সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আজকের দিন নিজের মাতৃভাষাকে নতুন করে আরেকবার ভালবাসার দিন।খবরের কাগজে, টিভির পর্দায় বা তোমার স্কুলে, তুমি নিশ্চয় এই নিয়ে অনেক আলোচনা শুনছ, হতে পারে তোমার স্কুলে এই নিয়ে ক্লাসরুম প্রোজেক্ট ও হচ্ছে। এখন তুমি জিজ্ঞাসা করতেই পার, মাতৃভাষা, বা ইংরেজিতে যাকে বলে mother language, অর্থাৎ যে ভাষা তোমার পরিবার থেকে শুরু করে তোমার জনজাতির মূল ভাষা, তাকে নিয়ে এত হইচই করার আছেটা কি? তার উত্তরে আমি মজা করে বলতে পারি- কেন বাপু, ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে, ফ্রেন্ডশিপ ডে, চকোলেট ডে, টিচার্স ডে, চিলড্রেন্স ডে- এত এত দিন আলাদা করে থাকতে পারে, আর মাদার ল্যাঙ্গোয়েজ ডে থাকতে পারে না?? কিন্তু না, International Mother Language Day বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস শুধুমাত্র আনন্দ করা বা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানোর দিন নয়। এই দিনের সাথে জড়িয়ে আছে একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস। নিজের মাতৃভাষার অধিকার বজায় রাখার জন্য অনেক অনেক সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাস আমি এখানে আবার বলতে চাইনা। তুমি হয়ত জান সেই ইতিহাস। আর যদি না জান, তাহলে গুগল-এ একটু খুঁজে দেখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি কেন বাঙলাভাষি মানুষের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা জানতে পারবে। আমি বরং এখন একটু অন্য বিষয়ে কথা বলি।

দেবদত্তা পড়ে কলকাতার একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে -- এঃ মা! চাঁদের বুড়ি- তুমি একেবারে ব্যাকডেটেড ! ইংরেজি মাধ্যম আবার কি?? ইংলিশ মিডিয়াম বল !!--স্কুলে তাকে সারাটাক্ষণ ইংলিশ এ কথা বলতে হয়। তার সব বন্ধুও বাঙালি নয়। গুরপ্রীত পাঞ্জাবি, রেবথী মালয়ালী, সপ্‌না গুজরাতি। স্কুলে বন্ধুদের সাথে, এমন কি বাঙালি বন্ধুদের সাথেও অর্ধেক সময়ে ইংলিশ না হয় হিন্দিতে কথা বলছে সে। সমস্ত বিষয় তাকে পড়তে হয় ইংরেজি মাধ্যমে। একমাত্র বাংলা ছাড়া। আর বাংলা যে কি গোলমেলে ভাষা!! - কার পেছনে দীর্ঘ ঈ, কোন শব্দে হ্রস্ব উ, কারক-সন্ধি-সমাস, তিন রকমের স-শ-ষ, দুই রকমের ণ-ন, র-ড়-ঢ়...সাধু-চলিত...উফ্‌...এত্ত কিছু মাথায় রাখতে হয়! দেবদত্তা তাই বাংলাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। স্কুলের পড়াটা করে নেয় ঠিকই, মার্ক্‌স্‌ ও পায় ভাল, কিন্তু তার মা তাকে ইনিড ব্লাইটন, জেকে রাওলিং, রোল্ড ডাহ্‌ল্‌ এর পাশাপাশি লীলা মজুমদার আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়া অভ্যাস করাতে পারেন নি। ফেলুদা সে পড়ে অবশ্য, সেটা নিতান্তই গোয়েন্দা গল্প বলে।

ঋভু থাকে উত্তর আমেরিকাতে, তার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে ভারতীয়ের সংখ্যা সীমিত, বাঙালি মাত্র একজন, তাও সে আবার নিচের ক্লাসে পড়ে। তারা সবাই শুধু স্কুলে না, বাড়িতেও বেশিরভাগ সময়ে কথা বল ইংলিশ এ। ঋভুকে তার মা ছোটবেলায় বাংলা অক্ষর শেখাতে চেষ্টা করেছিলেন বটে, তবে সে সেইসব খুব বেশিদিন মনে রাখতে পারেনি, চায়ওনি। সে কাজ চালানোর মত বাংলা বলতে পারে, তবে তাকে বাংলা বলা নিয়ে বেশি চিন্তা ভাবনা করতে হয়না, কারণ সে যখন বছরে একবার ইন্ডিয়া যায়, সেখানে সবাই তার সাথে ইংরেজিতেই কথা বলেন। সে দেখেছে, দিল্লিতে থাকা তার পিসির মেয়ে রিমিরও এক অবস্থা। রিমি দিল্লিতে থাকে, ওর স্কুলে বাংলা পড়ানো হয় না। রিমি বাড়িতেও বেশিরভাগ সময়ে হিন্দিতে কথা বলে। আর ওরা দুজন একসাথে হলে দিব্যি ইংলিশ -এই কথা হয়ে যায়। ঋভু এটুকু বুঝেছে, পিসিমণি নিজেও রিমিকে আলাদা করে বাংলা শেখাতে খুব একটা ইচ্ছুক নন। মা'কে বলেছিলেন একদিন- এমনিতেই এত পড়ার চাপ, তার ওপরে আবার আরেকটা ল্যাঙ্গোয়েজ শিখিয়ে কি হবে, যেটা কোনদিন ওর কেরিয়ারের কোন কাজে আসবে না?

