সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

টায়রা আজকাল স্কুল থেকে ফিরে পার্কে যাওয়ার জন্য আর বায়নাই করে না। ছোট মামাদাদু ওর জন্মদিনে একটা সুন্দর বদ্রিকা উপহার দিয়েছে। টায়রার খুব পছন্দ হয়েছে পাখিটা। কি সুন্দর স্কাই-ব্লু কালারের গা, তাতে আবার সাদা আর কালোর ছিট ছিট। যদিও মাম্মাম, মানে টায়রার মা বলেছে কথা বলার সময় বাংলা ইংরিজি মিশিয়ে না বলতে, কিন্তু টায়রা অনেক সময়েই সেই ভুল করে ফেলে। তারপরই আবার লম্বা জিভ কেটে বলে, "এই যা! আবার ভুল হয়ে গেল মাম্মাম"।
মাম্মাম তখন হেসে বলে, "ঠিক আছে, পরের বার মনে রেখো"।
তাই আজ ফোনে বড়পিসির সাথে গল্প করার সময় মনে করে বলেছে, "জানোওও পিপি, মামাদাদু আমাকে একটা খুব সুন্দর বদ্রিকা দিয়েছে। ওর নাম রেখেছি 'ফিজি'। কেন জানো? ওর গায়ের রঙ তো ফিরোজা, তাই। ভাল হয় নি পিপি?"
বড়পিসি শুনে খুব খুশী হয়ে বলেছে, "খুব মিষ্টি নাম হয়েছে। তা, ওর নাম কি শুধুই 'ফিজি'?"
-"না না, ওর পুরো নাম হল 'ফিজি চ্যাটার্জী'"।
-"আচ্ছা, বুঝেছি। ও তাহলে শ্রাবস্তী চ্যাটার্জীর কেউ হয় বুঝি?" বড়পিসির গলায় মজার রেশটা টায়রাকেও ছুঁয়ে গেল।
-"হি হি, পিপি, তুমি ঠিক বলেছ। আমি শ্রাবস্তী চ্যাটার্জী, আর ও আমার বোন ফিজি চ্যাটার্জী"।

এভাবেই ফোনে ফোনে তাদের সব আত্মীয়রাই জেনে গেল যে টায়রাদের বাড়িতে একটা সুন্দর 'ফিজি' এসেছে। টায়রাও এখন সময়মত সব হোমওয়ার্ক সেরে নেয়, একটুও দুষ্টুমি করে না। এমনকি খাওয়ার সময় আজকাল নাক টিপে করলা ভাজাও খেয়ে ফেলে। কি আর করবে! না হলেই মাম্মাম যদি ফিজিকে দিয়ে দেয়! তবে বিকেলে আগে পার্কে যাওয়ার জন্য খুব বায়না করত টায়রা। ওখানে ওর কয়েকজন বন্ধু আছে যে! ওরা সবাই রোজ বিকেলে পার্কে দোলনা চড়ে, লুকোচুরি খেলে, স্লিপ চড়ে, আবার রুমাল-চোরও খেলে। কিন্তু এখন বিকেলটা সে ফিজি'র সাথেই কাটাতে ভালবাসে।
-"আচ্ছা ফিজি, তুই আমাদের মত কথা বলিস না কেন? তাহলে কি ভাল হত! তোকেও আমার সাথে স্কুলে নিয়ে যেতে পারতাম"।
ফিজি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্লাস থ্রি'তে পড়া শ্রাবস্তী ওরফে টায়রার মনে হয় ফিজি খুব দুঃখ পাচ্ছে। তাই সে তাড়াতাড়ি বলে, "আচ্ছা, আমি তোকে শিখিয়ে দেব। কিন্তু তুইও আমাকে তোর ভাষা শিখিয়ে দিবি তো?"
ফিজি টুক করে ঘাড়টা নেড়ে দেয়। শুরু হয় ফিজির ভাষাশিক্ষা।
*
রোজ রাত্রে বাবার কাছে গল্প না শুনলে টায়রার ঘুম আসে না। রূপকথার গল্পের থেকেও দেশ-বিদেশের গল্প শুনতে তার বেশী ভাল লাগে। বিশেষ করে বাবাদের নানান জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার গল্প। আজ টায়রা যখন বাবার কাছে তার কঠিন ভাষা সমস্যার কথা জানাল, যে সে ফিজিকে কথা বলা শেখাচ্ছে, কিন্তু ফিজি যে তাকে কি শেখাচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তখন বাবা তাকে বলল, "আচ্ছা, আয়। আজ তোকে শিস দিয়ে কথা বলার গল্প শোনাই। মেঘালয়ের একটা জায়গায় আমরা গিয়েছিলাম, তার নাম কংথং..."

*****

টায়রা খুব সুন্দর জামা পরে নাচতে নাচতে চলেছে কংথং-এর রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ কানে এল একটা সুরেলা শিসের শব্দ আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বাচ্চা দৌড়ল সেদিকে। বাবা বলল, "ওর মা ওকে ডাকছে"।
টায়রা তো অবাক, "শিস দিয়ে?"
-"হ্যাঁ, এখানে সবাই শিস দিয়েই ডাকাডাকি করে"।
-"ওরা বোঝে কি করে বাবাই? একই রকম শিস দিলে তো তাহলে তিন-চারজন ভাবতে পারে যে তাকে ডাকছে" টায়রা কিছুতেই বুঝতে পারে না। বাবা হেসে বলল, "না রে বোকা, ওরা যে শিসগুলো তৈরী করে, প্রতিটাই একে অন্যের থেকে আলাদা। আসলে ওরা ভাবে প্রতিটা বাচ্চাই হয় গাছ অথবা পাখির অংশ। তাই পাখির ডাকের মত ওদের নাম হয়"।
-"ওরা কি কথাও বলে এভাবে?"
-"আসলে এরা যখন পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলে শিকার করতে যেত, অন্য দল যাতে বুঝতে না পারে, সেজন্য শিস দিয়ে ওরা সংকেত পাঠাত নিজের দলের লোকের কাছে। কি রকম বুদ্ধি বল!"
-"কি মজা ওদের, না বাবা?" টায়রা বেশ মজাই পায়। দূরে সবুজ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে টায়রা বলে, "আমি কি করে ওদের ভাষা শিখব বাবা?"
বাবা হেসে বলে, "তোকে বরং এখানেই রেখে যাই। তুইও শিখে যাবি এদের ভাষা। তোর বেশ নাম হবে 'টিইই-টিরি-টিরি-টিরি"।
-"নাআআআ...আমি এখানে থাকব না। তবে এদের ভাষাটা শিখেই আমি ফিরে যাব, ফিজির ভাষা শিখতে তখন আমার আর কোন অসুবিধাই হবে না তাহলে"।
-"আচ্ছা, তাহলে তোর সাথে ফিজিকেও এখানেই রেখে যাব"
-"ইয়াহুউউউউ, কি মজাআআআআ", আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে টায়রা। আর তখনই ঘুমটা ভেঙে যায় তার। দেখে সকাল হয়ে গেছে। কিন্তু বাবার কাছ থেকে শোনা কংথং-এর খাসি সম্প্রদায়ের গল্পটা তার মনে গভীর ছাপ রেখে গেল।

*****
স্কুল থেকে ফিরে টায়রা ফিজির সামনে শিস দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সে কি আর পাখিদের মত পারে! ফিজির কাত করা ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল ফিজি যেন ওকে বলছে, "তুমি একটুও মন দিয়ে শিখছ না, তাই পারছ না"।
মন খারাপ করে টায়রা স্নান করে খেয়ে শুতে গেল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে টায়রা দেখল, ফিজির খাঁচার বাইরে একটা বড় বদ্রিকা এসে ঠোঁট দিয়ে খাঁচার তার বেঁকানোর চেষ্টা করছে। আর ফিজি খাঁচার মধ্যে ছটফট করছে। হঠাৎই খাঁচার দরজাটা ওই বড় বদ্রিকার ঠোঁটের ধাক্কায় খুলে গেল, আর ফিজি বেরিয়ে এল খাঁচা থেকে। টায়রা ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসল। তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখল ফিজি খাঁচার মধ্যে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ফিজির চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল ওর খুব মন খারাপ।
মাম্মাম বলল, "ওর হয়ত মায়ের জন্য মন কেমন করছে"।
সত্যিই তো, এটা তো টায়রা ভেবে দেখে নি। মাম্মামকে ছেড়ে সে তো একদিনও থাকতে পারে না। তাহলে ফিজি মা'কে ছেড়ে এতদিন কি করে আছে!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই টায়রা ফিজির খাঁচার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে দেখল, একটা নীল-সাদা বদ্রিকা খাঁচার চারপাশে ঘুরছে আর ফিজি খাঁচার বাইরে আসার রাস্তা খুঁজছে। টায়রা আস্তে আস্তে খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বদ্রিকাটা ভয় পেয়ে উড়ে গিয়ে বারান্দার রেলিং-এ বসল। কিন্তু একেবারে উড়ে গেল না। সেদিকে তাকিয়ে টায়রা খাঁচার দরজাটা খুলে দিল। ফিজি এক পা এক পা করে বেরিয়ে এল খাঁচা থেকে। তারপর উড়ে গিয়ে বসল রেলিং-এ, বড় পাখিটার পাশে।
বড় পাখিটা ঠোঁট দিয়ে ফিজির গায়ে আর মাথায় আদর করতে লাগল, আর কিঁচ-কিঁচ করে কি যেন বলতে লাগল। তারপর দু'জনে উড়ে গেল খোলা আকাশে। টায়রার মনে হল, ইস্‌স্‌, আমি যদি ওদের ভাষা জানতাম! যাওয়ার আগে ফিজি একবার টায়রার দিকে তাকিয়েছিল কি? কে জানে! টায়রার মনে হল, ফিজি ওকে কিচির-মিচির করে বলে গেল, "থ্যাংক ইউ টায়রা"।

ছবিঃ মহাশ্বেতা রায়

জয়তী অধিকারী, কলকাতার বাসিন্দা, বেসরকারী চাকুরীরত। ভালবাসেন পাহাড়ের বুক বেয়ে সবুজ গন্ধে বুক ভরিয়ে নিতে,ভালবাসেন বই পড়তে আর গান শুনতে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা