ধাঁধা
বলো তো দেখি কী:
১. গোল মন্দিরে শিব প্রতিষ্ঠা, মাথায় কিরণ জ্বলে,
বাইরে থেকে দেবদর্শন, নীচেয় পুকুর চলে।
২. জ্ঞানের যেথায় অন্ত হয়, সেথায় যেতে হলে,
বিলয় হতে নেইকো দেরী,দ্বিতীয় অক্ষর গেলে।
৩. কাজ আছে প্রথম দুইয়ে,শেষের দুইয়ে জীবন,
যদি ও হয় অঙ্গশোভা, তিনে কালো বরণ।
৪. জলশূন্য মাঝখানে, যদি ও আমি ফল.
আগেপিছে জালের আভাস,নামটি ভেবে বল।
৫। সময় আমি আদি অন্তে ,আদি পাখির ডাক,
তিনে মিলে দুর্বল বড়, পথেই বসে থাক ।
(উত্তর পরের পাতায়)
ডঃ জি সি ভট্টাচার্য
বারানসী, উত্তরপ্রদেশ
উত্তরমালাঃ---
১। হ্যারিকেন (লণ্ঠন)
২। বিদ্যালয়
৩। কাজল
৪। জামরুল
৫। কাহিল
- বিস্তারিত
- লিখেছেন জি সি ভট্টাচার্য্য
- ক্যাটfগরি: পুজোর উপহার
রঙ ভরানোর ছবি
এই পাতা থেকে মা দুর্গার এই ছবি ডাউনলোড কর, আর ভরিয়ে ফেল তোমার পছন্দমত রঙ দিয়ে।
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: পুজোর উপহার
পায়ের তলায় সর্ষে
পৃথিবীর ম্যাপটাকে যদি দূর থেকে ছোট করে দেখি, মনে হয় যেন কেউ সেটাকে হাতরুটির মত করে বেলে দিয়েছে। দেখেই বেড়াতে ইচ্ছা করছে। আমেরিকান কোম্পানির ম্যাপ বলেই বোধ হয়, এত ছোট করে ম্যাপটা ধরে থাকা সত্বেও স্ট্যাচু অফ লিবার্টির ফটোখানি ঠিক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মহাকাশ থেকে দেখা যায় কেবলমাত্র চীনের প্রাচীর। এখানে অবিশ্যি গোল পৃথিবীকে বেলে চ্যাপ্টা করে ফেলায় সুমেরু আর কুমেরু হাস্যকর রকমের বড় হয়ে গেছে। অবশ্য তুমি যদি অঙ্কে দড় হও, তাহলে বলবে ওরকমই হবার কথা - যা দেখছি ঠিকই দেখছি - এ জগতে সবই মায়া!!
কিন্তু যদি ম্যাপটাকে কাছে আনতে আনতে একেবারে কলকাতা থেকে শুরু করি, রুটিখানা দেখতে ততটাও খারাপ লাগবে না। ওপর থেকে বেশ ধূসর -হলদে, ম্যাটকা মতন রঙ হয়েছে গঙ্গা নদীর, আমি আপাততঃ বেলঘড়িয়া থেকে সোনারপুর দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। নদীর চারিদিকে এত সবুজ যে ভাবাই যাচ্ছেনা যে একদম নিচে নেমে এলে কি বিষম কেলো দেখতে পাওয়া যাবে !
আমার মূল ইচ্ছেটা হল গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরার। ইতিহাস বইতে যে রাস্তাটার কথা লেখা ছিল, এটাই সেটা। যদি আমার সঙ্গে আসতে চাও তবে তোমাকে তুলে নেব আনোয়ার শাহ রোড থেকে। সাউথ সিটির সামনে । এই সাউথ সিটি হয়ে ইস্তক এই রাস্তায় এমন ঝামেলা বেধেছে, যে চলা ফেরাই দুষ্কর। অথচ দেখ, এই যে আমরা ঢাকুরিয়া লেক থেকে মোড় নেব, সেখানে থিকথিকে বাড়িঘরদোরের মধ্যে একটা কেমন সুন্দর জলে ভর্তি জায়গা। পেছনে স্টেডিয়াম, ক্রিকেট মাঠ কত কি...আর এইটাকে নাকি লোকে বুজিয়ে দেবে ভাবছিল! বেশি ভাবলে এই হয়!
