ডিটেক্টিভ
১
খেলার মাঠে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসেছিলাম দুজনে। আমি আর পিন্টু। হাতে পায়ে ধুলো, গায়ের গেঞ্জি ঘামে জবজব করছে। তবু এক্ষুনি বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবতে পারছিলাম না দুজনেই। ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ে যাচ্ছে কাল থেকে। গরমের ছুটি মানেই পড়াশুনো নেই। সারাদিন বাড়ি বসে সময় নষ্ট করলে তো আর হবে না - নতুন কিছু খেলা বের করতে হবে। কদিন আগে আবিষ্কারক হওয়ার চেষ্টা এক্কেবারে মাঠে মারা গেছে। আমরা ডাইনোসরের হাড় ভেবে মাটি খুঁড়ে যা খুঁজে পেয়েছিলাম তা আসলে অন্য কিছু। কিন্তু তাতে উৎসাহে ভাটা পড়েনি একটুও। আমরা দুজনেই নিশ্চিত ছিলাম যে একটা কিছু উপায় হবেই। গরমের ছুটি বলে কথা।
পিন্টুই কথা বলে উঠল একসময়, ‘আচ্ছা, আমরা গোয়েন্দা হলে কেমন হয়?’
‘গোয়েন্দা?’ আমি অবাক হয়ে ঘুরে বসলাম।
‘হ্যাঁ, কেন নয়? পৃথিবীর সব দেশেই খুদে গোয়েন্দা আছে। তাদের কীর্তিকলাপের কথা কত জায়গায় লোকের মুখে মুখে ঘোরে।’
‘তাই নাকি? কই আমি তো জানি না-’
‘তুই জানিস না বলেই কি আর হয় না? আর বড় বড় গোয়েন্দাদের এসিটেন্ট ছোটরাই হয়।’
‘আচ্ছা, তা নয় হলাম। কিন্তু তারপর’
‘তারপর আমাদের রহস্যের অনুসন্ধান করতে হবে। বুদ্ধি খাটিয়ে চোর ধরতে হবে।’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, ‘সে কি আমরা পারব?’
পিন্টু বুক ফুলিয়ে বলল, ‘কেন পারব না? নিশ্চয়ই পারব। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমি অনেক গোয়েন্দা গল্প পড়েছি। আমাদের সব সময় চোখকান খোলা রাখতে হবে। চারিদিকে সব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতে হবে। আর একটা ক্লু পেলেই ব্যস - কেল্লাফতে’
‘ক্লু? সেটা আবার কি? ইস্ক্রুপ টিস্ক্রুপ নয় তো?’
‘দূর, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কোন বড় রহস্যের সমাধান এক একটা ছোট্ট সূত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। সাধারন মানুষের তা চোখে পড়েও পড়ে না। কিন্তু আমাদের তার মধ্যে থেকেই অপরাধীকে খুঁজে নিতে হবে।’
যেমন কথা তেমন কাজ। ফুটবল মাঠ ছেড়ে আমরা দুই খুদে গোয়েন্দা বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমি তখনও ঠিক ঠিক বুঝছি না আমরা কোন রহস্যের সমাধান করবো। পিন্টু আমাকে একমনে বুঝিয়ে চলেছে। আমাদের রহস্য খুঁজে নিতে হবে। একবার দু-একটা রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারলেই আর দেখতে হবে না। দিকে দিকে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে। আপাতত ঠিক হল পিন্টুই হবে প্রধান গোয়েন্দা, আর আমি ওর এসিস্টেন্ট। তবে আমাদের কাজ শুরু হয়ে যাবে আজ থেকেই।
বাড়িতে ঢোকার সময় ছোটকাকা ধরে বলল, ‘কিরে গরমের ছুটি পড়ে গেছে বলে কি পড়াশুনো শেষ হয়ে গেল নাকি? আয় তোকে একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দিই-’
