কার্যত বিলুপ্তির মুখে এসে দাঁড়াল আরো একটি উপপ্রজাতি। মার্চ মাসের ১৯ তারিখে কেনিয়ার ওল পেজেতা সংরক্ষণাগারে মারা গেল পৃথিবীর শেষ পুরুষ উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার, সুদান। ১৯৭৫ সালে তাকে সুদান থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চেকোস্লোভাকিয়ার একটি চিড়িয়াখানায়। স্বাভাবিক বাসভূমিতে প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশায় ২০০৯ সালে আরো তিনটি সাদা গন্ডারের সঙ্গে সুদানকে ওল পেজেতায় নিয়ে আসা হয়।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী সুদান বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিল অনেক দিন ধরেই। শেষ দিনগুলিতে চোরাশিকারীদের কবল থেকে বাঁচানোর জন্য সশস্ত্র রক্ষীদের পাহারায় রাখা হত তাকে।
এশিয়ার অনেক দেশে ওষুধ তৈরির জন্য গন্ডারের শিঙের বিশাল চাহিদা। এই চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার গন্ডার চোরাশিকারীদের হাতে মারা পড়ে। গন্ডারের পাঁচটি উপপ্রজাতির মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলীয় কালো গন্ডার ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ের মত কিছু দেশ গন্ডারদের শিং কেটে ফেলে চোরাশিকার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করেছে। যুদ্ধ ও চোরাশিকারের কারণে আফ্রিকায় গন্ডারদের প্রাকৃতিক বাসস্থানে টিঁকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুদানের মৃত্যুর পরে দু'টি মাত্র উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার বেঁচে রয়েছে। এরা সুদানের মেয়ে ও নাতনি - নাজিন আর ফতু। সুদানের থেকে সংগৃহীত জিনগত উপাদান ব্যবহার করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উপপ্রজাতিটিকে জিইয়ে রাখা যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। অবশ্য 'সেভ দ্য রাইনো' র মত অনেক বেসরকারী পরিবেশবান্ধব সংস্থার মতে এইভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা বৃথা হবে। তাঁরা বলছেন, এর চেয়ে বেশি জরুরী হল হাতে সময় থাকতে অন্য উপপ্রজাতিগুলিকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা।
আফ্রিকার দেশগুলিতে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধের ফলে সংকুচিত হয়েই চলেছিল সাদা গন্ডারের স্বাভাবিক বাসভূমি। লাগামছাড়া চোরাশিকার তাদের আরো বিপন্ন করে তুলেছিল। এভাবেই জীবজগতের বড়দা মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলে নিত্য এক একটি করে পশু পাখির প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।এসো, আজকের লেখায় ঘুরে দেখি এরকম কয়েকটি প্রজাতিকে, আমাদের দোষে যারা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেছে।
১.ডোডো
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়াম অফ ন্যাচ্রাল হিস্টরি তে ডোডো পাখির প্রমাণ মাপের মূর্তি
ডোডোপাখির নির্বুদ্ধিতার কথা প্রবাদপ্রতিম। ইংরেজিতে একটা বাক্য ব্যবহার করা হয়, 'ডাম্ব অ্যাজ আ ডোডো', অর্থাৎ কিনা ডোডোপাখির মত বোকা। 'আইস এজ' নামক অ্যানিমেটেড মুভিটিতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে ডোডোদের বোকামির জন্য তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু সেই গল্পে যাই দেখাক না কেন, আসলে হয়তো ডোডোদের বোকামি ছিল মানুষকে ভয় না পাওয়া।
ছোট্ট দ্বীপ মরিশাস এবং তার আশেপাশে কিছু দ্বীপে ডোডোরা থাকত। এরা বড়সড় চেহারার পাখি ছিল। ওড়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না। ডাচ নাবিকরা এসে মরিশাসে বসতি করার আগে হয়তো ডোডোরা মানুষ বেশি দেখেনি। মানুষের থেকে সাবধান হওয়ার প্রয়োজনটাই তারা বুঝতে পারেনি। তার ওপর মানুষে তাড়া করলে বড় চেহারায় দৌড়ে পালানোটাও সহজ হত না। জাহাজডুবি হয়ে মরিশাসের কাছে একটি দ্বীপে এসে ওঠা ডাচ নাবিক ভলকার্ট এভার্টজ (Volkert Evertsz) এও লিখেছেন, যে একটি ডোডোকে ধরতে পারলে তার চিৎকার শুনে তার সঙ্গীসাথীরাও তাকে বাঁচাতে ছুটে আসত। এরকম বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারকে বুঝি বোকা বলতেই হয়!
নাবিকরা এত সহজ শিকার ছাড়েননি, শ'য়ে শ'য়ে ডোডো মেরে তাদের মাংস খেয়েছেন। উপরন্তু তাঁদের সঙ্গে করে আনা কুকুর, বিড়াল, শূকর ও ইঁদুররা খেয়ে শেষ করেছে ডোডোদের ডিম। যে জঙ্গল তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ছিল, সে সব কেটে সাফ করা হয়েছে মানু্ষের থাকার জায়গা করার জন্য।
ডোডোদের শারীরিক গঠনের সঙ্গে পায়রার শারীরিক গঠনের কিছু মিল ছিল বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন। পায়রার ডাকের সঙ্গে এদের ডাকেরও মিল ছিল বলে অনেকের মত। এঁরা বলেন, 'ডোডো' নামটি এসেছে এই 'ডু-ডু' আওয়াজ থেকে। অবশ্য ডোডোর নামকরণ নিয়ে কোনো একটি প্রামাণ্য মত নেই। অনেকে বলেন 'ডোডো' নামটি এসেছে ডাচ শব্দ 'ডোডুর' (Dodoor) থেকে, যার মানে 'অলস, ধীরগতি'। অনেকে আবার মনে করেন যে পর্তুগীজ শব্দ 'ডাওডু' (Doudo) - যার অর্থ 'বোকা' বা 'খ্যাপাটে' - থেকে ডোডো নামের উৎপত্তি।
ডাচ নাবিকদের স্মৃতিকথায় ডোডোর প্রথম দেখা পাওয়া যায় ১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দে। শেষ ডোডোপাখি ১৬৬২ সালে দেখা গিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
২. মোয়া এবং হাস্ট'স ঈগল
মোয়ার কঙ্কাল
বিশালদেহী ডানাহীন পাখি মোয়ার (Moa) ন'টি উপপ্রজাতি ছিল নিউজিল্যান্ডের বাসিন্দা। অস্ট্রিচ, এমু, রিয়া পাখিদের সঙ্গে এদের চেহারাগত মিল ছিল। পার্থক্য এক জায়গায় - এই পাখিদের নামমাত্র হলেও ডানার অস্তিত্ব আছে; মোয়ার ডানা বলতে কোনো অঙ্গই ছিল না। সব চেয়ে বিরাটকায় উপপ্রজাতির মোয়া উচ্চতায় ১২ ফিট পর্যন্ত যেত, এবং তাদের ওজন ২৩০ কেজি অবধি পৌঁছতে পারত বলে জানা গেছে। নিউজিল্যান্ডে মানুষের পদার্পণের আগে দানবাকৃতি এই পাখিকে শিকার করতে পারত একটি মাত্র প্রাণী - আরেক অধুনা বিলুপ্ত বিশাল পাখি, হাস্ট’স ঈগল (Haast's eagle)।
শিল্পীর কল্পনায় মোয়া আর হাস্ট'স্ ঈগলের সঙ্ঘাত
নিউজিল্যান্ডে ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের কিছু আগে মানুষের আগমন হয়। মাওরি উপজাতির মানুষরা এসে পৌঁছনোর একশো বছরের মধ্যে মোয়া পাখি সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মাওরিরা মোয়ার মাংস খেতেন, তার চামড়া ও পালক দিয়ে পোশাক তৈরি করতেন, এমনকি মোয়ার হাড় দিয়ে তৈরি করা হত মাছ ধরার কাঁটা-বঁড়শি ও গয়নাগাটি। মানুষের সঙ্গে যুঝে উঠতে পারেনি যুদ্ধে অনভ্যস্ত পাখি। জঙ্গল কেটে মানুষ তার বাসস্থানও কেড়ে নিয়েছে। মোয়া তো বটেই, তার মাংস খেয়ে জীবনধারণ করত যে হাস্ট'স ঈগল, সেও খাদ্যাভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মানুষ এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে আক্ষরিক অর্থেই।
৩. কোয়াগা
১৮৭০ সালে লন্ডন চিড়িয়াখানায় তোলা জীবিত কোয়াগার একমাত্র ছবি
সাউথ আফ্রিকার বাসিন্দা এই প্রাণীটির নামটি গালভরা বটে, আদতে কিন্তু এই কোয়াগা ছিল আমাদের চেনা জেব্রার জাতভাই। তফাৎ ছিল গায়ের ডোরার প্যাটার্ন ও রঙের। কোয়াগার শরীরের সামনের অর্ধেক ভাগ কেবল সাদার ওপর খয়েরী ডোরা কাটা ছিল। পিছনের অর্ধেক ছিল পুরো বাদামী রঙের। অতএব এদের দেখে মনে হত যেন আধখানা জেব্রা এবং আধখানা ঘোড়াকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। 'কোয়াগা' নামটি সম্ভবত এসেছে এদের ডাকের আওয়াজ থেকে, যা 'কোয়া-হা-হা' র মত শুনতে লাগত।
কোয়াগারা জেব্রা কুলের দক্ষিণতম উপপ্রজাতি ছিল। সংখ্যায় খুব বেশি তারা ছিল না কখনোই। সাউথ আফ্রিকায় বসতি করতে আসা ডাচরা এবং তাঁদের বংশধর আফ্রিকেনাররা কোয়াগা শিকার করতে পারতেন সহজেই। কোয়াগার মাংস এবং চামড়ার চাহিদা ছিল। তা' ছাড়া ঘাসজমি ছিল সীমিত। বাইরে থেকে আসা লোকজনরা চাননি তাঁদের গবাদি পশুদের খাদ্যে কোয়াগারা ভাগ বসাক। অনেক কোয়াগাকে ধরে ইউরোপের চিড়িয়াখানাতে প্রদর্শন করার জন্য পাঠানোও হত। আজ অবধি জীবিত অবস্থায় কোয়াগার একটি মাত্র ছবি তোলা গেছে। ১৮৭০ সালে ছবির ফ্রেমবন্দী হওয়া সেই মেয়ে কোয়াগাটি লন্ডন জু তে থাকত।
স্বাভাবিক কিছু জেব্রার সঙ্গে কোয়াগা প্রজেক্টে জন্মানো কিছু জেব্রা, যারা শুধু দেখতে কোয়াগার মত
১৯৮৭ সালে রাইনহোল্ড রাউয়ের উদ্যোগে 'কোয়াগা প্রজেক্ট' শুরু হয় যার উদ্দেশ্য ছিল সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে জেব্রার গায়ে ডোরার সংখ্যা কমিয়ে কোয়াগার মত দেখতে জেব্রা সৃষ্টি করা। কোয়াগাদের চেহারাগত বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনার এই চেষ্টাকে 'ব্রিডিং ব্যাক' বলা হয়ে থাকে। মার্চ ২০১৬ তে ১১৬টি পরীক্ষাধীন জেব্রা ছিল, যাদের মধ্যে ছ’টির গায়ের ডোরার প্যাটার্ন কোয়াগার খুবই কাছাকাছি। 'কোয়াগা প্রজেক্ট' এর লক্ষ্য হল এরকম অন্তত পঞ্চাশটি জেব্রা সৃষ্টি করা এবং তাদের স্বাভাবিক বাসভূমিতে পুনর্বাসিত করা। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রজেক্টটিকে আধুনিক বিজ্ঞানের বিশাল সাফল্যের প্রতীক বলে মনে হয় ঠিকই, কিন্তু মাথায় রাখা দরকার যে কোয়াগার মত দেখতে এই জেব্রাগুলি কিন্তু জিনগত দিক দিয়ে জেব্রাই। কোয়াগার বহিরঙ্গের রূপ কিছুটা ফেরানো গেছে, কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এই উপপ্রজাতির জিন ফিরে আসেনি।
৪. থাইলাসাইন বা টাসমানিয়ান টাইগার
নামে টাইগার হলেও থাইলাসাইন আসলে মারসুপিয়াল শ্রেণীর প্রাণী ছিল। মারসুপিয়াল অর্থাৎ ক্যাঙ্গারু, ওয়ালাবি, কোয়ালাদের মত প্রাণীরা, যাদের শিশুগুলি মায়েদের পেটের থলির মধ্যে থাকে। এরা অস্ট্রেলেশিয়া ও আমেরিকার বাসিন্দা। মাংসভোজী মারসুপিয়ালদের মধ্যে থাইলাসাইন ছিল সব চেয়ে বড় আকারের। মাঝারি বা বড় আকারের কুকুরের মত দেখতে ছিল এদের। লেজ ছিল লম্বা ও অনমনীয়। ওয়াটার অপোসামদের মত পুরুষ-নারী নির্বিশেষে থাইলাসাইনদের পেটে থলি থাকত। পিঠে কালচে ডোরাকাটা থাকত। এই ডোরাকৃতি দাগগুলির জন্যই থাইলাসাইনকে টাসমানিয়ান 'টাইগার' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। চেহারায় কুকুর বা নেকড়ের সঙ্গে মিল থাকায় এদের 'টাসমানিয়ান উলফ' ও বলা হত।
জিনগত বৈচিত্র্যে র অভাবজনিত কারণে থাইলাসাইনদের অনেক প্রাণঘাতী রোগ হওয়ার প্রবণতা ছিলই। মূল অস্ট্রেলিয়ান ভূখন্ডে বুনো কুকুর বা ডিঙ্গোরা সংখ্যায় অনেক ছিল। খাদ্যের জন্য তাদের সঙ্গে থাইলাসাইনদের রেষারেষি হত। পরে শিকারের জন্য মানুষেরা ডিঙ্গোদের সঙ্গে নেওয়া শুরু করে। আরো বিপন্ন হয়ে পড়ে থাইলাসাইন।
থাইলাসাইনরা পোষা ভেড়া শিকার করে খেয়ে নেয়, এইরকম গুজব সেকালের অস্ট্রেলিয়ায় প্রায়ই শোনা যেত। গুজবই বটে, কারণ স্বভাব-লাজুক এই জীবটিকে জনবসতির আশেপাশে কমই দেখা যেত, কিন্তু ভেড়া মারা পড়লেই দোষ যেত তাদের ওপর। থাইলাসাইনের 'সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য' মৃত থাইলাসাইনদের মাথা পিছু পুরস্কার ঘোষণা করা হত বার বার।
মূল অস্ট্রেলিয়ান ভূখন্ডে টিকে থাকতে না পারলেও ছোট্ট দ্বীপ টাসমানিয়ায় থাইলাসাইন মাটি কামড়ে ছিল অনেক দিন। ১৯৩০ সালে, সরকার এদের সংরক্ষিত জীব হিসেবে ঘোষণা করার কিছু দিনের মধ্যেই, শেষবারের মত থাইলাসাইনকে গুলি করে মারার ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর শেষ থাইলাসাইনটি মারা যায় বন্দী অবস্থায়। তিন বছর টাসমানিয়ার হোবার্ট জু তে অবহেলায় অনাদরে থাকার পর ১৯৩৬ সালে মৃত্যু হয় বেঞ্জামিন নামের এই প্রাণীটির।
৫. দ্য গ্রেট অক
লেখার শেষে আবার ফিরে যাই একটি পাখির কথায়। নামের মধ্যে 'দ্য গ্রেট' (The Great Auk)কথাটা শুনে একেও খুব বিশাল চেহারার মনে হয়। দ্য গ্রেট অককে কিন্তু দেখতে ছিল প্রায় পেঙ্গুইনদের মত। পেঙ্গুইনদের খোঁজ মানুষ পায় অনেক পরে। অকপাখিকে 'পিঙ্গুইনাস' নামে অভিহিত করা হত, তার সঙ্গে চেহারার মিল থাকার কারণেই 'পেঙ্গুইন' নামকরণ হয় তাদের।
চেহারায় সাদৃশ্য থাকলেও অক আর পেঙ্গুইন কিন্তু আলাদা আলাদা প্রজাতির পাখি। উচ্চতায় প্রায় তিন ফুটের কাছাকাছি যেত অক, ওজন প্রায় কেজি পাঁচেক হত। কিন্তু তাদের ডানার দৈর্ঘ্য ছিল সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির কিছু বেশি। ফলতঃ পেঙ্গুইনদের মত অকেরও ওড়ার ক্ষমতা ছিল না। দক্ষ সাঁতারু ছিল গ্রেট অক। যেহেতু অকের খাদ্য ছিল মাছ, অতএব জলে শিকার করতে তাদের খুব সুবিধেই হত।
