

রাজা রামমোহন রায়
আমার মামারবাড়িতে তবলা ছিল। ছোটমামা বাজাতেন। তিনি যখন বাড়ি থাকতেন না, লুকিয়ে লুকিয়ে তবলার বিঁড়ে (যে বৃত্তাকার গদির ওপর তবলা রাখা হয়) মাথায় পরে, গোঁফ এঁকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রাজা রামমোহন সাজতাম।কেন জানি না, এই রাজা রামমোহন আমার মনে এক বেশ বড় জায়গা নিয়ে আছেন। কোনো কিছুকে বদলাতে গেলে বদল রাতারাতি আসে না। আর যিনি এই বদলের উদ্যোগ নেন, তাঁর বড় সাহস, জ্ঞান আর বিচক্ষণতা লাগে। লাগে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই-এর মত কঠিন মন। এ লড়াই অস্ত্রের নয়, মনের।রাজা রামমোহন ছিলেন সেই কাণ্ডারী যাঁর স্পর্শে বাংলা তথা ভারত প্রথম সমাজ সংস্কারের আলো দেখেছিল।মেয়েরা পেয়েছিল তাদের প্রাপ্য সম্মান।

জেমস সিল্ক বাকিংহাম
ইংরেজেদের ভারত শাসনের সময়ে আমরা বারে বারে দেখেছি যে ইংরেজ মানেই যে খুব খারাপ তা কিন্তু নয়।কলমের জাগরণের সময়ে এমনই এক শুভানুধ্যায়ী ছিলেন জেমস সিল্ক বাকিংহাম। বাকিংহাম ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের সংস্কার-নীতির একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। তাঁর প্রথম পত্রিকা ছিল ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ নামে এক দৈনিক।তাঁর বেশ নাম-ডাক হয় এই পত্রিকার মাধ্যমে বৃটিশদের অবিচার আর অপসাশনের বিরূদ্ধ সমালোচনার মাধ্যমে।তুমিই বল, এর পরে কি আর বৃটিশরা তাঁকে কখনো সহ্য করতে পারে!!! তখন অস্থায়ী গভর্ণর জেনারেল ছিলেন জন অ্যাডাম। এমন কলমের লড়াই শুরু হল যে বেচারা জন ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে তড়িঘড়ি সংবাদপত্রে নিয়ন্ত্রনের আদেশ জারি করে বসলেন। আর বাকিংহাম-কে বলা হল, বিলেত ফিরত চলে যেতে। অ্যাডামের আইন অবশ্যই সংবাদপত্রের গলা টিপে ধরল।
মাঠে নামলেন রাজা রামমোহন। ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য প্রথমে সুপ্রিম কোর্ট তারপর ব্রিটেনে রাজার কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। সেই প্রথম কেউ বৃটিশ শাসিত ভারতের নাগরিক হিসেবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দাবী করেন। দাবী করেন শাসনতান্ত্রিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের। শাসন মানেই কি স্বেচ্ছাচার? প্রশ্ন তোলেন তিনি। পরাধীন হলেও দেশের নাগরিক হিসেবে ন্যূনতম অধীকার প্রত্যেক ব্যক্তির আছে, তা রাজা রামমোহন এই স্মারকলিপিতে বলেন।এর ফল অনেকদূর ছড়ায়।এমনকি পরে ঊনবিংশ শতাব্দী-তে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য যে আন্দোলন সংগঠিত হয়, তা রামমোহনের দেখানো পথেই।

১৮৭২ সালে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকার একটি পাতা
কলমের যে কি জোর তা আগে ইংরেজরা বোঝেই নি। তলোয়ার, বন্দুক আর অত্যাচার করার জোর তো ইংরেজদের ছিলই। কিন্তু পালটা কলমের জোরের কাছে তারা কেমন যেন ম্রিয়মান হয়ে গেল।সরকারি নিয়ন্ত্রনের প্রতিবাদে রাজা রামমোহন ‘মীরাৎ-উল-আখবার’ প্রকাশ করাই বন্ধ করে দেন। আর তার জেরেই ইংরেজরা বুঝল যে সংবাদপত্রের টুঁটি টিপে ধরলে তার ফলে নিজেদেরই দমবন্ধ হয়ে যাবে। তাই ১৮৩৫ সালে গভর্নর জেনারেল চার্লস মেকটাফ এক ঘোষণার মাধ্যমে সংবাদপত্রের ওপর থেকে যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। রাজা রামমোহনের জয় হয় বিনা রক্তপাতে, শুধু লেখনীর শানিত প্রয়োগে। তবে হ্যাঁ, মানুষের জাগরণ আর চেতনার উন্মেষ ঘটাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’, হরিশচন্দ্র মুখার্জীর ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ কেশবচন্দ্র সেনের ‘সুলভ সমাচার’, শিশিরকুমার ঘোষের ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের ‘সোমপ্রকাশ’ ইত্যাদি অনেকের।
১৮৩৫ সালে মেকটাফের ঘোষণা আর ১৮১৭৮ সালে গভর্নর জেনারেল লিটনের ভার্নাকুলার প্রেস এক্ট (act) – এই চার দশকে বাংলার কলমের শক্তি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল ইংরেজ সরকার। তারই মধ্যে আবার ১৮৫৭ সালে সিপাহী-বিদ্রোহ। রীতিমত নাকানি-চোবানি খেয়েছিল বৃটিশ সরকার। সব মিলে টলে গিয়েছিল ভারতে তাদের ক্ষমতার ভিত। এরপর থেকে আর আরামে রাজত্ব করতেই পারেনি বৃটিশ সরকার।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও বৃটিশ লাইব্রেরি