তিতির পড়ে শহরের এক অনেক পুরনো , খুব বিখ্যাত বাংলা মাধ্যম স্কুলে। তার স্কুলে সমস্ত বিষয় বাংলাতেই পড়ানো হয়। দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংলিশ পড়তে অবশ্য তিতিরের একটু অসুবিধা হয়। যদিও সে নার্সারি থেকেই ইংলিশ পড়ে আসছে, কিন্তু তার এই ভাষায় দখল একটু কম। আর সেই কারণে তিতির- শুধু তিতির কেন- ওর অনেক বন্ধুই- আসলে মনে মনে একটু মরমে মরে থাকে। কে না জানে, ভাল করে ইংলিশ না বলতে পারলে লোকে পেছনে হাসে? বিশেষ করে কোচিং সেন্টারে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া অন্যান্য ছেলেমেয়েরা! আর বড় হয়ে চাকরি পাওয়ার পরীক্ষা দিতে অসুবিধা হবে না ? তাছাড়া, আজকাল তুমি সিনেমা হলেই যাও, বা শপিং মলে, বা কোন কফি শপে, সবাই তো ইংলিশ-এই কথা বলে, তখন বাংলায় কথা বলতে হলে লজ্জা না? ওরা নির্ঘাত ভাবে কি আনস্মার্ট! তাছাড়া ইন্টারনেটের তো পুরোটাই ইংলিশ। কম্পিউটার-মোবাইল-ট্যাবলেট- সবকিছুর মূল ব্যবহারের ভাষাই তো ইংলিশ। নাহঃ বাবা মোটেও ঠিক করেননি তাকে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে...যদিও তার স্কুলটা দারুণ আর বন্ধুদের সে কোনদিন ছাড়তে পারবে না।

দেবদত্তা, রিমি, ঋজু, তিতির...কার সাথে তোমার মিল বল তো? তুমিও কি আরেকজন দেবদত্তা? বা তিতিরের মত তোমারো কি একইরকম মনে হয়? ঋজু বা রিমির মত তোমাকেও কি মাঝে মধ্যে কোন পিসেমশাই বা মাসিমণির মুখে শুনতে হয় - সেকিরে? একেবারেই বাংলা পড়তে পারিস না?? হ-য-ব-র-ল পড়িস নি?! হিজিবিজবিজ কি চিনিস না? ফেলুদা কি বাংলায় পরিস, নাকি ইংলিশ অনুবাদ?? তোরা আর বাঙালি রইলি না রে ! তখন কি হঠাত করে একটু মন খারাপ? অথবা রাগ? অথবা দুঃখ?

আসলে কি জান, গত কয়েক দশকে,তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে আমাদের কাজকর্ম, জীবন যাত্রা, শিক্ষাব্যবস্থা, সব কিছুতেই বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এবং এই পরিবর্তন একদিনে ঘটেনি। আর সেটা থেমেও নেই, ঘটেই চলেছে। সারা পৃথিবী জুড়ে একে অপরের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুর আদানপ্রদানের জন্যই দেখা যাচ্ছে আমরা ইংরেজি ভাষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এটার হয়ত দরকারও ছিল। কারণ, একটা কাজে যখন অনেক মানুষ যুক্ত, এবং অনেক সময়েই তাঁরা বিভিন্ন দেশেরও, তখন এমন একটা ভাষা ব্যবহার করাই উচিত যেটা সবাই বুঝতে পারবে।