প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে অকরা পছন্দ করত নির্জন পাথুরে দ্বীপ, যেখান থেকে সমুদ্রে নামা সহজ এবং যেখানে খাদ্যবস্তুর প্রাচুর্য রয়েছে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে এরকম আট-দশটি মাত্র দ্বীপ ছিল। প্রজননের সময় ছাড়া অন্য সময়ে অকরা সাঁতরে খাবার খুঁজতে খুঁজতে উত্তর স্পেন, কানাডা, গ্রীনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফ্যারো আইল্যান্ডস, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, এমন কি ইংল্যান্ড অবধি চলে যেত।
আমেরিকার কিছু আদিবাসী উপজাতির কাছে অকের মাংস ছিল অতি উপাদেয় খাদ্য। এদের চামড়া থেকে পোশাকও তৈরি হত। ইউরোপ থেকে আমেরিকায় যাওয়া প্রথম মানুষেরা অকের মাংস তো খেতেনই, আবার ব্যবহার করতেন মাছ ধরার টোপ হিসেবে। অকের সংখ্যা এর ফলে অনেকটাই কমে গিয়েছিল। ইউরোপের দিকের বাসিন্দা অকদের মরতে হয়েছিল কারণ তাদের পালকের চাহিদা ছিল বিশাল। ষোলো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে অকের সংখ্যা অনেক কমে এসেছিল। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন গ্রেট অক বিপন্ন প্রজাতি, তাই প্রথম দিকের পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনগুলি আরোপিত করে তাদের বাঁচানোর কিছু চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা হয়নি। অক নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে বুঝতে পেরে ইউরোপের মিউজিয়ামগুলি ও অনেক শৌখিন সংগ্রাহক চড়া দামে অকের চামড়া ও ডিম কিনতে থাকেন। অর্থের লোভে সেই চাহিদা মেটানোর জন্য আরো বেশি করে গ্রেট অকদের মারা হতে থাকে। শেষ দু'টি অককে গুলি করে মারা হয় ১৮৪৪ সালের ৩রা জুন। এর পরেও গ্রেট অক দেখা গেছে বলে গুজব শোনা গেছে, কিন্তু এদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ আজ অবধি পাওয়া যায়নি।
এই লেখায় আমরা ফিরে দেখলাম ছ'টি পশুপাখিকে। ইন্টারনেট একটু ঘাঁটলেই কিন্তু অন্ততপক্ষে ছত্রিশটি প্রাণীর নাম আমরা পাব, যারা শেষ হয়ে গেছে আমাদেরই দোষে। সুদানের মৃত্যু আমাদের আরো একবার বাস্তব পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়ে গেল চোখে আঙুল দিয়ে। ইতিহাস থেকে, বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা কিছু শিক্ষা নিতে পারছি কিনা, সেটা হয়তো অচিরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া