যাই হোক, আসল কথা হল জি টি রোড আমরা মেট্রো লাইন ধরেই যেতে পারতাম। ময়দান অবধি মেট্রোয় গিয়ে তারপর গাড়ি। 'সেইল' কোম্পানির অফিসের সামনে থেকে বাঁদিকে যাব- স্ট্র্যান্ড রোড ধরে হাওড়া। ভাল করে দেখলে কিনা জানিনা, ডানদিকে পড়ল ইস্টবেঙ্গল আর এরিয়ানের মাঠ, তারপর বাঁদিকে মোহনবাগান। তারপর ডাইনে মহামেডানের মাঠ পেরিয়েই দেখ কেমন আউট্রাম ঘাটের দিকে একটা কান্নিক নিয়েছি।
হাওড়া ব্রীজ
ভর গরমে হাওড়া ব্রিজ পেরোতে গিয়ে সুড়সুড় করে বাতাস দিচ্ছে। আমরা ইচ্ছে করলে নৌকায় বসেও দক্ষিণেশ্বরের দিকটা একবার চট করে হয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু থাক, গুলমোহরের মাঠটা ডানদিকে রেখে জিটি রোড ধরে ফেলি। এখান থেকে আড়াআড়ি গেলে বেনারস রোড। এই বয়সে কাশী যেতে চাইলে যাও, আর না হলে সোজা দেখ। এই রাস্তার ওপর সাপুড়েরা আগে হাল হামেশা খেলা দেখাত। এখন তো সে সব আইন করে বন্ধ হয়ে গেছে। বললে বিশ্বাস করবে না, লিলুয়া এখান থেকে মাত্র আট কিলোমিটার, আর আমরা কিনা দূরপাল্লার ট্রেন হলেই হাওড়া ঢোকার মুখে লিলুয়া পেড়িয়ে হালুয়া তে আটকে থাকি। এপথে অবিশ্যি বেলুড় মঠ ও পড়বে, সেখানে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নিলে আশ্চর্য আরাম হবে।
বেলুড় মঠ
এখানে ডানদিকে নদীতে গুটগুট করে নৌকা যাচ্ছে, আর তীরে যত লোহালক্কড়, খোলা-বন্ধ পাটের কারখানা। এরপর দেখবে কেমন ঝিমুনি আসছে- ছোট ছোট টাউন, মাঝেমাঝে গাছপালা। ধুলো উড়ছে, বিকেল হয়ে আসছে, দোকানের সাইনবোর্ডের ঠিকানায় লেখা - রিষড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুর। এসব বললেই এক্ষুণি কেউ আমাকে ক্যাঁক্ করে চেপে ধরে বলবে - এগুলি ছোট টাউন!! অ্যাঁ? সে যাই হোক গে - দুই নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে প্রায়ই আরো জোরে এপথেই লোকে যায়, কিন্তু তারা কি আর বৈদ্যবাটি, ভদ্রেশ্বর, ব্যান্ডেল - এইসব দেখতে পায়? দিনের শেষে তো সেই একটা পান্ডবর্জিত জায়গা থেকে অবশ্য জাতীয় সড়ক ধরতেই হবে, যার সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন হল আদিসপ্তগ্রাম !
একবার হাইওয়েতে পড়লে আর রোখে কে ! যত সব শহুরে জটিল পথের ঘোরপ্যাঁচ ছেড়ে আমরা হুহু করে বেড়িয়ে যাব। পশ্চিমবঙ্গ শেষ হল বলে। জায়গাটাকে যতটা পান্ডব বর্জিত লাগছিল, ততটাও না। তোমার পাচ্ছিল ঘুম, হুট করে ডেকে নিয়ে এলাম বলে সঙ্গে একটা গল্পের বই অবধি নেই, ঘুম পেতে বাধ্য! আমরা আছি পান্ডুয়ার কাছে, এখানে চৌদ্দশো শতাব্দীর একটা মিনার আছে, প্রায় বারো তলা উঁচু।
কার্জন গেট, বর্ধমান
তবে সেখানে না গিয়ে দুধারে ধানক্ষেত দেখতে দেখতে আমরা বর্ধমান পৌঁছে যাব , আর বর্ধমান পৌঁছানো মানেই হল দুর্গাপুর পৌঁছে যাওয়া। শান্তিনিকেতনও যে খুব দূরে, তা নয়। এখানে দুইদিন থাকলে রমনাবাগান ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারিতে লেঙ্গুর আর চিত্রপৃষ্ঠ হরিণ দেখে আসা যেত। আর যেতে পারতাম মাইথন ড্যাম, তোপচাঁচি ঝিল, পরেশনাথ পাহাড় আর তিলাইয়া ড্যাম। পরিবেশবিদরা ঠিক ভুল যাই বলুন, এই মানুষের তৈরি ড্যাম আর ব্যারেজগুলি দেখতে যে কি সুন্দর, বলে বোঝানো দুষ্কর।
তিলাইয়া পেরোলেই বিহার। চারদিকে লাল ধুলো, রুক্ষ, আর তার মধ্যে দিয়ে শোণ নদী বয়ে গেছে। শোণ নদীর ওপর ডেহরিতে একটা বিখ্যাত ব্রিজ গেছে- ইংরেজ আমল থেকে তার নাম হয়েছে 'ডেহরি অন শোণ', ঠিক যেন শেক্স্পিয়রের শহর 'স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন' বা কিংবা 'নিউকাস্ল অন টাইন ' এর মত। শোণ নদী পেরোলে পৌঁছাব সাসারাম বলে একটা শহরে। এখানে নামতেই হবে। সবুজ পান্নার মত জলে দাঁড়িয়ে আছে শের শাহ সুরীর কবর। জলের মাঝে বললাম ঠিকই, কিন্তু আদতে এটা একটা চৌকো পুকুরের ঠিক মাঝখান অবধি তৈরি করা একটা রাস্তা।
শের শাহ সুরীর কবর
এপথে বিহার এটুকুই - কারণ, একটু চালালেই উত্তর প্রদেশ চলে আসে। কিন্তু এত অল্পে তো চোখ ভরে না। তাই তদ্দুর যাওয়ার আগে, ভাবুয়া জেলায় যাব তেলহর কুন্ড। এ জায়গায় আগে ছিল মগধ রাজ্য। ইদানীং বিজ্ঞানীরা এই কুন্ডের আশেপাশে খোঁড়াখুঁড়ি আর খোঁজাখুঁজি করে পাথরে খোদাই করা প্রাচীণ সব ছবি বের করেছেন - আর সে সব ছবির সাথে স্পেনের আলতামিরা গুহার ছবির আশ্চর্য মিল!
উত্তর প্রদেশে অবশ্য এখন এ পথে ক্ষেত আর বিশাল বিশাল কারখানা। এত সুন্দর করে ক্ষেতিবাড়ি হয়েছে যে আকাশ থেকে দেখলে মনে হবে যেন নকশী কাঁথায় নকশা তোলা হয়েছে। মাঝে মাঝে ছোটখাট জনবসতি - ছোট মানে প্রায় শ' দুই পাকা বাড়ি- তত ছোটও নয়। ট্রেনে করে এলে চণ্ডাউলি নামে একটা স্টেশনে এখানে হল্ট দেয়, তারপর মোগলসরাই হয়ে কাশী চলে যায়। কাশীতে এত ক্যাঁচোর ম্যাচোড় আর গন্ডগোল, যে লোকে হালহামেশা ছবি তুলতে ছোটে - তারপর সে সব ছবি বড় বড় আসরে প্রাইজ পায়! কিন্তু আমি কস্মিনকালে গিয়ে উঠেতে পারলাম না, ফেলুদার সিনেমা বাদ দিলে ; আজকেও, কাশীটা বাদ দেওয়াই ভাল। কলকাতা থেকে খুব একটা দূরে তো আসিইনি এখনও। আর গিয়েও বা কি হবে - বেনারস এখন হদ্দ নোংরা হয়েছে,পশু আর মানুষের গুয়ে ভরতি। ফটো থেকে ত আর গন্ধ বেরোয় না রে বাবা!
কাশী থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত রাস্তায় গঙ্গানদী একদম কপিবুক ছকে ভূগোল বইতে দেখানো অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের ছবিটার মতো অ্যাঁকাব্যাঁকা। আর এইযে এলাহাবাদ, তার মধ্যে দিয়ে যে দ্রাঘিমা রেখা গেছে, তার সময়ই আমাদের ভারতের সময়। কলকাতার আসল সময়টা সত্যি করে দেখলে, ঢাকার সময়।
অল সেইন্টস্ ক্যাথেড্রাল, এলাহাবাদ
এত কথা ভাবতে ভাবতে আমরা টুক করে রাজস্থানে ঢুকেছি। এবারে শুরু হবে বালি, হাভেলি আর মন্দির -মসজিদের সমারোহ। ফতেপুরের পর যতক্ষণে জাহানাবাদ, এটাওয়া জংশন, এইসব পেরোবো, গঙ্গার চেয়ে যমুনা নদী অনেক কাছে চলে আসবে। তখন নাক বরাবর গেলেই আগ্রা! আর আগ্রা মানেই হচ্ছে ঘন লস্যি, তাজমহল আর নোংরা গিটগিটে যমুনা নদীর মশা।
তাজমহল, আগ্রা
তা বলে দমলে চলবে না, এরকম মোগলাই জায়গায় কি রোজ আসি? আরো বড় কথা হল, মোগলাই রাজত্ব থাকলেই রাজপুতরা আসেপাশে ঠিক ঘুরঘুর করবে। তাই জন্যেই তো এখান থেকে রাস্তা গেছে সোজা জয়পুর। ওই তো, নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পরে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে, বাজার বসেছে, তরমুজ বিক্কিরি হচ্ছে, তার মধ্যে আবার গরু ছাগলের মত একপাল উট হেঁটে হেঁটে আসছে; এই ধুলোবালির মধ্যে বড় শহর কেবল উদয়পুর, বাকি খাঁ খাঁ; প্লেন ল্যান্ড করার সময়ে বোঝা যায় কেমন বড়।
উদয়পুর
মুশকিল হচ্ছে ঐ 'খাঁ খাঁ' নিয়ে। রাস্তা না জানলে মহা গেরো। তবে ভুল হবার যো নেই। একটা মাত্র মেন রোড একগাদা ঢিপিঢাপার মধ্যে দিয়ে সোজা গেছে আজমেড় শরীফ। আজমেড়েই হল বাবা চিস্তির দরগা, সেখানে চাদর চড়াবো আর কাওয়ালি শুনব। এখানে মসজিদের উঠোনে যা কাওয়ালি গাওয়া হয় , সে শত খরচা করলেও স্টেজে শোনা যায়না। পাকিস্তানে সাঁই জহুর বলে এক দুর্ধর্ষ কাওয়াল আছেন, তিনি বছর তিনেক আগে গানের জন্য একটা বিরাট প্রাইজ পেলেন বিলেতে -ওয়ারর্ল্ড মিউসিক অ্যাওয়ার্ডস্-এ। অথচ তখন ওনার একটিও সিডি, ক্যাসেট, রেকর্ডিং কিচ্ছু ছিল না, কেবল দরগায় দরগায় গাইতেন। সে গান এমন গান, যে লোকমুখে চারিদিকে নাম ছড়িয়ে গেল। বড় বড় চাঁইরা সাঁইকে পরখ করতে এসে চক্ষুস্থির হয়ে গেলেন। ওনার "আল্লা হু" শুনলে বুঝবে গানের মত গান কি করে গাইতে হয়। তবে যা বলছিলাম- আজমেড়ের দর্গায় খুব সাবধান! পকেটমার থিকথিক করছে! এই যে পীর বাবা একটা সাদা চামর দুলিয়ে আমাদের হাওয়া দিচ্ছেন, তিনি পর্যন্ত বিড়বিড় করছেন - 'পকেট সামহালকে, পকেট সামহালকে...!"
আজমের শরীফ
আজমের এর পাশেই হল পুষ্কর। তার মধ্যে নাকি দুর্যোধন ভীমের ভয়ে লুকিয়ে ছিল।যত্ত সব বাজে কথা! আগে এখানে পচা পাতামাতা অসহ্য নোংরা করে রাখত, এখন পরিষ্কার করে বাঁধিয়ে দেওয়াতে ভাল লাগছে। পুষ্করে অনেক কম পরিচিত দেব-দেবীর মন্দির আছে - ব্রহ্মা, সাবিত্রী এসব...মরুভূমির মধ্যেকার জায়গা বলে বোধ হয় বেশি পাল্টায়নি। কিন্তু তা বলি কি করে? এত পুজো-আচ্চার মধ্যেই তো টিনের চালে দেখি 'পিঙ্ক ফ্লয়েড কাফে' - ভেতরে চা আর ভেজিটেবল্ কাট্লেট - ফ্রি ওয়াই-ফাই অবধি পেয়ে যেতে পারি।
পুষ্কর
তবে পুষ্করের ওপারে শুধুই মরুভূমি। এখান দিয়ে গেলে চাক্ষুষ বোঝা যায় আকাশে ধীরে ধীরে পাখি কমে যাচ্ছে, এক কোণায় হয়ত বা একটা ছোট্ট মাজার হলদে পাথরের গা ঘেঁষে পড়ে আছে। একেই বলে থর মরুভূমি। একটা লোক নেই, একেকটা বাড়ির মধ্যে বহু মাইল দুরত্ব, চলতে চলতে চোখে ধোঁয়া লাগে, ততক্ষণ, যতক্ষণ না একটা স্টেশন আসে। এলা রঙ করা স্টেশন, ঝকমক করছে, কোনও যাত্রী নেই, একপাশে লোহার বেড়া। এইখানেই ভারতবর্ষের শেষ। ওপাড়ে উমেরকোট দুর্গ।
তা বলে পাকিস্তানে ঢুকে পড়লেই বোঝা যাবে না যে অন্য দেশে এসেছি। যাবে কি করে? সব তো আগে এক ছিল। একই চেহারার লোক, এক রকম রাস্তা, সব এক; এই তো, শহরের নাম অবধি হচ্ছে হায়দ্রাবাদ! তবে এ হায়দ্রাবাদ, আমাদের অন্ধ্রের নামপল্লী, মানে সে হায়দ্রাবাদের থেকে অনেক আলাদা। তবে দুজনেই কিন্তু সমুদ্রের খুব কাছে। এখান দিয়ে সিন্ধু নদ বয়ে গেছে। এখানে প্রচন্ড গরম - এপ্রিল মাসে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি গরম... বৃটিশ আমলের পুরনো ছবি আছে এই হায়দ্রাবাদের, আপাদ মস্তক ধুলোয় মোড়া দোতলা বাড়ি, মাথায় একটা তেরচা তেকোণা ব্যাপার খাড়া করা- সেই কায়দা করে লাগানো বিরাট তেকোণা ঘুলঘুলি বয়ে শীতল বাতাস ঢুকছে। কেল্লাটা এখনও আছে, কিন্তু বড় দুর্দশাগ্রস্ত। এই ঊষর, ধূসর রাস্তার নাম হল করাচী- হায়দ্রাবাদ হাইওয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, রাস্তা কোথায় নিয়ে চলেছে। করাচী হল সমুদ্রের ধারে মেগাসিটি। সেখান থেকে আরব সাগরের পাড় ঘেঁষে গাড়ি চালালে সিধা বেলুচিস্তান।
করাচী
কিন্তু মুকুলের দুষ্টু লোকের মত আমরা বেলুচিস্তান যাব না। পাসনি বলে একটা নৌকাঘাটা আছে, তার ডানদিকে তুরবাত বলে একটা জায়গায় যাব। কারণ, কিছুই না, সমুদ্র বরাবর রাস্তাটা আসলে এয়ারপোর্টের পরেই শেষ হয়ে যাবে। তুরবাত পৌঁছোলে একের পর এক ড্যাম - এখানেই পাকিস্তান শেষ হয়ে ইরান শুরু হল। এখানে বাহুকালাত বলে একটা লম্বা নদী আছে, তাতে মাঝে মাঝেই কুমীর দেখতে পাওয়া যায়। ভাব একবার - মরুভূমিতে কুমীর ঘোরাফেরা করছে । আবার এই পথেই পাহাড়ের মধ্যে একটা এইটুকু ছোট্ট শহর আছে তার নাম কি না হল 'জবর-দস্ত'! এইটা কিন্তু বেলুচিস্তানেরই অংশ। ইরানশেহর থেকে বাঁদিলে গেলে দেখবে মাঝে মাঝেই একের পর এক সরাইখানা। নানান নাম না জানা শহর, প্রাচীন পারস্যের খোদাই করা মূর্তি। যেগুলির নাম মনে রাখা কঠিন, সেগুলি মনে রাখা কষ্ট। কিন্তু পথে যে কতগুলো হায়দ্রাবাদ, এলাহাবাদ, মোরাদাবাদ, জাহানাবাদ, হোসেনাবাদ, হাজিবাদ, হাসনাবাদ পড়ছে তার সীমাসংখ্যা নেই!
আর এভাবে চলতে চলতেই দেখছি বালির রঙ হলদে থেকে একেবারে ফটফটে সাদা হয়ে গেল। নস্রাবাদের ছুঁচলো চুড়ো দূরে উঁকি দিচ্ছে। এটা খুবই অদ্ভূত, কারণ ইরানে বেশিরভাগ মসজিদের মাথা হয় গোল। এখানকার পাথরের পাহাড়গুলোতে সকাল সন্ধ্যায় এমন সব আশ্চর্য রঙ ধরে যে ছবি তুলে কলকাতায় দেখালেই একেবারে ডবোল ফার্স্ট প্রাইজ দেবে! একটা তো দেবে পাহাড়ের রঙের জন্য, অন্যটা দেবে মরুভূমিতে উট আর উটপাখির ছবি তোলার জন্য;এক্কেবারে বাঁটুল দি গ্রেট এর উটোর মত দেখতে।
উট ও উটপাখি
এই পথেই মসজিদে ভরা 'কোম' বলে একটা শহর পড়ে, তার ঠিক আগের শহরের নাম 'আয়না', আর ইস্ফাহানের দিকে গেলেই নমক লেক।সে এক আশ্চর্য দৃশ্য! টন টন নুন শুকিয়ে গুঁড়ো হয়ে নিজে থেকেই লেকের পাশে পড়ে আছে। লবণ আন্দোলনের মত দলবল নিয়ে নুন তুলতে শুরু করলেই হয় আর কি!
নমক লেক
এ অঞ্চলে অল রোড্স লীড টু তেহরান - সে আমরা যে পথেই গমন করি না কেন...পুরো মরুভূমি ঝেঁটিয়ে পার করে যে কোথা থেকে এতগুলি রাস্তা এসে তেহরানে ঢুকেছে খোদায় মালুম!আজাদী স্কোয়ারের মধ্যে দুপেয়ে আজাদী টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে - কিন্তু এত ভীড় যে আমাদের এগোতে হবে। মাঝখান থেকে মনটা খারাপ লাগছে এই ভেবে যে এ পথেই ইস্ফাহান পড়ার কথা ছিল, কিন্তু পেলাম না। কে জানে কেন? ইস্ফাহানের ফুলের কারুকার্য করা শেখ লুতফুল্লা মসজিদ, রাতে আলো জ্বলা চেহেল সতুন প্রাসাদ, ফ্লোরেন্স এর মত খাজু ব্রিজ, ফুলের বাগান, সব বৃথা গেল।
আজাদী টাওয়ার
তেহরানের উত্তরদিকে গেলে আর মরুভূমি নেই, বরফে ঢাকা সাদা ধপধপে পর্বত। রাস্তার দুধারে রঙিন উঁচু গাছের সারি। আর পাহাড়টা পেরোলেই কাস্পিয়ান সাগর। এখানে বাইশ নম্বর রাস্তাটা পুরোটা কাস্পিয়ানের ধার দিয়ে গেছে। এখানে কোথায়ই বা থামব, আর কোথায়ই বা চালাব?একপাশে সমুদ্র, অন্যদিকে পাহাড় - যেমন সূর্যোদয়, তেমন মায়াময় সূর্যাস্ত। আর তেমন খানাপিনা! মাঝে মাঝে এমন কি কমলালেবুর বাগান পর্যন্ত রয়েছে।
ক্যাভিয়ার ও কমলালেবু
এই বাগান গুলির কাছে 'অঞ্জলি' বলে একটা জেলা আছে,সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্যাভিয়ার পাওয়া যায়। মাছের এমন ডিম শত খুঁজলেও কোথ্থাও পাবো না। সাগর আর পাহাড়ের মধ্যে শুধু ঘন সবুজ জঙ্গল। কে বলবে একটু আগেও সবকিছু ধুলো আর বালিতে ঢাকা ছিল? এই রাস্তাতেই শেষের দিকে 'হয়রান' বলে একটা শহর , তারপর পাড়ের কাছে 'আস্তারা' বলে একটা শহর, আর তার পরেই তুর্কী। না, ভুল বললাম- আজারবাইজান।
কাস্পিয়ান সাগরের তীরে সব থেক বড় নগর বাকু, আজারবাইজান