কিন্তু মানুষ তো আর সারাদিন কাজ অথবা পড়াশোনা করে না। তাকে দিনের শেষে ঘরে ফিরতেই হয়। যেমন তুমি, সারাদিন স্কুলে বন্ধুদের সাথে যতই হইচই করে বেরাও, রাতে কিন্তু বাড়ির মানুষগুলোর কাছেই ফিরে আসতে ইচ্ছা করবে; ঘুমানোর আগে মাকে গলা জড়িয়ে ধরে হামি খেতে ইচ্ছা করবে। ঠিক তেমনি, কর্মক্ষেত্রে বা পড়াশোনার সময়ে, এমনকি নানা ভাষাভাষী বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময়েও,আমরা যতই অন্য ভাষায় কথা বলি না কেন, যে ভাষায় প্রথম মা'কে ডেকেছি, সেই ভাষা কিন্তু অন্তরের ভাষা হয়ে থেকেই যাবে। তুমি আজকে তোমার সুবিধামত বাংলা, হিন্দি , ইংরেজি আর হয়ত আরো অন্য কোন ভাষায়, যখন যেমন খুশি কথা বলতে পার। স্কুলে ইংলিশে পড়া দিলে, বন্ধুদের সাথ হিন্দিতে বকবক করলে, বাড়ি এসে ভাইয়ের সাথে বাংলাতে ঝগড়া করলে। তোমার সেই স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ভাব তো একবার, তোমাকে বলা হল তুমি এর পর থেকে ইংরেজি , বা হিন্দি, বা ধরা যাক জাপানি বা লাতিন - ভাষা ছাড়া আর কোন ভাষায় কথা বলতে পারবে না, পড়াশোনা করতে পারবে না, গান গাইতে বা কবিতা লিখতে পারবে না। তাহলে কি হবে? তোমার পছন্দের গানের তালিকায় যে অন্য অনেক গানের সাথে রয়েছে "আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ", তোমার যে "অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি" আবৃত্তি করতে খুব ভাল লাগে...সেগুলি সব বন্ধ হয়ে যাবে? সে তো প্রাণ চলে যাওয়ার মতই অবস্থা হবে, তাই না? আর ঠিক এই রকম কষ্ট পেয়েই বাংলাদেশের, এবং আলাদা ভাবে আসামের বরাক উপত্যকার মানুষেরা তাঁদের মাতৃভাষা- বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে লড়াই চালিয়েছিলেন অন্যায় নিয়ম কানুনের বিরুদ্ধে। বেশ কিছু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে তাঁদের সেই লড়াই সফল হয়। আর সেই সাফল্যকে এখন প্রতিবছর ২১শে ফেব্রুয়ারি কুর্নিশ জানায় সারা পৃথিবী!

ভাব একবার। ভেবে গর্বিত হও। সারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে গর্বিত হতে শেখাচ্ছে কোন ভাষা? - বাংলা ভাষা। পৃথিবীর সমস্ত সচেতন জনজাতিকে নিজেদের মাতৃভাষা সংরক্ষন করতে , মাতৃভাষার জন্য লড়াই করতে প্রথম পথ দেখাল কে?- বাংলা ভাষা। "মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা"- আমাদের সেই বাংলা ভাষাকে আমরা কি অসম্মান করতে পারি? ভুলে থাকতে পারি? থাকুক না তাতে তিনটে র-ড়-ঢ়, হ্রস্ব-দীর্ঘ ই-কার উ-কার মাথায় রাখার সমস্যা বা সন্ধি-কারক-সমাস ! সব ভাষাতেই থাকে সেইরকমের নানা ধরণের সব নিয়মকানুন, যেগুলি সবসময় মনে থাকতে চায় না। তাই বলে কি নিজের ভাষায় লেখা দারুণ সুন্দর সব গল্প-উপন্যাস-কবিতা পড়বে না তুমি? অন্যান্য ভাষা ও সাহিত্যেও যেমন, বাংলা ভাষায় লেখা গল্প-কবিতা-ছড়া -উপন্যাসের পরতে পরতে তো জড়িয়ে আছে বাংলার সমাজ- সংস্কৃতির কথা, ইতিহাস -ভূগোলের কথা, পুরাণ থেকে বর্তমানের কথা; নিজের ভাষাকে না জানলে সেইসব জানবে কি করে তুমি?

আজকের দুনিয়ায়, নিজেকে বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি করাটা তোমার আর তোমার মত সবারই প্রধাণ লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাগিদে তোমার নিজস্বতা হারিয়ে যাচ্ছে না তো? নিজের ভাষা, নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতি, নিজের ঐতিহ্য, নিজের ইতিহাসকে ভাল না বাসলে, তুমি নিজেকে ভালবাসবে কি করে বলতো?

 

২১শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে পড়ে দেখ অমর একুশে, ইচ্ছামতীর বসন্ত ২০০৯ সংখ্যায়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা