পূজোর চিঠি
(১)
প্রিয় দাদুভাই,
কি করছো তুমি?এখন?আমার একদম ভাল্লাগছেনা মনটা।কি করি কি করি উশখুশানির মাঝেই হাল্কা নীলচে ইনল্যান্ড নিয়ে বসে গেছি।বুকের তলায় বাঁধানো খাতার ওপরে ইনল্যান্ড রেখে লিখতে বসেছি তোমায় এখন,তোমার পাঠানো কালিপেনটা সুলেখাতে চুবিয়ে।
ঘড়িতে দশটার ঘন্টা সবে পড়লো ট্যাং ট্যাং করে।বাবা অফিসে বেরিয়ে গেছে আধ ঘন্টা আগেই।অন্য সময় হলে এসময় ফিটফাট হয়ে সাইকেল নিয়ে চোঁ করে ...স্কুলে।কিন্তু আমার কলার ওঁচানো লাল টুকটুকে সাধের সাইকেলটা গোঁত্তা খেয়ে মুখ ভার করে উঠোনের চৌবাচ্চার পাশে বন্দী।আমার জ্বর!বাইরে ঘরের হলদেটে সানমাইকারে মোড়া উঁচু ডিভানের বেশ তুলতুলে গদিতে আমি বন্দী,সামনে জাল লাগানো জানলার গরাদ আর গরাদের ওপারে মেঘলাটে রোদ আর ঝুপঝুপে বৃষ্টির লুকোচুরি,মাঝে মাঝে বাগান ভরা জল আর জলে কিলবিলে তেচোখা মাছ আর সাঁই করে টেঁরিয়ে বেঁকিয়ে চলে যাওয়া হেলে সাপ।আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।অন্যবারের মতো।আকাশের মুখভার কি আমায় দেখেই!কে জানে?জানলায় বসেই বাইরেটা দেখা... গেলোবারে দেখা অমল ও দইওয়ালা নাটকের অমলের মতো।ফিক করে হাসি পেলো।উঁচু ক্লাসের বাংলার স্যার গোপাল জ্যেঠু একতাড়া কাগজ দেখে এমন জোরে পেছন থেকে ডায়লগ গুলো বলে দিচ্ছিলো যে যারা নাটক করছে তাদের থেকে জ্যেঠুর আওয়াজ বেশী পাওয়া যাচ্ছিলো।স্যার দিদিমনিরাও তো হেসেই কুটিপাটি।আমিও যেন সেই অমল।কিন্তু আমার এই জানলাটা এক্কেবারেই রাস্তার ওপরে নয়।তারওপর জানলার ঠিক ওপারেই...বারান্দায় টাঙানো তারে, মা সার সার করে শাড়ী মেলে দিয়েছে শুকোতে,এই মেঘ বাদলের দিনে।টুপ টুপ করে জল পড়ছে লাল নীল হলদে শাড়ী বেয়ে...চুঁইয়ে চুঁইয়ে।লোহার গেট ছাড়া অনেকটাই দেখা যাচ্ছে না বাইরের।মনটা কি করি কি করি করছে আবার আনচানও করছে শরীর খারাপে।
ঠিক কালকে , এমন সময়ে গেটে সাইকেলের কিড়িং!চেনা শব্দ।মোটাসোটা কাকুটা,খাঁকি ফুল শার্ট আর ফুল প্যান্টের।সাইকেলের দুপাশে কালো ইয়াব্বড় ব্যাগে আমাদের স্বপ্ন দিয়ে বাড়ী বাড়ী গিয়ে গেটের সামনে সাইকেল থামিয়ে ঐ একটা আওয়াজে মনটা খুশীতে ঝলমলিয়ে দেয়...কিড়িং।কাকুর নাম জিজ্ঞেস করিনি কখনো।কেন?জানিনা,ভাবিইনি কখনো হয়তো।গা থেকে লেপ ছেড়ে এক দৌড়ে গেটের সামনে।মুখে এক ফালি মায়াবী হাসি নিয়ে গেটের লোহার শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে আমাকে বাড়িয়ে দিলো আমার অদেখা জানলা,এমাসের নতুন শুকতারা।আমার সব মুখভার সূর্য্য ওঠা রোদের মতো ঝকঝকিয়ে হেসে ফেললো।নাচতে নাচতে বাইরে ঘরের ডিভানে আবার।ততক্ষনে মা এসে গেছে হাত মুছতে মুছতে।রান্না করছিলো মাগুর মাছের ঝোল, হাল্কা গোলমরিচ দিয়ে।‘বাবলাই... তুই খালি পায়ে কেনো বেরোলি? তোকে বললাম না হাওয়াই চটি পরে বেরোতে?আবার জ্বরে পড়লে কি হবে?’ আমার কানেই ঢুকছেনা মায়ের রোজকার ঢিস্যুম ঢিস্যুম।আমি একমনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি নতুন শুকতারার গন্ধ শুঁকতে।
বাঁটুলের বুকফোলানো অবিশ্বাস্য কান্ড কারখানা পড়ে যা হাসি পায় না!আর হাঁদাটার ওপর খুব রাগ হয়;ঠাস ঠাস করে দুটো চড় কষিয়ে দিলে ভালো হতো।অনেকটা আমাদের কেল্টুদার মতো।কেল্টুদার যেমন যত কেদ্দানি নন্টে-ফন্টের ওপর!তেমনি হাঁদাটার খালি ধান্দ্বা বেকায়দায় ফেলা ভোঁদাকে!আর ভোঁদাটা কিন্তু ভীষন মিচকে; কেমন বোকা বোকা মুখ করে থাকে আর একদম শেষে গিয়ে পট করে জিতে গিয়ে কিরকম বিজ্ঞের হাসি দেয়!তখন হাঁদার মুখটা দেখে যা হাসি পায় না!দাদুমনির চিঠি পড়ে ফেলি মন দিয়ে।তারপর পাতা ওল্টাই... ফর্ ফর্।এপাতা ওপাতা,কোনটা যে আগে পড়ি!এমন সময় মায়ের গলার আওয়াজ।মা চান করতে ডাকছে!হিটারে হাঁড়ি ভর্তি গরম জল বাথরুমের বালতিতে ঢেলে,চৌবাচ্চার জলের সাথে মিশিয়ে।খোলা শুকতারাটা বিছানায় উপুর করে ফেলে রেখে উঠে পড়লাম আড়মোড়া দিয়ে।আজ এটুকুই।আমার এত্তো ভালবাসা নিও।ও আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছি।জানোতো, মা সেদিন কাঁদছিলো তোমার কথা বলে আর বলছিলো তোমার নাকি অসুখ হয়েছে? কি অসুখ গো?জ্বর? সেতো আমারো হয়েছে!বাবা ছুটি পেলেই আমরা তোমাকে দেখতে যাবো , মা বলছিলো।কিন্তু বাবার অফিসের খুব চাপ এখন ,বাবা বলছিলো।খুব রাগ হয় বাবার ওপর;খালি কাজ...কাজ... কাজ !তবে পূজোতে তো যাচ্ছিই তোমার কাছে।এখনো মা নিয়ে যায় নি গো কলোনী মার্কেটের ক্যালকাটা টেলরে ।শার্ট আর প্যান্টের পিসগুলো আলমারিতেই বন্দী এখনো।তোমার পূজোর বাজার হয়ে গেছে দাদুভাই? কেমন আছে সবাই ওখানে?
