'প্রীতম, বড় হয়ে কী হতে চাও তুমি?’ 'আমি? আমি বড় হয়ে মুরগিওয়ালা হব। পাড়ায় পাড়ায় এই মুরগি, এই মুরগি, মুরগি লইবেন নি, মুরগি?-বলে বেড়াব।'
ড্রইং রুমে যারা ছিল সবাই তখন প্রীতমের উত্তর শোনার পর হো হো করে হেসে উঠল। ওদিন আবার প্রীতমদের বাসায় কিছু অতিথিও ছিল, তারাও হেসে উঠল। ছেলে মুরগিওয়ালা হতে চায় বলছে শুনে প্রীতমের বাবা-মা তখন লজ্জায় শেষ।
প্রীতমের মুরগিওয়ালা হতে চাওয়ার কারণও আছে বটে। প্রতি দুপুরেই সে বারান্দায় খেলার সময় নীচ দিতে মুরগিওয়ালাদের যেতে দেখে। আর শুনতে পায়, এই মুরগি, এই মুরগি, মুরগি লইবেন নি, মুরগি?
এই হলো আমাদের প্রীতম। সে থাকে ধানমন্ডিতে। প্রত্যেক বারই যখন কেউ তাকে জিজ্ঞেস করত, 'প্রীতম, বড় হয়ে কী হবে, বাবা?'
তখন প্রত্যেক বারই প্রীতম দিত আলাদা আলাদা উত্তর। এইতো সেদিনও সে বারান্দায় খেলছিল। হঠাৎ বাসার নীচ দিয়ে এক আইসক্রিমওয়ালাকে যেতে দেখল।
আইসক্রিমওয়ালাটি হাঁকছিল, 'আইসক্রিম, আইসক্রিম, মজার মজার আইসক্রিম, লাগবে নাকি আইসক্রিম?'
প্রীতম তখন ভেবেছিল, আরে, দারুণ তো! বড় হয়ে আমি আইসক্রিম বেচব। একটা বেচব আর একটা খাব।
সে তার আইসক্রিমওয়ালা হবার ইচ্ছে মা-বাবাকে জানায়। ছেলে আইসক্রিমওয়ালা হবে ভেবেই প্রীতমের মা-বাবা কী করবে বুঝে উঠতে পারল না।
একদিন প্রীতম মা-বাবার কয়েকদিনের জন্য সঙ্গে গ্রামে গেল। প্রীতমের দাদু-দিদা গ্রামে থাকেন। গ্রামে এলেই তো মজা! কোন পড়াশোনা নেই, শুধু খেলা, খেলা আর খেলা। প্রীতম তো কখনো ধানক্ষেত দেখেনি তাই প্রীতমের দাদু প্রীতমকে নিয়ে গেলেন ধানক্ষেত দেখাতে। প্রীতম সেখানে দেখতে পেল কয়েকজন ধান নিয়ে কী যেন করছে।
প্রীতম দাদুকে জিজ্ঞেস করল, 'দাদু, এরা কারা?'
দাদু উত্তরে বলে, 'এরা হলো কৃষক।'
প্রীতম তো খুশি হয়ে গেল। সে এখন বড় হয়ে কৃষক হতে চায়। প্রীতম ও তার দাদু বাড়িতে ফিরলে প্রীতম সবাইকে বলে বেড়ায়, 'আমি বড় হয়ে কৃষক হব।'
প্রীতমের ইচ্ছার কথা জেনে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। প্রীতম তখন রেগে গিয়ে বলে, 'তোমরা এভাবে হাসাহাসি করলে মুরগিওয়ালা আর আইসক্রিমওয়ালা হওয়াও ছাড়ব না কিন্তু বলে রাখলাম।'
সেবার আরো জোরে সবাই হেসে উঠে। প্রীতম তখন গাল ফুলিয়ে রাগ করে থাকে।
প্রথমবার যখন প্রীতম বাবা-মায়ের সঙ্গে সিনেমা হলে গেল, বের হয়ে প্রীতম বলে সে নায়ক হতে চায়।
একবার প্রীতমের সে কী জ্বর! হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে হলো তাকে। সেরে উঠে বলে ডাক্তার হবে।
ট্রাকের ড্রাইভারকে বেদমসে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে বলে ট্রাক ড্রাইভার হবে আর সারাক্ষণ নাক ডাকিয়ে ঘুমুবে।
একসময় রাস্তায় ঝাড়ুদাড়দের রাস্তা পরিস্কার করতে দেখে বলে ঝাড়ুদার হবে! তারপর সুপারম্যান, ইঞ্জিনিয়ার, দোকানদার, ক্রিকেটার, এমনকী ড্রেন ক্লিনারসহ আর কত কী যে প্রীতম হতে চেয়েছে তার কোন ঠিকানাই নেই।
কিন্তু একবার প্রীতমের জীবনে পরম কামনায় কুকুর হবার সাধ জাগল। সাড়া বাড়ি হামাগুড়ি দিতে লাগল, কাউকে দেখলে ঘেউ ঘেউ করে উঠত। কুকুরের ডাকটাও ভালো রপ্ত করেছিল সে।
একদিন প্রীতমকে এরকম করতে দেখে এক বৃদ্ধা মহিলা প্রীতমের মাথায় হাত বোলাতে যাবেন অমনি প্রীতম প্রায় কামড়াতে যাচ্ছিল তাঁর হাত! কুকুরের প্রায়ই সবকিছুই শিখে যাচ্ছিল, কিন্তু কুকুরের মতো কান চুলকাতে পারত না প্রীতম। সেটা রপ্ত করার জন্য প্রীতম পাশের বাসার সামনে কুকুরের পাশে গিয়ে বসেও ছিল।
ঠিক তখনই রাস্তা দিয়ে একজন লোক যাচ্ছিলেন। পোষাক দেখেই তাঁকে আর্মি অফিসার মনে হচ্ছিল প্রীতমের।
তিনি প্রীতমকে এই অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'কী খোকা? কী করছ এখানে?'
প্রীতম স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, 'কুকুর হচ্ছি।'
লোকটি আবারো জিজ্ঞেস করলো, 'মানুষ হতে চাও না বুঝি?'
'মানুষ তো অনেকদিন আগেই ছিলাম।'
'আগে মানুষ ছিলে? '-একটু থেমে লোকটি আবার বলল-'মানুষের মত চেহারা হলেই কী আর মানুষ বলে?'
প্রীতম উঠে দাঁড়াল।
জিজ্ঞেস করলো লোকটিকে, 'তাহলে কাকে মানুষ বলে?'
'তুমি নিজেই ভেবে দেখ' ,বলেই লোকটি চলে গেলেন।
প্রীতম ভাবে, আর্মি অফিসারটি একটুও ঠাট্টা করেন নি। কিন্তু কিছুই তো বুঝিয়েও বলে্ননি।
কেন যেন প্রীতম কথাগুলো যতই ভাবে ততই লজ্জা পেয়ে যায়!
হঠাৎ একবার প্রীতম বুঝতে পারল, রোজ রোজ এভাবে নানান পেশায় ছোটা মোটেও কাজের কথা নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, সে এখন ছোট। বড় হয়ে যে কী হবে সে তো তাই জানে না।
যদি কেউ এরপর থেকে জিজ্ঞেস করে, 'বড় হয়ে কী হবে?'
তখন প্রীতমের আর্মি অফিসারটির কথা মনে পড়ে যায়। আর কক্ষনো আলাদা উত্তর তার কাছে আসত না।
সে বলে, 'বড় হয়ে আমি মানুষ হব।'
কেউ তখন প্রীতমকে নিয়ে হাসাহাসি করে না। অনেকেই গম্ভী্র হয়ে পড়ে। তারা কেউই প্রীতমের সাথে আর ঠাট্টা করে না, সবাই ব্যাপারটা এড়িয়ে যায়।
আবার অনেকে প্রীতমকে আশির্বাদও দেন, 'মানুষ হও বাবা, মানুষের মতো মানুষ হও।'
প্রীতমকে নিয়ে আর কেউ হাসাহাসি করে না, তাই প্রীতম এখন অনেক খুশি। প্রীতমের বাবা-মা প্রীতমকে জিজ্ঞেস করে, 'মানুষ হব কথাটি কে বলেছে, প্রীতম?'
প্রীতম তখন খুব আগ্রহ নিয়েই সেই আর্মি অফিসারটির কথা বলে।
সে বুঝতে পারে, বড় হয়ে কী হবে এর সঠিক উত্তর হলো মানুষ হব। সবার আগে আমাদের হতে হবে খাঁটি মানুষ।
প্রীতম এখন আর কোনো পেশার পিছনে ছুটে না। আর্মি অফিসারটিকে একটা 'থ্যাংক ইউ' জানানোর জন্য সে অপেক্ষায় আছে।
অনিরুদ্ধ বড়ুয়া ধ্রুব
অষ্টম,কুমিল্লা জিলা স্কুল, বাংলাদেশ
ছবিঃ ফ্রি ইমেজ ওয়েবসাইট