেটে গেল দেখে বড়মা একদিন একটা পিতলের কলসী উপুর করে দিয়ে হাত দিয়ে ধরে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে সাঁতার কাটার কথা বললেন। খানিকটা গিয়ে কলসী হাত থেকে সরে যায় আর আমিও ডুবে যাচ্ছিলাম দেখে বড়মা অন্ততঃ সাত-আট ফুট দূর থেকে এসে আমাকে তুলে ঘাটে নিয়ে আসেন। পেটে খানিকটা জল ঢুকেছিল। আমি কিন্তু ভয় না পেয়ে পরের দিন থেকে আবার কলসী নিয়ে ভাসতে ভাসতে সাঁতার শিখে ফেললাম। যেদিন সাঁতার কেটে বড়মার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের অন্যপাড়ে পৌঁছালাম সেদিন বড়মা একটা ক্ষীরের নাড়ু দিয়েছিলেন।
আমাদের গ্রামের আশেপাশের তিনটি মেলা ছিল আমাদের কাছে প্রবল আকর্ষণের। মেলার দিন যতই এগিয়ে আসত আমরা ততই অস্থিরচিত্তে মেলার দিন গুণতাম। আমাদের বাড়ির পূর্বদিকের পুকুরপাড় থেকে দুই-তিন বিঘা দূরে মেলা বসত পৌষ মাসের শেষ দিকে। বার্ষিক পরীক্ষার ফল বেরিয়ে যাওয়ার পরে অফুরন্ত অবসর – পড়াশোনার বালাই নেই – অতএব সকাল থেকেই বার বার মেলার মাঠে ঘুরতে যেতাম। মেলার সময়কাল ছিল অনুমান সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত। বাবা, কাকা, জ্যেঠা মহাশয়দের কাছ থেকে মেলায় যাওয়ার চাঁদা নিতাম।আটআনা হয়ে গেলে রাজার মতো চলতাম। কাঁচা আম কেটে খাওয়ার জন্য ছোট ছুরি কিনতাম। বাদাম খেতাম। দ্বিতীয় মেলা বসতো সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়দের বাড়ির উঠোনে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে। ঐ মেলায় প্রচুর খেলনা, পুতুল ও নানারকম খেলার জিনিস পাওয়া যেত। আমরা বিন্নিধানের খৈ কিনে আনতাম। চিনি দেয়ে বানানো মঠ, খেলনা কিনে মজা করে খেতাম। আর একটা বড় মেলা ছিল রথের মেলা। আমাদের ইস্কুলের কাছেই ছিল গুপীনাথ ঠাকুরের মন্দির। মন্দির সংলগ্ন বিশাল মাঠের একপ্রান্তে অন্ততঃ ত্রিশ-চল্লিশ ফুট উঁচু রথ দাঁড়িয়ে থাকত। রথের দিনে সারা পাড়া উজাড় করে ঐ রথের মেলায় চলে যেতাম। রথের রশি কোনওদিন ধরতে দেওয়া হতো না। কারণ হাজার হাজার লোকের মধ্যে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু নানারকম জিনিসপত্র কিনে আনতাম। এই মেলাগুলি ছিল আমাদের জীবনের রসদ। অন্যতম সুখ স্মৃতির ভান্ডার।
আমাদের বাড়ির পরিচয় ছিল কবিরাজ বাড়ি। কবিরাজী চিকিৎসা হাতে কলমে শিখবার জন্য তিন-চার জন ছাত্র থাকতেন। তাদের থাকার জন্য আলাদা ঘর ছিল। তাছাড়া ছিল সংস্কৃত টোল। ঐ টোলে ছাত্রেরা সংস্কৃত পড়তে আসতেন। আমার 'গোরা' জ্যেঠা মহাশয় (শ্রীযুক্ত অমরচন্দ্র তর্কতীর্থ মহাশয়) ছাড়াও এক-দুই জন শিক্ষক মিলে সংস্কৃত পড়াতেন। শ্রীযুক্ত অমরচন্দ্র তর্কতীর্থ মহাশয় পরবর্তীকালে তারকেশ্বরের মোহান্তের আমন্ত্রণক্রমে তারকেশ্বর সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়ে আমৃত্যু কাজ করেছেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরে ঐ সংস্কৃত টোলে আর ছাত্র দেখিনি। আমরা সব ভাইবোনেরা লুকোচুরি খেলার জন্য ঐ ঘর ব্যবহার করতাম।
সংস্কৃত টোল ঘরের পাশেই ছিল গ্যারেজ। আমার জন্মের পরে বড় হওয়ার সাথে সাথে ঐ গ্যারেজে গাড়ি রাখা আছে দেখতাম। পরবর্তীকালে শুনেছি শহরে যাওয়া আসা ও মামলা মোকদ্দমা ইত্যাদি কাজের জন্য ঐ মোটরগাড়ি কেনা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের গাড়ির ড্রাইভার পশ্চিমবঙ্গে চলে আসায় আর ড্রাইভার পাওয়া যায় নি। ফলে ধীরে ধীরে গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ভেঙেচুরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
মাথার উপরে সীমাহীন আকাশ ছাদই ছিল আমাদের বাল্য শৈশবের ঘর। বাড়ির তিন-তিনটি উঠোন জুড়েই চলত সারাদিনের দাপট। খুড়তুতো-জ্যেঠতুতো ভাইবোন মিলে প্রায় সমবয়সী ছিল আমরা আট-নয় জন। কখন যে বাল্যকাল শেষ হয়ে শৈশবও চলে গেল বুঝতেই পারলাম না। অবশ্য আমার এগারো বারো বছর বয়স ছিল খুব সাবধানে থাকার বয়স। শয্যাশায়ী মাকে চব্বিশ ঘন্টা দেখাশোনা করা ও এক বছর স্কুলে না যাওয়াটার ব্যাপারেও কোনও ভাবনা করার সময় ছিল না। সময় তার মতো এসে চলে যেত। এর মধ্যে ছোট ভাইয়ের হাঁপানির কষ্ট মাসে এক-দুই দিন ধরে হতো যদিও শীতকালে ও ঋতু পরিবর্তনের সময়ে অনেক বেশি হতো। এত ছোট ভাইয়ের হাঁপানির কষ্ট দেখে খুবই বিচলিত হতাম। এমনকি ঝড়ের রাতে রাত্রি দু’টো নাগাদ হোমিও ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়ে তাঁকে ডেকে ওষুধ এনে খাওয়াতে হয়েছে। তখন আমার মাত্র এগারো কি বারো বছর বয়স। এজন্য অবশ্য সারা শৈশবে আমার কোনও অনুশোচনা আসে নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই আমি আমার দায়িত্ব সামলাতে পেরে বড় হয়ে যখন ভাবতাম তখন খুশি হতাম।
আজ আশি বছর বয়সে শৈশবের সেই সীমাহীন আকাশের ছাদের স্পর্শটুকুও পাই না। পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ছেড়ে আসার পর থেকেই আকাশও অনেক দূরে চলে গেছে।
ছবিঃ পার্থ মুখার্জি