আমি ছোটকাকাকে কিছু না বলে চুপিচুপি ঢুকে পড়লাম। পিন্টু বলেছে, গোয়েন্দাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে সব সময়। এসব তো নেহাত ছোটখাট ব্যাপার।
২
হাত পা মুখ ধুয়ে একটু পড়তে বসলাম। না বসলে মা রাগ করবে। বাবাকেও বলে দিতে পারে। আর ওদিকে ইস্কুলে ছুটির কাজও দিয়েছে একগাদা। প্রত্যেক সাবজেক্টের জন্য হোমটাস্কের খাতা খুলে দেখতে শুরু করেছি কি কি দিয়েছে। তাড়াতাড়ি শেষ না করে ফেলতে পারলে ভাল করে গোয়েন্দাগিরি করা যাবে না।
পিন্টু বলে দিয়েছে সবদিকে চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। পড়ার ঘরে আমি একা একা বসে ভাবছিলাম কি লক্ষ্য করা যায়। কোথায় খুঁজে পাওয়া যায় একটা রহস্য। অঙ্কের খাতাটা খুলে রেখেছি বটে, কিন্তু কাজ কিছুই এগোচ্ছে না। এমন সময় পাশের ঘর থেকে মার গলার আওয়াজ পেলাম। মা কাকীমার সঙ্গে কথা বলছে। অন্য সময় হলে শুনতাম না। কিন্তু আজকে বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করল। কোথাও কিছু একটা চুরি হয়েছে মনে হচ্ছে।
পড়া মাথায় উঠল। আমি একলাফে হাজির হলাম মার কাছে। মা আর কাকিমা দুজনেই বসে ছিল সোফাতে। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মা, কি চুরি হয়েছে গো?’
মা চমকে বলল, ‘সে কি তোর পড়া হয়ে গেল?’
‘না হয়নি। আজই তো ছুটি পড়ল। আজকে না পড়লেও হবে। তুমি বলনা, আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল কিনা?’
‘আরে, হ্যাঁ। সেটাই তো বলছিলাম। তবে চোর এসেছিল কালকে রাতে। ঘুমোতে ঘুমোতে মনে হচ্ছিল কেন জানিনা একটু অস্বস্তি লাগছে। তারপর আজ সকালে দেখলাম অত সুন্দর দামী এমব্রয়ডারি করা বেডকভারটা নিয়ে পালিয়েছে। ওটা ছিল আমার ঘরেই সেলাই মেশিনটার ওপরে।’
কাকীমা এতক্ষন চুপ করেছিল। এবার বলে উঠল, ‘সিঁড়ির তলা থেকে তোমার কাকুর নতুন জুতোজোড়াও নিয়ে গেছে।’
আমি আরো খানিক শুনলাম। প্রথমে মনে হল কেবল চাদর আর জুতো? তারপর ভাবলাম শুরুটা না হয় ছোটখাট চুরি দিয়েই হোক। পরে বড় সুজোগ পাওয়া নিশ্চয়ই যাবে। এখনকার মত একটা রহস্য তো পাওয়া গেল। এইসব ভাবতে ভাবতে ছটফট করছিলাম। কিন্তু সেটা তো আর এক্ষুনি বলা যায় না মাকে বা কাকীমাকে। তাই সব শুনেটুনে ঘরে চলে এলাম।
এটা নিয়ে পিন্টুর সাথে এখনই আলোচনায় বসতে পারলে দারুন হত। কিন্তু এত রাতে বাড়ি থেকে বেরোনর উপায় নেই। একটা ফোন করা যেতে পারে ওদের বাড়িতে। কিন্তু ফোনটা তো আবার বাইরের ঘরে। সবাই শুনতে পেয়ে যাবে। পিন্টু বলে দিয়েছে, আমাদের কাজ করতে হবে সবার চোখের আড়ালে। কেউ যেন টেরটি না পায় আমরা চুপি চুপি গোয়েন্দা হয়ে গিয়েছি। আর তার ওপরে ছোটকাকার তো ভরসা নেই। কে জানে হয়তো সবার সামনে কান মুলে দিয়ে বলল, ‘যাও এসব ছিঁচকেমো না করে পড়তে বস।’
খেতে বসেও উসখুশ করছিলাম। বাবা একবার বলল, ‘কি রে কি হয়েছে তোর? শরীর-টরির খারাপ নাকি?’