আজারবাইজান ভারি মজার জায়গা। তুর্কি যেমন এশিয়া আর ইউরোপের সন্ধিস্থল, তেমন, আজারবাইজান হল এশিয়া থেকে রাশিয়া আর পূর্ব ইউরোপ যাওয়ার রাস্তা। আর সেইজন্য এখানে লোকজনের নাম খুব মজাদার - যেমন- 'আরিফ রাজ্জাকভ' বা 'জামিল গুলিয়েব' বা 'নাফিসা আব্দুল্লায়েভ' কিংবা 'ফরিদ মনসুরভ'। আর এদের খাওয়া-দাওয়া অতি উৎকৃষ্ট। দেখেছ - দোকানে কি বিকোচ্ছে? আমরা যাতে না বুঝতে পারি তাই নামটা কেবল অল্প করে বদলে দিয়েছে। গনগনে গরম কৌরমা প্লেট, সবজি দিয়ে জোবজা কৌরমা প্লেট, তারপরে দোল্মা, শরবত- এইসব। এরা কিন্তু খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব সিরিয়াস। আমরাও।
আজারবাইজানের খাবার
ইরান ও আজারবাইজানের এক সীমান্ত
আসলে আমরা এমন একটা জায়গায় আছি যেখানে ক্রমশঃ দেশ বদলে যাচ্ছে। খালি সীমান্ত আর সীমান্ত - একটু এদিক ওদিক করলেই ইরান থেকে আর্মেনিয়া হয়ে জর্জিয়া,তুর্কি এইসব জায়গায় পৌঁছে যাব। তবে রাস্তা একটাই। আজারবাইজানের 'গাঞ্জা' শহর দিয়ে আর্মেনিয়ার 'লেক সেভান' -এ। এই লেক এর ওপরে একটা অসাধারণ সুন্দর চার্চ আছে। সেভান লেকের অবস্থা এক সময়ে আরল সাগরের মতই হয়ে যাচ্ছিল।
লেক সেভান, পাড়ে চার্চ
আরল সাগরের গল্পটা জান তো? এই বছর ত্রিশ-চল্লিশ আগেও আরল সাগর ছিল পৃথিবীর পাঁচটা বৃহত্তম হ্রদ গুলির মধ্যে একটা। তারপর ওখানে একটা ড্যাম বানাতে গিয়ে কুড়ি বছরে সব খতম। যা পড়ে আছে, তাতে এত রাসায়নিক বিষ যে মাছ চাষ অবধি বন্ধ হয়ে গেছে। আবহাওয়াও আর আগের মত নেই। লেক সেভানে ঠিক এভাবে জল কমিয়ে চাষবাসের কাজে লাগাতে গিয়ে সবকিছুর বারোটা বেজে যাচ্ছিল । কিন্তু সময় মত মানুষের টনক নড়ায় সেটা আটকানো গেছে।
সেভান লেক থেকে দক্ষিণে নেমে এলেই হল আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভান। আর তার নীচে বয়ে চলেছে আরাস নদী। সেই নদী পেরোলে আবার তুর্কী। এই আরাসের কাছে আরারাত পাহাড় দেখতে খুব ভাল লাগে। এই আরারাতেই নাকি নোয়ার নৌকা ফেঁসে গেছিল। কয়েকশো বছর আগে আরারাত ছিল আগ্নেয়গিরি। আর এখন মাথাভর্তি বরফে তার মাথা ঠান্ডা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, ১৮৪০ সালে একখানা ভূমিকম্প হয়েছিল বটে, তখন নাকি ভেতরে ভেতরে লাভা বেরিয়েছিল।
আরারাত পাহাড়
এই এলাকায় তুর্কীর সেই বিখ্যাত শহর 'কার্স' - যার ওপর কিনা নোবেলজয়ী লেখক ওরহান পামুক ' স্নো' বলে এক অসাধারন বই লিখেছেন। এখান থেকে শত শত রাস্তা জট পাকিয়ে এ শহর থেকে ও শহরে চলে গেছে। শহরের আয়তন অকিঞ্চিৎকর হলে কি হবে - তুর্কীর শহর, এমনকি এরজুরুমের মত মেজ শহরেও না থেকে পারব না।
এরজুরুমের মিনার
এ অঞ্চল আদিতে ছিল আনাতোলিয়া - রোমান আর গ্রীক সাম্রাজ্যের স্মৃতি এখনও রাস্তায় রাস্তায়। বাইজান্টাইনরা এই জায়গার নাম দেয় থিওডোসিপোলিস। দূর থেকে দেখবে এসব শহরের মাথায় এখনও মসজিদের চূড়ো বর্শার ফলার মত দাঁড়িয়ে আছে। তুর্কীর পূব থেকে পশ্চিমে গেলে প্রথমে বরফ থেকে সমতল, তারপর নানা হ্রদ, জঙ্গল, মিনার। আর এসবের মধ্যে গোলকধাঁধার মত নকশা আঁকা রাস্তা। মাকড়শার জালের মত এই পথ ধরে উপরে এলে দেখি কি আশ্চর্য - আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে একেবারে কাস্পিয়ান সাগর! আহা না, এটা নির্ঘাত কৃষ্ণ সাগর ! তবে এর অবস্থা আরলের মত না। জান তো, প্রাচীনকালে এই সমুদ্রের মত হ্রদ ধরে ইরান হয়ে বহু মানুষ ভারতবর্ষে পা দিয়েছিলেন।
কৃষ্ণ সাগর
আর হ্রদ থাকলেই পাশ দিয়ে ঠিক রাস্তা করা রয়েছে - গভীর জল, পাহাড়, সূর্যাস্ত - আর কি চাই ! এখানে এত জনপদ, কিন্তু জীবনে এদের নাম শুনিনি - কোকামান, পাশালর, কারাসু, উজুনকুম, কোপরু, চিকো, কাদিকোয় ...
কিন্তু দেখ, কাদিকোয় তো লোকে ইস্তাম্বুল থেকে এমনি এমনিই যায়; তবে কি আমরা ইস্তাম্বুলের আশেপাশে এসে পড়েছি কোথাও? বলতে বলতেই আন্দালু হিসরি এসে পড়েছে, সাগর কেমন পাতলা হয়ে একটা প্রণালী তৈরি করে ফেলল, একের পর এক নৌকা আন্দালু কাভাগির দিকে যাচ্ছে - এটা নিশ্চয় বসফরাস প্রণালী!
ইস্তানবুল
যা বুঝছি, আমরা প্রায় ইস্তাম্বুল এসেই গেছি। এবার আর গাড়ি না চালিয়ে একটা নৌকায় উঠে পড়লেই হয়। প্রণালীর পূর্ব দিকের সব কটা ঘাট বা বন্দর পড়ে এশিয়ার দিকে আর পশ্চিমে সবকটা পড়ে ইউরোপের মধ্যে। মাঝে দুটো বিশাল সেতু স্থলপথে ইউরোপ আর এশিয়াকে দুটো সুতোর মত আটকে রেখেছে। প্রণালীর উল্টোদিকে মর্মরা সাগর- অবশ্য মর্মরা মানেই তো সাগর। আমরা চলে আসছি এমিনোনুর জাহাজঘাটায়, সারাটা রাস্তা একের পর এক মিনার আমাদের পাশে - এখানে ছিল অটোমান সুলতানদের প্রাসাদ, আর বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের গোড়া। অবশ্য তখন তো আর ইস্তাম্বুল নাম ছিল না, নাম ছিল কন্স্টান্টিনোপ্ল্। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে এসব গল্প করছি তার নাম হালিচ, বা গোল্ডেন হর্ন। হালিচ ছিল বাইজান্টাইন নৌবহরের প্রধান কেন্দ্র। দেখতে পাচ্ছ কি, কিভাবে একটা তলোয়ারের মত এ জায়গাটা মর্মরায় ঢুকে গেছে? বিকেলের রোদে সেই তলোয়ার সোনার মতই ঝকঝক করছে। আর হ্যাঁ, এখানে এশিয়া শেষ হয়ে গেল, ওপারে ইউরোপ।
মর্মরা সাগর এবং গোল্ডেন হর্ন
বিক্রম
ডাব্লিন, আয়ারল্যান্ড
- বিস্তারিত
- লিখেছেন বিক্রম
- ক্যাটfগরি: পুজোর উপহার