ইতি তোমার বাপন
(২)
স্নেহের বাপন,
তোর চিঠি পেয়েই মনটা ভালো হয়ে যায়।এখানে সবাই ভালো।নারে এবাড়ীর পূজোর বাজার হয়নি এখনো।এ্যাই জানিস তো,তোর বড়মামা একটা হাঁসের বাসা তৈরী করেছে বাড়ীর ভেতরে।বেশ বড়সড় আর লম্বাটে।ভেতরে হাঁসগুলো প্যাঁকপ্যাঁকাচ্ছে রাত দিন।তোর দিদা মাঝে খুব রেগে গেছিলো।একদিন একটা হাঁস নাকি ঠোঁট বাগিয়ে তেড়ে এসেছিলো তোর দিদার দিকে।সেই থেকে তোর দিদা আর ওই ঘরে ওদের খেতে দিতে যায়না।তোর বড়মামাকে তো জানিস,রোজ সক্কালে উঠে তিনতলার ঘরে পূজো টূজো সেরে লুঙ্গি পরে গামছা কাঁধে নিয়ে নীচতলার মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড়ে যায় ডুবকি লাগাতে।ভুস ভুস করে চারপাঁচটা ডুব মেরে ঠাকুর প্রনাম সেরে ,ওর সাধের হাঁসেদের জন্য কেঁচো,গেঁড়ি গুগলি, পোকা মাকড় জোগাড় করতে যায় জেলেদের কাছে।জেলেরা এর মধ্যেই সপাং করে নীল জাল ছড়িয়ে দিয়েছে পুকুরের জলে আর ছোট ছোট ভেলা নিয়ে সারা পুকুর ভেসে বেড়াচ্ছে মাছ ধরার জন্য।আমি দোতলা ঘরের জানলা দিয়ে সব দেখি।সক্কালের হলদেটে রোদ্দুর পুকুরের সবুজ পানা কচুরী ঢাকা জলে পড়ে চক চক করে ওঠে আর কালো কালো জেলেদের নীলচে জালে রুপোলী মাছে রোদের হলদে রঙ পিছলে গিয়ে চোখটা ধাঁধিয়ে দেয় জানিস।তোর বড়মামা সদর দরজা খুলে সোজা ঢুকে যায় হাঁসেদের ঘরে।সকাল সকাল খাবার দাবার খেয়ে হাঁসগুলোর সে কি প্যাঁকপ্যাঁকানি রে!আমার এখন নীচে যাওয়া বারণ,তাই আমি ওপর সব দেখি বাপন।নারে সোনা আমার জ্বর জ্বালা হয়নি।আমার শরীরে একটা কালচে ঘা ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরের বেশীরভাগ ঘরে।রক্তকে দূষিত করে দিয়েছে ওই ঘা-টা।এই ঘা-এর কোনো চিকিতসে এখনো নেই দাদু।আমি তাই এখন জীবনটাকে বেশী বেশী করে উপভোগ করছি।খুব ছোট ছোট জিনিষেও খুব মজা পাওয়ার চেষ্টা করছি।আর আশ্চর্য্য কি জানিস,মজা পাচ্ছিও!এই ছুটির দিনগুলোতেই আমি বুঝেছি আরো বেশী করে আমাদের হাতেই আছে আমরা কিসে মজা পাবো আর কিসে মজা পাবোনা এর চাবিকাঠি!আমি যখন তোর মতো ছিলাম ,এই ক্লাস সিক্স সেভেনে পড়তাম,তোর মতো আরাম তো আমি পাইনি কখনো।আমার জীবন ছিলো কষ্টে ভরা।আমার স্কুল মাষ্টার বাবা সিল্কের ব্যবসা করতে গিয়ে ভিটে মাটি সর্বস্ব খুইয়ে বসে।আর আমি পড়াশোনার নেশায় মাহেশের কাছে এক জমিদার বাড়ীর আশ্রিত হয়ে বড় হতে থাকি।সেসব বড় কষ্টের দিন রে দাদু।আমার খাওয়া হতো মন্দিরের ভোগে।আর সারাদিন জমিদার বাড়ীর নানা কাজকম্মের ফাঁকে ফাঁকে নানা পড়াশোনা।এভাবেই আমার কেটে গেছে তোর মতো বেলাটা।এখন তাই তো তোকে বলি,বড় হবার কথা ভাববিনা।বড় হলেও মজা আছে কিন্তু ছোটবেলার মজাটা সবচেয়ে সেরা মজা জানিস।ভাববি কি করে মজা করবো আরো…রোজ।আমি এখন জানি আর কিছুদিন পরেই এই পৃথিবী থেকে আমাকে চলে যেতে হবে।কেন জানিনা আমার মনে হয় আমি আবার আমার ছোটবেলায় ফিরে গেছি।তাই তো দোতলার ঘরের এই কাঠের চেয়ারটায় বসে আমি আমার ছোটবেলার আনন্দগুলোকে দেখতে চাই রোজ।কি যে মজা লাগে রে।যেন উলোটপূরাণ!বেলা বাড়লেই পুকুরের ওপারের ডোমপট্টির ছেলে গুলো ঝপাং ঝপাং করে করে লাফিয়ে পড়বে জলে,হাপুস হুপুস করে চান করবে।মাছরাঙা পাখিটাও দত্তবাড়ীর পুকুর ঘেঁষা বাঁশ ঝাড় থেকে নজর রাখবে বুদবুদকরে চোখ পিটপিটানো মাছের দিকে।সুযোগ পেলেই সোঁ করে উড়ে এসে খপ করে ধরবে কোনো মৃগেল পোনা।
রাস্তা দিয়ে হাঁকতে হাঁকতে লাল দই যাবে নীচে।লাল লাল ইট ভর্তি গাড়ী যাবে গাঁক গাঁক করে।আর কত যে লোক যায় সারাদিন,আমি শুধু দেখতেই থাকি।এই বয়সে এসে মনে হয় রবীঠাকুরেরও নিশ্চয়ই এমন দিন গেছে না হলে ডাকঘরের মতো ছবি বড়বেলায় আঁকা যায়?
বাবার ওপর রাগ করিস না রে।কত দায়িত্ব জানিস তোর বাবার?হুট করে দায়িত্ব ছেড়ে চলে এলে আমিই তো রাগ করবো।পূজোর ছুটিতে আসবি যখন অনেক কথা হবে।আমি কিন্তু তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো বাপন...
ইতি,দাদুভাই
(৩)
প্রিয় দাদুভাই,
আর মাত্র মাসখানেক পূজোর ছুটি হতে।তোমার ঘায়ের কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।বাবুল মামা তো বিরাট বড় ডাক্তার ,ঠিক সারিয়ে দেবে দেখবে।আর না হলে ঘা-টাকে ঠেকিয়ে রাখতে বোলো,আমি ডাক্তার হলে ঠিক সারিয়ে দেবো তোমার ঐ দুষ্টু পচা ঘা টাকে।আর তো মাত্র কটা বছর ,বলো?আমার না খুব আনন্দ হচ্ছে তোমায় দেখবো বলে।জানো দাদুভাই,এবার আমরা বেশ অন্যরকম ঝুলন করলাম।অন্যবারে তো পল্লবদের বাড়ীর টিনের দরজার পাশের ঘাসের চাঙর কেটে ঝুলঝুরে কাদা মাটি ফেলে দিয়ে উঠোনের তুলসী মঞ্চের পেছন থেকে চাঁছা শ্যাওলা দিয়ে পাহাড় বানাই... ; এবারে না ঠাম্মার একটা সাদা পুরোনো শাড়ী ছিঁড়ে বালতীভর্তি কাদায় চুবিয়ে পাহাড়ের মতো করে বসিয়েছিলাম মাটির তালের মধ্যে গোঁজা কঞ্চির ওপরে।আর সারা দিন ফ্যানের হাওয়ায় শুকিয়ে বিকেল নাগাদ খড়খড়ে পাহাড়ের মতো হয়ে গেলে ওপরে ছিটিয়ে দিলাম চকচকে অভ্রের দানা।কি সুন্দরই না লাগছিলো।মিলন মন্দিরের বড় গেটের সামনের পাথর কুচির ঢিবি থেকে বেছে বেছে তো আগের দিনই খুব কুঁচো পাথরগুলো নিয়ে রেখেছিলাম আর সেগুলো দিয়েই তৈরী হলো আমাদের রাস্তা।রাস্তা দিয়ে হাঁটলো লালবাগের ফকির , পৌষমেলার বাউল আর ছাতা মাথার মাষ্টারমশাই।সবুজ আবীরে মাঠ হলো,সেই মাঠে কৃষ্ণনগরের মাটির চাষা ধান বুনলো।নীল আবীরে হলো পুকুর আর পুকুরে প্লাষ্টিকের হাঁস আর লাল-নী-হলদেটে রাবারের ছুটকো মাছগুলো খেলে বেড়ালো সারা ঝুলন দিনটা।রাস্তায় রাস্তায় প্লাষ্টিকের গাড়ী,মাটির গরুর গাড়ী তো ছিলোই আর ছিলো ধপধপে সাদা তাজমহল।আবার তাজমহলের সামনে যুদ্ধও লেগেছিলো জোর... সেপাই,সান্ত্রী,রাজামশাই,ঘোড়া,হাতি ... সব্বাই হাজির।আর পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে লুকোনো টেবিল ল্যাম্পের আলো , কাঁইচি দিয়ে তাক লাগিয়ে কাটা সূর্যের ওপরে ছটা মেরে রোদ্দুর দিচ্ছিলো এই পুরো সাম্রাজ্য।পাহাড়ের নীচটায় ছিলো ঘন জঙ্গল,পার্থেনিয়ামে ফুল আর পাতা লাগানো,আর ফাঁকে ফাঁকে ছিলো বাঘ,সিংহ,শেয়াল,সজারু...;মনে আছে তোমার গেলবারে মালদা থেকে তুমি কিনে দিয়েছিলে জঙ্গুলে প্যাকেটটা, মনস্কামনা মন্দিরের সামনের দোকানটা থেকে?
এখন তো জোড়তোড় ক্লাস চলছে রোজ।ডাকব্যাকের সবুজ ব্যাগটায় রোজকার সিলেবাসে ভরা দিনগুলোকে ভরে চলে আসি স্কুলে, খাঁকি হাফ প্যান্ট আর সাদা হাত কাটা জামা পড়ে।জানো দাদুভাই বাবুয়া বলছিলো আমার নাকি মোচ উঠছে।হঠাত-কলোনীর সুজিত নাকি ওর বাবার রেজার দিয়ে মোচ চেঁচেছে।ওতে নাকি আরো বাড়বে।মা খুব বকছে এসব শুনে আমায়।বলেছে ওর সাথে না মিশতে।আহা ওর কি দোষ বলো?বড় হতে তো সবার ইচ্ছে করে।ওর হয়তো তোমার মতো দাদুভাইই নেই যে ওকে কানে কানে শিখিয়ে দেবে রয়েসয়ে বড় হওয়াই ভালো।জানো দাদুভাই চিন্টু কি করেছে ?কপালে গামছা দিয়ে ঘঁষে ঘঁষে থার্ড আই বের করার চেষ্টা করেছে! বাবা আমাকে বলেছে ওসব কু সংস্কার।বলেছে,আমরা আমাদের দুটো চোখের বাইরে যে চোখটা দিয়ে সবকিছু দেখি সেটা থার্ড আই নয়,সেটা মনের চোখ!মনের চোখ কি গো?আমাকে বুঝিয়ে দিও তো ; শিগগিরি চিঠি দাও।
ইতি তোমার বাপন
(৪)
ওরে আমার বাপনসোনা,
তোর চিঠিই এখন আমার মনের চোখ সেটা জানিস?না না ভ্রু কুঁচকাস না অমন করে।আসলে আমি এতোদিন দোতলার ঐ জানলার ধারের চেয়ারটাতেই সারাদিন বসতাম আর মাঝে মাঝে তোকে চিঠি লিখতাম।জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে আমি পৃথিবী দেখতাম।দিনকয়েক ঐ জানলাটা আমার চোখের বাইরে।ডাক্তারের বারণ।বলেছে আমায় শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে।আমি শুয়ে আছি খাটে… প্রায় সবসময়।আর গতকাল তোর ছোটমামা তিনপাহাড় থেকে ফিরেছে অনেক রাত্রে,ওখানকার সার্ভে শেষ।আজ সকালে তোর চিঠিটা আমায় দিলো আর তিনপাহাড়ের অনেক গল্প করলো।জানিস ওখানে একটা সাধু বছরের পর বছর মৌনিবাবা হয়ে লোকের পূজ্যস্থানীয় হয়ে উঠেছিলো নানা চমতকার দেখিয়ে।পরশু দুপুরে সে নাকি ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।সে নাকি উত্তরপ্রদেশের এক মস্ত বড় ডাকাত দলের চাঁই!ওসব তৃতীয় নয়ন বলে কিছু নেই রে।আর কেউ বলে দিলো আর অমনি বিশ্বাস করে নিলি ,অমন মন কক্ষনো করবিনা।বেশীরভাগ লোক দুর্বল সেটা জানিস তো।কিছু করতে না পারলেই বুজরুকিতে আশ্রয় করে।সেটা না করে প্রশ্ন করবি,নিজের মনকে।কেন করবো আমি? কেন ?কেন? এই কেন প্রশ্নটাই দেখবি তোর এগোনোয় পথ দেখাবে।তোর চিঠি পড়ে আমি তোকে দেখলাম আমার মনের চোখ দিয়ে।আমার কল্পনার চোখ দিয়ে।আসল চোখ কিন্তু মনের।এই চোখ দিয়ে তুই খুব গরম কোনো দুপুরে কল্পনা করতেই পারিস বসে আছিস ফুরফুরে কোনো পুকুরপারে!ভিড় বাসে মুরগীবাচ্চার কঁককঁকানি আর মেছো আঁশটে গন্ধে মনটাকে বিরক্ত হতে না দিয়ে তুই দেখতেই পারিস তোর ঠাকুর্দার দেশ এরোয়ালী গ্রামের বড়কালী বিসর্জনের বাজীপোড়ানো রাত।যা চোখ দিয়ে দেখছিস সেটাই কিন্তু শুধু দেখা নয় রে, মনটা দিয়ে চোখের দেখাটাকে বদলে দিতে পারলেই দেখবি খুশীতে ভরে গেছে দুঃখের দুপুরগুলো।
বাপন আমি এরপর আর চিঠি লিখতে পারবোনা।ডাক্তার সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে।বলে, আপনার শরীরের কষ্ট হচ্ছে।বিশ্রাম দরকার।কি বোকা এরা বুঝলি!এরা সারাদিন খুব ব্যস্ত আমায় নিয়ে।কিন্তু এরা বোঝেনা আমি না দেখতে পেলে আর লিখতে না পেলেই তাড়াতাড়ি চলে যাবো।ভাগ্যিস মনের চোখ দুটো ছিলো।এই চিঠিটাই তোকে লেখা আমার শেষ চিঠি রে।কেন? সেটা বুঝবি কিছুদিন পরেই।না এটা তোকে আমি বোঝাবোনা।এটা তোকে নিজেই বুঝতে হবে।তুই তো এখন সদ্য কৈশোরে হাঁটি হাঁটি পা...কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেখবি মোলায়েম মোচ পেরোনো বেয়ারা বয়েসেও তোকে সমান ভাবাচ্ছে।আমি জানি আমি অনেক শক্ত শক্ত কথা বলছি,কিন্তু এসে যাচ্ছে রে।আসলে মনে হচ্ছে ওরা জোর করে আমার একটা চোখ কেড়ে নেবে একটু পড়ে।আমি ... আর আমার বুকের রক্তগুলোদিয়ে শব্দ গড়তে পারবোনা এই জীবনে।খুব কষ্ট হচ্ছে রে।মনে পড়ছে সেই ছেলেবেলার কথা।জাপানী বোমার ভয়ে জমিদার বাড়ীর পাশের আগছা জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকার দিনগুলো।সাইরেন বাজলেই দুরদার করে সব্বাই মাটির নীচে।তারপর একদিন আমাকে চলে যেতে হলো আমার মামা বাড়ীর দেশে।পদ্মাপাড়ের হরিতকীপুরে নদীর দুলকি চালে পৌঁছে গেলাম একদিন।সার সার টিনের চালে ছড়ানো বিশাল এলাকা জুড়ে আমার মামার বাড়ী।বড় মামা ষ্টীমার ঘাটের এজেন্ট।যখন তখন ঝপাং করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নান... আর ভটভটিতে মাঝি মাল্লাদের রান্না করা হাঁসের কষা মাংসের স্বাদ।
সেই একমাস যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।বাড়তি একটু খুশী।তারপরে হঠাত আবার এদেশ, সেই জমিদার বাড়ী,সেই পূজামন্ডপের চাতাল।সবকিছু সেই...সেই...সেই।আবার ওরা কেড়ে নিলো আমার আনন্দটা।এখনো আমার সেরকম মনে হচ্ছে জানিস।আগেকার দিনগুলো বড্ড মনে হচ্ছে।আর ভয়ও হচ্ছে মনের চোখটা চলে যাবে নাতো?বিষাক্ত ঘাগুলো হিস হিস করে নীলচে ফনা শাঁসাচ্ছে মনের ওপরেও।ছোবল বসাতে কতক্ষন? আমার প্রিয় বাপন।আমি জানিনা,তোর সাথে এজীবনে আর দেখা হবে কিনা।সত্যিই জানিনা।কিন্তু পূজো আসছে।টিভিতে ঢ্যাম কুড়াকুড় সারাক্ষন।শচীন কর্তা আর মানবেন্দ্রর বিখ্যাত গানগুলো আবার কে সব গেয়েছে দেখি।এবাড়ীতে টিভির লোকদেখানো আনন্দ আমাকে খুশী রেখে বাকীদের শাড়ীর আঁচলের আড়ালে চোখের জলের শব্দ ঢাকার জন্য।আমি সব জানি রে।বলি না এদের।কষ্ট হয় আমার।তোকেই বলি সব।বললাম এসব...শেষবারের মতো।ভালো থাকিস।মানুষের মতো মানুষ হোস।ডাকব্যাকের ব্যাগে মোড়া সিলেবাসের দিনগুলোর চেয়ে অন্য সিলেবাসের ভালো মানুষ হওয়া অনেক ইম্পর্ট্যান্ট রে।বুঝিস এটা সারা জীবন ধরে।এপর্যন্তই থাক... বাকি জীবনের মতো।খুব শিগগিরি চললাম।আবার কখনো পরে দেখা হলে চিনতে পারবিতো?আমি কিন্তু তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।
তোর দাদুভাই
অতনু ব্যানার্জী
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
বড়দেবীর পুজো
বাগডোগ্রা এয়ারপোর্টে পিনাকীরঞ্জনের বিমান যখন ল্যান্ড করল, তখন তাঁর ঘড়িতে সকাল দশটা। ধবধবে সাদা পাজামা আর ফিকে বেগুনী রঙের ফিনফিনে একটা খাদির পাঞ্জাবি পরেছেন পিনাকী। বহুদিন পর কোচবিহারে ফিরছেন, মনটা স্বভাবতই একটু হালকা পলকা তাঁর।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকালেন পিনাকী। ঝকমক করছে রোদ। শ্রাবণ মাসের আকাশ যে এত নীল হতে পারে সেটা ভাবাই যায় না। দিনকাল বদলে যাচ্ছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রকৃতির ঋতুচক্রটাকেই পালটে দিচ্ছে রাতারাতি। সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল পিনাকীর। শ্রাবণের বর্ষা একবার শুরু হলে আর থাম্বার নামই করত না। পুরনো দিনের কথা ভেবে মনটা একটু বুঝি ভার হল তাঁর।
তিনি যে কোচবিহারে যাবেন তা গতকাল দুপুর পর্যন্ত পিনাকী নিজেই জানতেন না। ডালাস থেকে দেশে এসেছিলেন কোম্পানির কিছু কাজ নিয়ে। বেঙ্গালুরু আর মুম্বইতে তাঁর কোম্পানির ব্যবসা সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ছিল গত সপ্তাহে। সেসব সেরে কলকাতায় এসেছিলেন পরশু দুপুরে। এতকিছুর পর আজ কলকাতাতেও একটা জরুরি বোর্ড মিটিং ছিল তাঁর। সেটা বানচাল হয়ে গেল একজন বোর্ড মেম্বার আচমকা মারা যাওয়ায়। গতকাল বিকেলে খবরটা শুনেছিলেন তিনি। ওদিকে আমেরিকা ফিরে যাবার টিকিট কাটা আরও তিন দিন পর। এই তিন্টে দিনের ছুটি চট করে যখন হাতে এসেই পড়ল, তখনই কোচবিহারে আসাটা ঠিক করে ফেলেছিলেন পিনাকী।
যেহেতু হঠাত করে আসাম বিমানবন্দরের বাইরে কেই পিনাকীর জন্য অপেক্ষা করে নেই। একটা হুটার দেওয়া অ্যাম্বাসাডার ছিল এক মন্ত্রীর জন্য। পথচারীদের চমকে দিয়ে সেটা বেরিয়ে গেল প্রথমে। লালবাতি লাগানো সরকারি গাড়ি ছিল কিছু, সেগুলোও বেপাত্তা হয়ে গেল নিজের নিজের দপ্তরের অফিসারদের নিয়ে। যাঁদের নিজস্ব গাড়ি ছিল, তাঁরাও এক এক করে নিজেদের গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গেলেন।এখন বাইরে লাইনে ভাড়ার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা। দু'-একজন যাত্রী দরদাম করছেন সেইসব ড্রাইভারদের সঙ্গে। পিনাকীর তেমন তাড়াহুড়ো নেই। লক্ষ করলে তাঁর পেছনের সিটে সফর করা সাদা রঙের শার্ট পড়া চাপদাড়ি ভদ্রলোক কোচবিহার যাবার ভাড়া নিয়ে দড় কষাকষি করছেন। ট্যাক্সিচালক চাইছে দু'হাজার টাকা। সেই ভদ্রলোক দেড়া হাজারের বেশি দিতে রাজি নন।
পিনাকী নিজেও কোচবিহার যাবেন। তিনি দু'-পা এগিয়ে গেলেন। সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোককে প্রস্তাব দিয়েছেন শেয়ারে যাবার জন্য। এবার পিনাকী ভাল করে তাকালেন মানুষটার দিকে। পঁয়তাল্লিশ্ এর আশপাশ দিয়ে হবে বয়স। টকটকে ফর্সা রঙ, চোখে একটা বাইফোকাল চশমা। দাড়িতে আর পাট করে আঁচরানো চুলে পাক ধরেছে সামান্য। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা ভদ্রলোকের।
পিনাকীর কথায় ভদ্রলোক বিলক্ষণ রাজি। দু'হাজারের জায়গায় এক হাজারেই ব্যবস্থা হয়ে গেলে আর মন্দ কি !দু'জনেরই লাগেজ বলতে একটা করে ছোট ট্রলিব্যাগ । ড্রাইভার ডিকির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল তাঁদের দুজনের ব্যাগ। এবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে। হিন্দি ফিল্মের গান লাগিয়ে দিয়েছে সাউন্ড সিস্টেমে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে মন্থর গতিতে। পিনাকী পাশের ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকালেন একবার। একসঙ্গে ঘন্টা চারেকের পথ যেতে হবে, চুপচাপ তো আর যাওয়া যায় না! হাল্কা গলায় জিজ্ঞেস করলেন- কি করেন আপনি, চাক্রি না ব্যবসা?
চাপদাড়ি ভদ্রলোক পিনাকীর কথায় উত্তর না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে- কি হিন্দী গান চালাচ্ছ রে ভাই তখন থেকে! কানের তো পোকা নড়িয়ে দিলে তুমি! তোমার স্টকে রবীন্দ্রনাথের গান নেই?
ড্রাইভারের মুখ কাঁচুমাচু, রবীন্দ্রসঙ্গীত তো নেই স্যার। একটা সিডিই ছিল, স্ক্র্যাচ পড়ে খারাপ হয়ে গেছে।
পিনাকীর নিজেরও অসহ্য লাগছিল এই চিতকার করে গাওয়া গানগুলো. এবার পিনাকী ধমক দিলেন ড্রাইভারকে, নেই যখন তখন বন্ধ কর তোমার এই অসহ্য হিন্দি গান। এরপর থেকে দু'চারটে রবীন্দ্রনাথের গানের সিডি কিনে রাখবে। সেগুলো রাখবে গাড়িতে।
ঘাড় নেড়ে ড্রাইভার রিমোট দিয়ে তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিয়েছে গান। মারকাটারি জগঝম্প বন্ধ হওয়াতে বেশ শান্তির পরিবেশ ফিরেছে। এবার অনেকটা আরাম বোধ করলেন দুজন। চাপদাড়ি পিনাকীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আমি আসলে সাংবাদিকতার চাকরি করি।কোচবিহারে আমার বাড়ি। বছরে এক-আধবার করে বাড়ি এসে ঘুরে যাই কিছুদিন। এটা তেমনই আসা। ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, আমার নাম প্রনব দেববক্সী।
তেষ্টা পেয়েছিল জোর,একটা খনিজ জলের বোতল কিনেছিলেন দোকান থেকে। সেটাই পিনাকী গলায় ঢেলে নিলেন একটু। তারপর বোতলটা পাশে সরিয়ে রেখে প্রতিনমস্কার করলেন। তিনি যে ডালাসে আপাতত বসবাস করছেন, এটা তাঁর পুরো পেশাগত কারণে দেশে আসা, এবং সে কারণেই যে তাঁর স্ত্রী পুত্রদের ছেড়ে আসতে হয়েছে সে সব জানিয়ে দিলেন পিনাকী। তারপর বুকপকেট হাত্রে একমুঠো ক্যান্ডি ধরিয়ে দিলেন প্রনবের হাতে। সিগারেট ছাড়ার পর গাদাগুচ্ছের ক্যান্ডি পকেটে রাখাটাই তাঁর অভ্যেস। প্রণব মানুষটিকে বেশ লাগছে তাঁর। দীর্ঘকাল বিদেশে থাকার ফলে স্বজাতীয়দের প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে, বাঙালি দেখলেই তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন। বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেলে আর কিছু চাই না তাঁর। প্রণব একে বাঙালি, তায় মনে হচ্ছে বেশ মিশুকে মানুষ, পিনাকী তাই মহাখুশি।
তার মানে কোচবিহারে আপনি তিনদিনের ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন, প্রণব নরম গলায় বললেন।
পিনাকী এবার আরো একটু ঝেড়ে কাশলেন, আসলে এবার শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথি পড়েছে আগামীকাল। কোচবিহার রাজবাড়িতে আবার ওইদিন ময়নাকাঠ পুজো করে বড়দেবীর পুজোর কাজ শুরু হয়ে যায়। বহু বছর আমি দেশছাড়া। মাঝে এসেছি এক-আধবার, কিন্তু এই বিশেষ সময়টায় আসা হয়নি কখনও। সেই ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় যে বড়দেবীর পুজো দেখেছি, সেটা এখনও মনের ভেতর গেঁথে আছে। কাকতালীয়ভাবে সেই স্মৃতিটাকে টাটকা করবার একটা সুযোগ পেয়েই গেলাম যখন, তখন ভাবলাম, লেটস্ গ্র্যাব দ্য অপরচুনিটি। বড়দেবীর পুজোটা আর একবার দেখে আসি গিয়ে।
প্রণব বললেন, বাহ্, খুব ভালো করেছেন। আমার নিজেরও ওই পুজোটা দেখবার একটা বিশেষ কৌতূহল আছে। আমি নিজে এভতি অল্টারনেট ইয়ার এ সময়টাতে বাড়িতে চলে আসি। বড়দেবীর পুজোটা কভার করি আমার পত্রিকার জন্য। তাতে বাড়ি ঘুরে আসবার একটা সুযোগ জুটে যায়, আবার সেই যাতায়াতের খরচ-টরচ সব আমার কাগজ থেকেই পেয়ে যাই।
পিনাকী হেসে মাথা নাড়লেন, তার মানে রথ দেখা আর কলাবেচা- দুটো উদ্দেশ্যই আপনার সাধন হয় এখানে এলে?
