সূর্যাস্তের পরে, সন্ধ্যে নামার সাথে কলকাতা ও শহরতলির গাছ-গাছালির নির্জন অন্ধকারে ঝিকমিক করে ওঠে জোনাকিরা। অদ্ভুত, মায়াবী আলোর খেলা শুরু হয়। সেই সময়, আকাশভরা তারার নিচে চুপ করে কান পাতলে শোনা যায়-ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর দুচোখ ভরে দেখা যায়, বিচিত্র বর্ণের জোনাকির অপূর্ব আলো। এই আলো আসে কোথা থেকে? আর কীভাবে জোনাকি তার ছোট্ট শরীরে তৈরি করে এই সুন্দর আলো? এই প্রশ্ন সবার মনে উঁকি দেয়।
তাহলে জানা যাক, জোনাকির আলো তৈরির রহস্য। মনে করি একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে।আমরা আলো পাচ্ছি, এই অবস্থায় বাল্বটিকে ধরলে ভীষণ গরম লাগবে। তার কারন, সেখানে বৈদ্যুতিক শক্তির ৯০ ভাগ তাপশক্তি এবং মাত্র ১০ ভাগ আলোকশক্তিতে পরিনত হচ্ছে। আলো দেবার সময়ে বাল্ব সেকারনেই গরম হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতিতে, যদি জোনাকির আলো দেবার সময়ে এতটা তাপ উৎপন্ন হত, তবে জোনাকির শরীর পুড়ে নষ্ট হয়ে যেত। বৈজ্ঞানিকরা আবিষ্কার করেছেন, জোনাকির শরীরে আলো তৈরি হয় “রাসায়নিক আলোকবিকিরণ”(Chemiluminescence) পদ্ধতিতে। বিটল শ্রেণীর অন্তর্গত পতঙ্গ জোনাকির, শরীরের নিচের অংশে থাকে বিশেষ ‘আলোক-কোষ’(Photocyte), সেখানে জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় শক্তি। জোনাকিরা উৎপন্ন শক্তির ১০০ ভাগ আলো তৈরিতে খরচ করে- তাতে কোন তাপ উৎপন্ন হয় না। তাই জোনাকির শরীরে তৈরি আলোকে ‘শীতল আলো’(Cold Light) বলা হয়। জোনাকি ছাড়াও অন্যান্য কিছু পতঙ্গ-“জৈব আলোক বিকিরণ”(Bioluminescence) করে থাকে। যেমন- ক্লিক বিটল, লংহর্ন বিটল ইত্যাদি। তবে বৈচিত্র্যে ও আলোক বিচ্ছুরনের কাজে জোনাকিরা সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
জোনাকিরা কথা বলে আলোর ভাষায়। পুরুষ জোনাকি আলো বিকিরণ করে বিশেষ সঙ্কেত পাঠায় দূরে থাকা স্ত্রী জোনাকিকে। এ কথা ভেবে আশ্চর্য হতে হয় যে, বহু প্রজাতির অসংখ্য জোনাকি এক সাথে, একই জায়গায় থেকে আলো ছড়ালেও, কেবলমাত্র নির্দিষ্ট প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী জোনাকিরা আলোর সঙ্কেত চিনে পরস্পরকে খুঁজে পায় ও জোড় বাঁধে। জোনাকির জীবনচক্রের বিভিন্ন দশায়- যেমন ডিম, লার্ভা, পিউপা ও পূর্ণাঙ্গ সবক্ষেত্রেই আলোক বিকিরণ দেখা যায়।
ছোট্ট জোনাকিরা আমাদের বন্ধু। কিন্ত, কীভাবে? প্রথমেই জানাই, জোনাকির শরীরে কোন বিষাক্ত, ক্ষতিকারক রাসায়নিক নেই। তারা মৌমাছি, বোলতা, ভিমরুলের মতো অন্যান্য প্রাণীকে দংশন করে না বা হুল ফোটায় না। মশা ও মাছির মতো জোনাকি কোন রোগজীবাণু বহন করে না। তারা পরিবেশ-বান্ধব(Eco-friendly), সুতরাং, তাদের দ্বারা ফুল, ফল ও ফসলের কোন ক্ষতি হয় না। বরং জোনাকি ফুলের পরাগসংযোগে সাহায্য করে। জোনাকির লার্ভা- শামুক ও অন্যান্য পরজীবী পতঙ্গদের খেয়ে নেয়। জোনাকির জীবনধারনের সুনির্দিষ্ট স্থান থাকে। অরন্যের হাল্কা, ভিজে ঘাসে, পরিষ্কার জলাশয়ের ধারে জন্মানো ঘাসে- জোনাকিদের পাওয়া যায়। বনাঞ্চল ধ্বংস হলে, পরিবেশ দূষণমাত্রার বৃদ্ধিতে জোনাকির সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যায়। তাই জোনাকিদের “দূষণ নির্দেশক”(Pollution Indicator) বলা হয়।
জৈব-রাসায়নিক গবেষনায় এবং চিকিৎসাবিদ্যায় ছোট্ট জোনাকির অবদান অসামান্য। জোনাকির শরীর থেকে পাওয়া যায়- লুসিফেরিন ও লুসিফারেজ নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ। জোনাকির শরীরে এই দুটি পদার্থ অক্সিজেন এর উপস্থিতিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরি করে আলো। বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ নির্ধারণের কাজে, লুসিফারেজ বহুল পরিমানে ব্যাবহৃত হয়। এছাড়া বর্তমানে, ক্যান্সার, হার্টএর অসুখে, ডায়াবেটিসের চিকিৎসায়- নানা গবেষণার কাজে লুসিফারেজ কাজে লাগে। তাই আধুনিক পৃথিবীর মানুষরা জোনাকিদের কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী। তাই এই ছোট্ট, সুন্দর, নিরীহ পতঙ্গটিকে ভালবেসে, তাদের মতো করে বাঁচতে দিলে, আমাদের পরিবেশ উপকৃত হবে আর প্রতিটি সন্ধ্যায়, ঝিকমিকে জোনাকির আলোয় পৃথিবীতে নেমে আসবে রূপকথার মায়ারাজ্য।
জোনাকিদের কান্ডকারখানা ঠিক কেমন হয় , দেখার জন্য সঙ্গে রইল ন্যাশ্নাল জিওগ্রাফিকের তৈরি দুটো ভিডিও।
এই ভিডিওটিতে দেখা যায় নিউ জিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ড অঞ্চলের মাটির নীচের বিস্তৃত গোলকধাঁধার মত অন্ধকার গুহার মধ্যে বসবাসকারী মাংশাসী জোনাকি লার্ভাদের। ভিডিওটি ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেখা যায়।
এই ভিডিওতে আমরা দেখতে পাই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় উদ্যানগুলিতে গ্রীষ্মকালে পূর্ণাঙ্গ জোনাকিদের কর্মকান্ড।
সূচক ছবিঃ
বাঁদিকে তুরস্কে পাওয়া স্ত্রী জোনাকি, ডান দিকে ইন্ডিয়ানাতে পাওয়া পুরুষ জোনাকি (উইকিপিডিয়া)