সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
পশুরা কি বর্ণান্ধ ?

পরশমনিতে অনেকদিন আসিনি।

সময় কাটাবার জন্য একটা পুরনো পত্রিকার পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা রং চং-এ ছবি। তা বইতে ত কত ছবিই থাকে, এতে বিশেষ আর এমন কি আছে! তা ঠিক। কিন্তু এই ছবিটা একটু বিশেষ ছিল। এটা ছিল একটা বুল ফাইটিং এর ছবি। বুলফাইটিং বা ম্যাটডোর শব্দগুলো শুনেছ এর আগে ?

কেউ কেউ শুনে থাকতে পার এই নাম, কারও কাছে একেবারেই নতুন এ কথাটা। মানে জান ? অভিধান খুঁজে দেখ, দেখবে লেখা আছে 'ঘাতক' বা 'ষাঁড়ের সাথে যুদ্ধ করে তাকে হত্যা করে যে'! এই ঘাতক হল আসলে একজন খেলোয়াড়! অবাক লাগছে না ? যে একজন ঘাতক খেলোয়াড় হল কি করে ?

স্পেনে একধরণের খেলা কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রচলিত ছিল, যে খেলায় একটা ঘেরা জায়গায় প্রচুর দর্শকের সামনে একজন স্পেনীয় খেলোয়াড় আগাগোড়া লাল পোষাক পরে হাতে একটা লাল চাদর আর একটা লম্বা ছোড়ার মত অস্ত্র নিয়ে দাঁড়ায় আর সেই ঘেরা জায়গার এক ফোকর দিয়ে এক বিশাল আকারের ষাঁড় খোলা স্থানে এসে একা দাঁড়ানো যোদ্ধাকে আক্রমন করে।

কখন করে জান ? যোদ্ধা ষাঁড়কে দেখে যখন হাতের লাল কাপড়খানা দু'হাতে মেলে ধরে দোলাতে থাকে যেন হাওয়ায় উড়ছে। দোলখাওয়া লাল চাদর দেখে ষাঁড় ক্রুদ্ধ হয়ে তেড়ে এসে মানুষটিকে আক্রমন করে, মানুষটি সামনে থেকে সরে যায়! এতে ক্রুদ্ধ জন্তুটি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে আবারও আক্রমন করে। আর একই ঘটনা ঘটে। এতে দর্শকেরা খুব আনন্দে হল্লা করে ওঠে! তাতে কিন্তু প্রানীটি আরও রেগে যায়। এই ভাবে খেলা চলতে থাকে। কোন ভাবে যদি ষাঁড়টি যোদ্ধাকে বাগে পেয়ে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে তার পোষাকের অংশ নিজের শিং-এ আটকে নিতে পারে তবে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এটা করা তার পক্ষে মোটেই কঠিন কাজ নয়! কেননা ষাঁড়টিকে খাইয়ে-দাইয়ে বিশাল আকৃতি আর শক্তিশালী করা হয়। পূর্ণবয়স্ক একটি প্রানীর ওজন ৭/৮ টন হওয়া মোটেই আশ্চর্য নয়! তো একজন ৮০/৮৫ কিলো ওজনের মানুষ ত তার কাছে পালকের মত হালকা ! কিন্তু যদি শিং খেলোয়াড়ের শরীরে বিঁধিয়ে দেয় ? তাহলে মানুষটির মৃত্যু নিশ্চিত। কিন্তু মানুষের হাতেও ত অস্ত্র আছে! সে সেটা দিয়ে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে আর আক্রমনও করে এবং অস্ত্র দিয়ে ষাঁড়কে আঘাত করে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় প্রানীটি আঘাতও পায় আর ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং অবশেষে মারা যায়। এই যুদ্ধে একজনকে মরতেই হয়, আর সে ঐ শক্তিমান অল্পবুদ্ধির প্রানী যে কিনা সশস্ত্র বুদ্ধিমান মানুষের কাছে হেরে মৃত্যু বরণ করে! এই জন্যই ম্যাটাডরকে, মানে ওই যোদ্ধাকে 'ঘাতক' বলা হয়ে থাকে।