আমি মাথা নেড়ে অল্প কিছু খেয়ে উঠে পড়লাম। ঠিক করলাম রাতে বিছানায় শুয়েও ঘুমোব না একেবারেই। খালি মনে হচ্ছিল এই যেন কেউ জানালার ফাঁক দিয়ে হাত গলাচ্ছে। উসখুশ করতে করতে একসময় ঘুমিয়েই পড়লাম কখন।
৩
সকালে কোনরকমে জলখাবারটা খেয়েই ছুট দিলাম আমাদের গোপন আস্তানায়। সেটা আর কোথাও নয়, আমাদের পাড়ারই একটা শেষ না হওয়া বাড়িতে। বাড়িটার ছাত ঢালাই হওয়ার পর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। কে জানে আবার কবে শুরু হবে। তবে যতদিন না হয় ততদিনই মঙ্গল। আমাদের এই আস্তানাটা খুব একটা জানাজানি হয়নি। গিয়ে দেখি পিন্টু ইতিমধ্যেই এসে হাজির হয়েছে। শুধু তাই ই না, একটা ছোট্ট নোটবুক নিয়ে কিসব যেন লেখালিখি করছে।
‘কিরে তুই কখন এলি?’
‘বেশ কিছুক্ষন। গোয়েন্দাদের ধৈর্য না ধরলে কিছু না।’
‘আরে শোননা, আমার কাছে একটা দারুন খবর আছে। আমি একটা রহস্য খুঁজে পেয়েছি জানিস।’
‘হুমম, ধীরে সুস্থে গুছিয়ে বল।’
‘আমাদের বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে। এর আগে কখনো আমাদের বাড়িতে চোর আসেনি’
‘হড়বড় করিসনি। কি চুরি হয়েছে?’
‘একটা নতুন বেডকভার আর ছোটকাকার একজোড়া জুতো।’
‘হুমম, বুঝেছি-’
‘কি বুঝলি রে?’
‘এটা পুরনো খবর’
‘পুরনো খবর মানে? বললেই হল?’ আমি একটু জেদ করে বললাম, ‘একশবার নতুন খবর। চুরিটা হয়েছে পরশু রাত্তিরে। মা আমাকে কালকে রাত্তিরে বলেছে।’
‘আরে তা বলি নি। তোদের বাড়িতে চুরি হয়েছ নতুন। কিন্তু পাড়ায় সব বাড়িতেই কিছু না কিছু চুরি হচ্ছে কয়েকদিন থেকে। বড় কিছু নয়, সবই ছোটখাট জিনিস। তাই কেউ পুলিশের কাছেও যেতে পারছে না।’
‘সে তুই কি করে জানলি?’
পিন্টু একটু মুচকি হাসি হেসে বলল, ‘সে অনেক কথা। গোয়েন্দা তো আর বললেই কেউ হয়ে যায় না। চারদিকে খোঁজ খবর রাখতে হয় কি হচ্ছে, কি না হচ্ছে। বুঝলি?’
আমি অবাক হলাম, ‘ও তাহলে এখন উপায়? তুই কি কিছু ভেবেছিস নাকি কি করবি?’
‘পাড়ার সবাই খুব সতর্ক হয়ে গেছে। ঠিক করছে রাতে কয়েকদিন পাহারাও দিতে পারে।’
‘সে তো বড়রা দেবে। আমাদের কি আর সেখানে নেবে?’
‘না, তা নেবে না। আমাদের নিজের মত করে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। দেখতে হবে কার ওপর সন্দেহটা বেশি হয়?’
‘ধুর, চোরকে কি আমরা চিনি নাকি যে সন্দেহ করব?’
পিন্টু এবার একটু বিরক্তই হল। ‘উফফ, তোকে যে আর কি কি শেখাব ভেবে পাচ্ছি না। মন দিয়ে শোন – গোয়েন্দাগিরির নিয়ম হচ্ছে সন্দেহ করতে হবে সকলকেই। কাউকে বাদ দিলে চলবে না। অনেক ছোটখাট ঘটনার মধ্যেই ক্লুটা লুকিয়ে থাকতে পারে।’
আমার ব্যাপারটা ঠিক মনে ধরল না। তাও পিন্টু রাগ করতে পারে ভেবে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
৪
আমাদের বিকেলের ফুটবল খেলা মাটি হল।
আজ দুপুরেই আমাদের সামনের বাড়িটা থেকে একটা সাইকেল চুরি গেছে। এরকম অবস্থায় আমাদের তো আর বসে থাকা চলে না। আমরা আবার রওনা দিলাম আমাদের আস্তানার দিকে। পিন্টুটা দেখি কানের কোনে একটা পেন্সিল গুঁজে রেখেছে। কেন কে জানে, হয়তো মাঝে মাঝে ওর ছোট্ট নোটবইতে কিছু লিখবে বলে। কিন্তু এই মুহুর্তে ওকে ছুতোর মিস্তিরির মত দেখাচ্ছে ঠিক। আমি ওর পদ্ধতির সাথে ঠিক একমত হতে পারছি না। কিন্তু একা একাও কিছু করতে পারব না ভেবে চুপচাপ দেখে যাচ্ছি।
ও আমাদের আস্তানায় পৌঁছেও কিছু করল না। চুপচাপ একটা জানলার বক্সে সিমেন্টের স্ল্যাবটার ওপরে উঠে বসে বলল, ‘আমাকে আরকটু ভাবতে দে।’
আমি পায়চারি করতে করতে ভাবছিলাম যে চুরি করছে সে কি আর আমাদের পাড়ার কোন লোক হবে? তাহলে তো সে আগেও চুরি করত বা এতদিনে ধরা পড়ে যেত। আর যে চুরি করে তাকে চুরি করা জিনিস কোথাও তো নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখতে হয়। হয়তো নিজেকেও কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকতে হতে পারে। এমন সময় ধড়মড় করে একটা আওয়াজ পেলাম। চমকে ওঠার সাথে সাথে কেন জানি না খুব ভয়ও পেয়ে গেলাম। এই সব মুহুর্তে পিন্টুকে আমার খুব দরকার। ও খাতা নামিয়ে রেখে বলল, ‘টুবলু, ভয় পাসনি। নে হাত ধর।’ এইভাবে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বাড়িটার পিছনের দিকে। এখানে আমরা বড় একটা আসি না। সিঁড়ির তলায় একটু অন্ধকার ঘুপচি মত, আর তার ওপাশে সেপটিক ট্যাঙ্ক। আমরা একটু করে এগিয়ে দেখলাম একটা লোক, জড়সড় হয়ে।
পিন্টুই সাহস করে বলল, ‘কে তুমি? এখানে কি করছ?’
লোকটা খনখন করে মাথা নীচু করে বলল, ‘আমি চোর বাবু। আমি একটু ঘুমিয়েছিলাম এইখেনে। তোমাদের গলার শব্দে জেগে গিয়ে পালাচ্ছিলাম-’
পিন্টুর সাথে থেকে আমারও সাহসে বুক ফুলে উঠছিল। তাছাড়া লোকটা আমাদের মত দুজন ক্ষুদে গোয়েন্দাকে দেখে ভয় পাচ্ছে দেখে আরো যেন সাহস বেড়ে উঠল। বললাম, ‘পালানো বের করছি তোমার। তোমাকে আমরা পুলিশে দেব।’
লোকটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বাবু, তোমরা কাউকে বলে দিওনি। ওরা আমাকে পুলিশে দিবেনি। পিটাইয়ে মেরে ফেলবে-’
পিন্টু বলল, ‘এত ভয় তো চুরি কর কেন?’
‘পেটের দায়ে বাবু। ফ্যাকটিরিতে কাজ করতাম আগে। সে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তারপর ছিলাম এক সেলাইয়ের দোকানে। হপ্তাখানিক আগে সেখান থেকেও তাড়ায়ে দিল-’
‘তাই বলে চুরি করবে?’
‘আর করবুনি বাবু। চুরি আমি কোনদিন করিনি। কি নিয়েচিই বল তোমরা বাবু। এর বাড়ি থেকে চাদর, ওর বাড়ি থেকে বাসন।’
‘কেন আর আজকের সাইকেলটা?’
‘ও সাইকেল নিয়ে পালাচ্ছিলাম তখন একটা কুকুর তাড়া করল বলে পুকুরের পাশে কচুবনে ফেলে এইচি। চুরির জিনিস কি করব তাই ই জানিনে বাবু। দু একটা জিনিস এই বাড়ি পড়ে রইচে। চুরি আর করবুনি। কিন্তু তুমি ধরিয়ে দিলে ওরা খুব মারবে আমায়-’
৫
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হল আমার। কালকে প্রথম বাড়িতে না বলে আমরা এত বড় একটা কাজ করেছি। কিন্তু কালকে চোরটার কথা শুনে খুব মায়া লাগছিল।
ওকে পুলিশে দেব কি? ওই চেহারায় কি আর মার খাওয়ার জন্য আর কিছু বাকী আছে? আমি আর পিন্টু একবার চোখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলাম। আগেও দেখেছি আমাদের যতই ঝগড়া বা কথা কাটাকাটি হোক না কেন, দরকারের সময় আমরা খুব সহজেই একজন আরেকজনের মনের কথা খুব বুঝে নিতে পারি। ঠিক করলাম লোকটা যখন বলছেই চুরি আর করবে না তখন মনে হল ওর পালানর ব্যবস্থা করতে হবে আর এই ঘটনাটা বড়দের কাউকে জানান হবে না।
তবে তার আগে কিছু খাবার জোগাড় করতে হবে। ও নাকি দুওদিন কিছু খায়নি। তবে বেশিক্ষন সময় আমাদের লাগল না। বাদামভাজা ছিল আমার পকেটে। পিন্টুদের বাড়িটাও কাছেই। ও নিয়ে এল খাওয়ার জল আর একটু চকলেট। সেইসঙ্গে আমাদের জমান টাকার ফান্ড থেকে লোকটাকে কুড়িটা টাকা দিয়ে বলল, ‘অনেক চুরি করেছ। এইবেলা চুপি চুপি বিদেয় হও।’
আর আমি বললাম, ‘এক মিনিট। চুরির জিনিসগুলো এখানেই রেখে যাও।’
বিছানায় শুয়েই শুনতে পেলাম বেশ হইচই হচ্ছে বাড়িতে। হওয়ারই কথা। আমাদের কাজের পিসি বাড়ির পাঁচিলের পাশে খুঁজে পেয়েছে মার বেডকভার আর কাকার জুতোটাও। অন্যান্য হারান জিনিসও এক এক করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে এখান ওখান থেকে। সাইকেলটা তো আমরা উদ্ধার করেছিলাম কালকেই।
ঘুম ভেঙে গেলেও আমার উঠতে ইচ্ছে করল না। পৃথিবীর সেরা ডিটেকটিভদেরও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। শুয়ে শুয়ে দেখলাম জানলার ফাঁক দিয়ে রোদের ঝিকিমিকি এসে পড়ছে জানলার কোনে। বড় সুন্দর এই সকালটা।
অভ্র পাল
কারডিফ, ওয়েলস্, যুক্ত রাজ্য
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অভ্র পাল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ভূতুড়ে উপাখ্যান
ভুতো আর নমি দুই ভাইবোন। ভুতো বড় নমির থেকে, দু মিনিটের। নমি তাই অন্ধের মতো ভুতোর সব কথা বিশ্বাস করে। ভুতো খেলাধুলোর যা যা উপায় বাতলায় নমি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। শুধু সন্ধেবেলা নমিকে দোতলায় যেতে বললে কিছুতেই নমি যেতে পারেনা।
একটা সময় ছিল যখন নমিকে হাত ধরে ভুতো পাড় করে দিত ল্যাণ্ডিংটা। পুরোটাই নমি চোখ বন্ধ করে পার হতো। আর দেখতে পেত গাঢ় অন্ধকারে সাদা সাদা গোল গোল বলের মতো চোখ সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো মুখ নেই চোখের চারপাশে; কিন্তু শনের নুটির মতো সাদা চুল আছে, চোখের পিছনে একটু দূরে।
পরের দিকে আলো জ্বালা থাকলে ল্যাণ্ডিং-এ, নমি পার হতো জায়গাটা একছুটে। তবে সিঁড়ির নিচে আম্মা আর দোতলায় সিঁড়ির মুখে দাদাই দাঁড়িয়ে থাকলে তবেই নমি সাহস করে পার হতো ল্যাণ্ডিংটা। তারপর একদিন লক্ষী পিসি মন্ত্র শিখিয়ে দিয়ে ছিল, “ভুত আমার পুত/ পেত্নি আমার ঝি/ রামলক্ষণ বুকে আছে/ ভয়টা আমার কী?” তারপর থেকে মন্ত্র জপে পার হতো নমি জায়গাটা। কিন্তু তা স্বত্বেও নমি বেশ দেখতে পেত সাদা আঙুলগুলো কাতুকুতুর ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু বোধহয় ও মন্ত্র জপে বলেই ভুতের আঙুল ওর গায়ে আঁচড়টি লাগাতে পারে না। কিন্তু একদিন চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপতে জপতে জায়গাটা পেরোনোর সময় ও শুনেছিল অট্টহাসির শব্দ। তার সঙ্গে দেখতেও পেয়েছিল হাওয়ায় ভাসতে থাকা দাঁতের পাটিজোড়া। বেচারা সেই থেকে সন্ধেবেলা আর দোতলায় যেতেই পারে না।
এদিকে একতলায় মা-বাবা, আম্মার চোখের সামনে যা খুশি তাই পরীক্ষা করা যায় না। কিন্তু পরীক্ষা করুক আর নতুন খেলা খেলুক, ভুতোর একটা শাগরেদ কিংবা খেলার সাথী লাগে। নমি দোতলায় না যাওয়ায় ভুতোর সন্ধেটাই মাঠে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
তবে আজকাল আর ওদের অত অসুবিধে হচ্ছে না। টিভিতে গত তিনমাস ধরে ভুত-ভুতুম অনুষ্ঠান চলছে। রোজ রাত নটায়। এরমধ্যে পৃথিবীর নানাদেশের ভুতুড়ে-অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা নিয়ে ওরা অনেকগুলো ছোট ছোট নাটক দেখে ফেলেছে। তারপর এলেন বটকৃষ্ট মাইতি নামে একজন বিশিষ্ট ভুতবাদী। সেই অনুষ্ঠানেই তাঁর বিপক্ষে তথ্য-যুক্তি দিয়ে ভুত নেই প্রমাণ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন ভুতবিরোধী আন্দোলনের নেতা যুধাজিৎ দত্ত। এইসব যুক্তি তর্ক শুনে ভুতো নমির সাথে খুব ঝগড়া করল এই নিয়ে যে ভুত বলে আসলে কিছু হয় না। নমি কিন্তু জবাবে কেবলই বলেছে যে ও ভুত দেখেছে তাই বিশ্বাস করে যে ভুত আছে। ভুতোও ছাড়বে না। সে সমানে বলে চলেছে ভুতকে দেখাই যায় না।
দুজনের চেঁচামিচিতে অস্থির হয়ে মা বললেন যে কোন ভুত বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বললেই হবে। তারপর বেশ কয়েকদিন ভুত বিশেষজ্ঞ কে কোথায় থাকেন তার খবর যোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুজনে। শেষ অবধি মা-ই উপায় করে দিলেন। ভুত-ভুতুমের ফোন-ইনে প্রশ্ন করে জেনে নিতে যে ভাইবোনের মধ্যে কে ঠিক বলছে।
ফোন-ইন অনুষ্ঠানে এলেন ভুতবাদী ঘন্টেশ্বর ঘড়ুই। আবার তাঁর মোকাবিলা করতে ভুতবিরোধী মন্টু মাকড়। সন্ধে থেকে বেদম চেষ্টার পর যা হোক লাইন পাওয়া গেল। ভুতো হাঁসফাঁস করে জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা কাকু সত্যি কি ভুত আছে?” মন্টু মাকড় আগে উত্তর দিলেন, “না নেই”। শুনেই নমি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “কিন্তু আমি যে দেখেছি!” তখন ঘন্টেশ্বর ঘড়ুই বললেন “কোথায় দেখেছ তুমি ভুত?” উত্তরটা কেড়ে নিয়ে ভুতো তড়বড় করে বলল, “ ও নাকি সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং-এ ভুত দেখে রোজ, কিন্তু ঐ জায়গাটা ও চোখ বন্ধ করে পেরোয় যে, তাহলে ও কী করে ভুত দেখেবে?” এটা শুনে নমির ঠোঁট আরও ফুলে উঠল। কিন্তু ঘড়ুই আর মাকড় দুজনেই খানিক ভেবে নিয়ে বললেন যে ভুতো নমিকে নিয়ে যেন দুপুর বেলা সেই সব জায়গায় যায় যেসব জায়গায় সাধারণতঃ ভুতের বাসা হয়। কারণ কথায় বলে “ঠিক দুক্কুর বেলা/ ভুতে মারে ঢ্যালা”। তাহলে ভুতের বাসায় দুপুরবেলা উঁকি মারতে গেলে ভুত নিশ্চয়ই খুশি হবে না এবং ঢ্যালা মেরে তাড়াবে ভাইবোনকে। সুতরাং ঢ্যালা খেলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে যে ভুত আছে।
কথামতো দুপুরে বনে যাওয়ার জন্য দুভাইবোনই অপেক্ষায় রইল গরমের ছুটির। যেই ছুটি পড়ল অমনি দুজনে গেল পিসিমণির গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে। সেখানে হারাবার ভয় নেই, গাড়ি চাপা পড়ার ভয় কম, ছেলে ধরার ভয় নেই, সিঁড়ির ল্যাণ্ডিং নেই, তাই ভুতের ভয়ও নেই। তাই সারাদিন যা খুশি করার মানাও নেই।
সেখানে পর পর কয়েকটা দুপুর দুজনে তালতলা, বেলতলা, শ্যাওড়াওতলা, ফলসা বনে এন্তার ঘুরে বেড়াল। খুব হট্টগোল করল। কিন্তু ভুতে কেন কেউই ওদের ঢ্যালা মারল না। ভুতো খুশি হলো। নমিও খুশি হলো। ভুতো খুশি হলো ভুত নেই প্রমাণ হয়ে গেল বলে; নমি খুশি হলো ভয়ানক ভুতের সাথে দেখা হলো না বলে; দেখা হলে তো পিসিমণির বাড়িতে ছুটির আনন্দটাই মাটি হয়ে যেত। কিন্তু ভুতোকে ভুত দেখাতে না পারার একটা মন কেমন ঘিরে রইল নমিকে বাড়ি ফেরা অবধি।
বাড়ি ফিরল ওরা একদিন সন্ধের মুখে মুখে। তখন সবে সিড়িঁর ল্যাণ্ডিং-এ থোপা থোপা ছাই রঙে অন্ধকার জমা হচ্ছে একটু একটু করে। দৌড়ে নমি পৌঁছে গেল সেখানটায়। চোখ বন্ধ করে দেখতে পেল হাওয়ায় ভাসছে গোল বলের মতো চোখেরা, শন নুটির মতো চুলেরা, মাড়িসুদ্ধ দাঁতের পাটিরা আর কিলবিলিয়ে আসছে আঙুলরা। ভয়ে, খুশিতে, চীৎকার করে উঠল নমি, “এই তো আছে সব এখানেই!”
ছাতিম ঢ্যাং
- বিস্তারিত
- লিখেছেন ছাতিম ঢ্যাং
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প