প্রণব হো হো হাসছেন, যা বলেছেন।
পিনাকী বললেন, আমার বেশ মনে আছে, গুঞ্জাবাড়ির কাছে ডাংরাই মন্দিরে বড়দেবীর পুজোটা হত। তা দেখতে কোচবিহারের বাইরে থেকেই লোক আসত।
প্রণব বললেন, ঠিকই বলেছেন, এখনও তাইই হয়, কাল শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথি, কাল সন্ধেবেলা রাজ প্রতিনিধি হিসাবে একজন দুয়ারবক্সি ময়না কাঠ আবাহন করবেন। মন্দির থেকে ঢাক আর সানাই বাজিয়ে পালকিতে চাপিয়ে সেই কাঠকে মদনমোহন বাড়িতে নিয়ে আসবেন সেই দুয়ারবক্সি। মদনমোহন মন্দির চত্বরের একটি ঘরে টানা এক মাস ধরে ঐ কাঠের পুজো হবে।
পিনাকী মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, হাইলি ইন্টারেস্টিং। তারপর?
প্রণব বললেন, এরপর ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে মহাস্নান আর ধর্মপাঠ পুজোর পর সেই কাঠ দেবীবাড়িতে বড়দেবীর মন্দিরে প্রতিস্থাপন করা হবে। তার তিন দিন পর থেকে সেই কাঠে খড় দিয়ে ভোঁতা বেঁধে শুরু হবে বড়দেবীর মূর্তি গড়ার কাজ।
সত্যিই, রাজা নেই, রাজ্যপাট নেই, পিনাকী ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে এই পুজোটা হয়ে আসছে পুরো নিয়ম নিষ্ঠা আর অনুশাসন মেনে, ভাবলে অবাক লাগে, তাই না!
কথা বলতে বলতে গাড়ি তিস্তা ব্রিজের ওপর দিয়ে চলছে। প্রণব হটাত করে ড্রাইভারকে বললেন, ভাই, আমি জানলার কাচটা খুলব। তোমার এ-সিটা একটু বন্ধ করে দাও।
ড্রাইভার এ-সি অফ করবার আগেই জানলার কাচ নামিয়ে প্রণব মুখ বের করে দিয়েছেন বাইরে। শ্বাস নিয়েছেন বুক ভরে। পিনাকী বড় বড় চোখ করে কান্ড দেখছিলেন প্রণবের। বললেন, কি ছেলেমানুষি করছেন? অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে তো !
প্রণব তেরছা চোখে তাকালেন পিনাকীর দিকে, রাখুন আপনার অ্যাক্সিডেন্ট! কত যুগ পর তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছি, আর তিস্তার গায়ের গন্ধ এনবার প্রাণ ভরে নেব না মশাই ! জানেন তো, তিস্তা তোর্ষা জলঢাকা সঙ্কোশ রায়ডাক - প্রত্যেকটা নদীর ঘ্রাণ কিন্তু আলাদা। এটা যে জানে, শুধু সে-ই জানে।
ঠিক ঠিক, এটা তো আমার খেয়াল করা উচিত ছিল, এবার পিনাকী নিজেও তাঁর পাশের জানলার কাঁচটা ত্বরিতগতিতে নামিয়ে ফেলেছেন। তারপর মুখ বাড়িয়ে দিয়েছেন বাইরের দিকে। এক কিলোমিটার লম্বা ব্রিজটা শেষ হবার পর আবার দুজন মাথা ঢুকিয়েছেন গাড়ির ভেতর। দুজনেই হাসছেন শিশুদের মত। ড্রাইভার বড় বড় চোখ কঅরে বয়স্ক দুটি খোকার কান্ড দেখছিল লুকিং গ্লাস দিয়ে। পিনাকী বললেন, এসি-টেসি আর চালাবার দরকার নেই ভাই। গরম লাগে লাগুক। বাকি রাস্তা প্রাণ ভরে আমাদের ডুয়ার্সের ঘ্রাণ নিতে নিতে যাব।
পিনাকী ক্যান্ডির মোড়ক খুলে একটা ক্যান্ডি মুখের ভেতর পরেছেন। জিভ দিয়ে নাড়ছেন আলতো আলতো। তারপর প্রণবের উদ্দেশে চোখ বুঁজেই বললেন, ময়নাকাঠকে দেবী হিসেবে কল্পনা করে কবে থেকে পুজো শুরু হয়, জানা আছে কি আপনার?
প্রণব বললেন, সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বা ষোড়শো শতাব্দীর শুরুতে বড়দেবীর পুজো শুরু করেছিলেন কোচ রাজবংশের স্থপতি মহারাজা বিশ্বসিংহ। কিন্তু মূর্তি গড়ে পুজোর চল শুরু হয় ষোড়শো শতকের মাঝামাঝি, মহারাজা নরনারায়ণের আমলে।
ঠিক, পিনাকী সায় দিলেন। মুন্সি জয়নাথ ঘোষের রাজোপাখ্যান নামে একটা বই আমি পড়েছি। সেখান থেকে জেনেছি যে মহারাজা নরনারায়ণের ভাই তথা সেনাপতি শুক্লধ্বজ একদিন কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে রাজসভায় ঢুকেছিলেন।
শুক্লধ্বজ? মানে চিলা রায় নামে যিনি খ্যাত, তিনিই তো?
ঘাড় নেড়েছেন পিনাকী, সপারিষদ নরনারায়ণ তখন সিংহাসনে বলে ছিলেন। তবে খোলা তলোয়ার হাতে ভাইকে রাজসভায় ঢুকতে দেখে মহারাজ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন ভাইয়ের দিকে। নির্নিমেষ সেই দৃষ্টির সামনে পড়ে চিলা রায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন ঐ সভাস্থলেই।
হুম, শুনেছি গল্পটা, প্রণব বললেন, পরে জ্ঞান ফিরলে চিলা রায় স্বীকার করেছিলেন যে তিনি মহারাজকে হত্যা করবার জন্যই রাজসভায় এসেছিলেন। কিন্তু রজসভায় ঢুকতেই তিনি নাকি দেখেন যে স্বয়ং দেবী ভগবতীর কোলে বসে রয়েছেন রাজা নরনারায়ণ। এই ঘটনার পর মহারাজা তিনদিন তিনরাত ধ্যানস্থ থেকে দেবী মহামায়ার দর্শন পান। তারপরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজ্যে পুজো হবে এবং দেবীর নাম হবে দশভুজা।
পিনাকী বললেন, দেবীর দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে আর বাঁ পা মোষের পিঠে ঠাকবে। অসুরের ডান হাত সিংহের মুখে আর বাঁ হাত বাঘের মুখে ঢোকানো থাকবে। বাঘের সামনে থাকবে জয়া-বিজয়ার মূর্তি। তবে দেবীর দু'পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ থাকবে না।
প্রণব হাসলেন, একদম ঠিক। ওই ময়না কাঠের ওপ্রেই প্রাচীন রীতি মেনে গড়া হবে দেবীমূর্তি। আগে রাজ আমলে জঙ্গল থেকে ময়না কাঠ সংগ্রহ করা হত। এখন গ্রামগঞ্জে ওই কাঠ পাওয়াই যায় না। তাই কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডেড় পক্ষ থেকে আনন্দময়ী ধর্মশালা চত্বরে ওই গাছ লাগান হয়েছে শুনেছি।
সেখান থেকেই কাঠ নিয়ে কাল সকাল দশটায় ডাংরাই মন্দিতে পুজো হবে। পিনাকীর মুখ একটু উজ্জ্বল হল, প্রতিবছরের মত সেই পুজো করবেন রাজ পুরোহিত শ্রী পৃথ্বীরঞ্জন ভট্টাচার্য।
আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি কি তাঁকে চেনেন? প্রণব বিস্মিত হয়ে বললেন।
পিনাকী হাসছেন, চিনি অল্প অল্প। সম্পর্কে তিনি আমার বাবা।
আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই!প্রণব পিনাকীর ঘাড়ে চাপড় মেরেছেন উত্তেজনায়, এতক্ষণ ধরে পাশাপাশি সফর করছি, এই কথাটা আপনি এতক্ষণে বললেন? কোচবিহারে আপনার বাবাকে চেনে না এমন লোক একটিও নেই !
পিনাকী মৃদু মৃদু হাসছেন। প্রণব এবার চকচকে চোখে পিনাকীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এবার তবে আমার অন্য পরিচয়টাও দিয়ে দিই আপনাকে।
পিনাকী ভুরু জড়ো করেছেন। প্রণবের দু'ঠোঁট কান ছুঁইয়ে ফেলল প্রায়, ময়নাকাঠ যিনি আবাহন করবেন, তাঁর নাম প্রবীর দেববক্সী। তিনি আমার আপন জ্যাঠামশাই। কেন এই পুজোর জন্য আমার এতটা টান, সেটা এবার বুঝেছেন নিশ্চয়। কাজেই বুঝতাই পারছেন, বড়দেবীর পুজোর সঙ্গে আমার কানেক্শনটাও নেহাত্ ফেলনা নয়!
সারা আকাশ জুড়ে ভাসছে সাদা সাদা মেঘ। মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছেন সূর্যদেব। আবার বেড়িয়ে আসছেন প্রখর তপনতাপ সঙ্গে করে। জানলা পুরো খোলা, পিনাকীদের গাড়ি ফালাকাটা ছাড়িয়ে শিলতোর্ষা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এক কিলোমিটারের চাইতে কিছু কম দৈর্ঘ ব্রিজটির। আবারও জানলা দিয়ে মুখ বের করে দুজন বুখ ভরে শ্বাস নিলেন। দুজন বয়স্ক মানুষের ভেতর কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল, এবার সহসা জেগে উঠেছে দুটি শিশু। আলাদা আলাদা কারণ, তবু বড়দেবীর পুজোর আয়োজন দুজনকেই টানছে অমোঘ আকর্ষণে। পিনাকী-প্রণব দুজনের বুকের ভেতরাই মাদল বাজছে দ্রিদিম দ্রিদিম শব্দ করে। কোচবিহারের দিকে যত এগোচ্ছেন, ততই উতলা হয়ে পড়ছেন দুজন। দুজনেই তুমুল অধৈর্য এই সামান্য পথ বুঝি ফুরোয় না আর !
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প