এইখানে বলে রাখা দরকার, এই সমস্ত ষাঁড়গুলি কিন্তু গৃহপালিত বা সাধারণ ষাঁড় নয়। এগুল এক বিশেষ ধরণের লড়াকু ষাঁড়, শ্ত্রুকে আক্রমণ করার জন্য এদের আলাদা করে তালিম দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আরো জানিয়ে রাখি, 'বুলফাইটিং' বা ষাঁড়ের লড়াইকে সহজে বোঝানোর জন্য 'খেলা' (sport) বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আদত স্পেনীয়দের কাছে এটা নিছক খেলা নয়, তাঁরা কেউ কেউ এটাকে নাটক বা নৃত্যের মত সৃজনীশিল্প বলে মনে করেন। বুলফাইটিং বা 'কোরিদা' স্পেনীয়দের জীবনযাত্রার প্রতীকগুলির একটি। সেই কারণেই, পৃথিবীর যে যে অঞ্চলই স্পেনীয়রা ইতিহাসের কোন না কোন সময়ে অধিগ্রহণ করেছে, যেমন দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, সেই সব জায়গাতেও এই খেলা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে অনেক মানুষই আবার নিতান্ত আনন্দের জন্য এইভাবে পশুহত্যা করা মেনে নিতে পারেন না। তাঁরা বারেবারে এইখেলা বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চালিয়েছেন। অবশেষে ২০১২ সাল থেকে সরকারিভাবে স্পেনে বুলফাইটিং নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

গল্পটা এখানেই শেষ, তাহলে এটা শোনাতে লেখার কি আছে, এটাই ভাবছ তো ? আছে। সেটা বলি।

প্রশ্নটা হল ষাঁড়েরা কি তাহলে লাল রং অপছন্দ করে, আর তাই দেখা মাত্র রেগে গিয়ে লাল চাদরকে আক্রমন করে ? লাল অপছন্দ কেন ?

কারনটা কি বলতে পার ? সেটাই বলি এবার।

সত্যি কথাটা হল ষাঁড় লাল রং দেখতেই পায় না ! আসলে ষাঁড় রং-কানা বা শুদ্ধ ভাষায় 'বর্নান্ধ'। লাল রং কি, সেটা ষাঁড় জানেই না ! তাহলে ব্যাপারখানা কি ? যোদ্ধার কেন ঝলমলে লাল পোষাক বা ষাঁড় ক্ষেপাবার জন্য লাল চাদর ? এবার সেটা শোনো।

পশুরা কি বর্ণান্ধ ?
মোটামুটি পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে চলে আসছে, মাঝে কিছুদিন ছেদ পড়েছিল। তবে সে খুব কম সময়ের জন্য। সেই সময় প্রথম যে যোদ্ধা খেলতে নামেন তিনি সম্ভবত নিজেকে উজ্জ্বল দেখাতে, পুরো অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা নাটকীয়তা আনতে, রঙ্গিন পোষাকে রঙ্গিন চাদর হাতে, বিশেষকরে লাল রঙের, খেলতে নামেন! সেই থেকে ধারনা ছিল যে ষাঁড় লাল দেখলে ক্রুদ্ধ হয়, তাই জমকালো পোষাক আর লাল চাদর! এখন অবশ্য অন্য রং-ও নেওয়া হয়।

ওরা যে লাল রং দেখতে পায় না, সেটা জানার জন্য নানা ধরনের পরীক্ষা করা হয়েছে। যেমন, নানা রঙের চাদর ব্যবহার করে দেখা গেছে, রং দেখে নয়, পর্দার নড়াচড়া দেখেই ওরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এমনকি কালো সাদা বা অন্য রং-এর চাদর নড়া দেখেও ওরা আক্রমন করে।

নকল (পুতুল) যোদ্ধাকে লাল রং-এর, আর আসল যোদ্ধাকে অন্য রঙের পোষাক পরিয়ে ষাঁড়ের সামনে নড়াচড়া করতে দিলে সে নকল যোদ্ধাকে ছেড়ে আসল যোদ্ধাকেই আক্রমন করে, যেহেতু সে নড়ে। স্থির বস্তুকে ষাঁড় লক্ষ্যই করে না।

সুতরাং ষাঁড়ের বিষয়ে যা বলা হয় সেটা সত্য নয়।

পশুরা সবাই রং দেখতে পায় কিনা, কে, কি রং কিভাবে দেখে সে বিষয়ে পরে জানাবো।


ছবিঃ উইকিপিডিয়া, দ্য গার্ডিয়ান

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা