লোহারা
হিমাচল প্রদেশের এক ছোট্ট গ্রাম লোহারা। এই গ্রামের বাসিন্দারা কুলু শাল তৈরির জন্য বিখ্যাত । আমি সেইসব শিল্পীদের সঙ্গে ডিজাইন এবং রঙের ব্যবহার নিয়ে নতুন কাজ করার জন্য সাত দিনের ওয়ার্কশপ করতে গিয়েছিলাম লোহারাতে।
এই গ্রামটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। লোক কথায় বলে, মান্ডির রাজা চিত্রসেন তাঁর ভাইকে এইখানে যুদ্ধে হারিয়েছিলেন। চিত্রসেন আদতে ছিলেন বাংলার সেন বংশের রাজা। বাংলাদেশ যখন মুসলিম নবাবদের হাতে চলে যায়, তখন চিত্রসেন উত্তর ভারতের দিকে চলে যান। চিত্রসেন ছিলেন ফর্সা, কিন্তু তাঁর ভাইয়ের গায়ের রঙ ছিল কালো। চিত্রসেন মাঝে মাঝেই তাঁর ভাইকে "কয়লা" বলে ক্ষেপাতেন। শেষে একদিন চিত্রসেনের ভাই রেগে গিয়ে তাঁকে সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করলেন। যুদ্ধের জায়গা স্থির হল এই ছোট্ট গ্রামটি। রাজা আর তাঁর ভাইয়ের সাথে তাঁদের নিজের নিজের সৈন্যবাহিনীও এলো।যুদ্ধের শেষে ভাইকে হারিয়ে যখন চিত্রসেন তার মুন্ডচ্ছেদ করতে উদ্যত হলেন, তখন, তাঁর ভাই বললেন -"লো হারা" ( নাও, হার স্বীকার করলাম )। এই কথা শোনার পর চিত্রসেন আর তাঁকে মারলেন না।
সেই থেকে এই জায়গার পুরানো নাম মুখে মুখে বদলে হয়ে গেল লোহারা। মানুষ গ্রামটার পুরানো নাম ভুলে গেল।
চিত্রসেন বহুবছর মান্ডিতে রাজত্ব করেছিলেন। তিনি নানারকম শিল্পকর্মে উতসাহ দিতেন। তিনি উত্তর ভারতে একজন জনপ্রিয় বাঙালি রাজা ছিলেন।
এই লেখার সঙ্গে লোহারা গ্রামের শেষনাগের মন্দিরের একটা ছবি এঁকে দিলাম।
রেবন্ত গোস্বামী
অধ্যাপক
গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট অ্যাণ্ড ক্রাফট, কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন সৃজন বিভাগ
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা
আলি, কোকো আর আমরা
একটা দশ-এগারো বছরের ছোট ছেলে। নাম তার আলি। কাঁধে তার এক বিশাল বস্তা, ওজন প্রায় ছয়-সাত কিলো। ওজনের ভারে নুইয়ে পড়েছে সে। তার মাথার কোঁকরানো কালো চুলের ভিতর দিয়ে নোনা ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার রোদ্দুরে ঝলসে যাওয়া মুখের ওপর। পা ফুলে গেছে হাঁটতে হাঁটতে, গায়ের এখানে-সেখানে কেটে ছড়ে গেছে। দু-দন্ড বসে যে জুড়িয়ে নেবে তার উপায় নেই। দেরি হলেই বিপত্তি - জুটতে পারে বকুনি আর চাবুকের মার। সকাল থেকে সাত ঘন্টা খাটুনি হয়ে গেছে, কিন্তু কাজ করতে হবে অন্ততঃ আরো সাত ঘন্টা । সারাদিনে খাওয়া বলতে মাত্র একটা কলা। আর দিনের শেষে তার মত আরো ছেলেদের সাথে গাদাগাদি করে একটা ছোট্ট ঘরে শুতে যাওয়া। সেই ঘর আবার বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে।
প্রয়োজন হলেও সেই ঘর থেকে কেউ বেরোতে পারবে না...
ভাবছো- এ কার গল্প শোনাতে বসেছি তোমাকে? এত কষ্ট কেন এই ছেলেটার? ওর কি বাবা মা নেই? ও কোথায় কাজ করছে? ওর পিঠের ভারি বস্তায় কি আছে? এ কোন দেশের গল্প?
দেশটার নাম আইভরি কোস্ট। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের একটা ছোট্ট দেশ। যে দেশে হামেশাই নানা ধরনের যুদ্ধ বিবাদ লেগে থাকে। আইভরি কোস্টের অর্থনীতি কৃষিপ্রধান। কফি, পাম তেল আর কোকো হল এই দেশের প্রধান ফসল। আইভরি কোস্ট হল পৃথিবীর সবথেকে বড় কোকো উতপাদন ও রপ্তানিকারক দেশ। আশেপাশের অন্যান্য কয়েকটি দেশ - ঘানা, ক্যামেরুন ও নাইজেরিয়ার সাথে মিলে বিশ্বের প্রয়োজনীয় ৭০% কোকো বীন উতপাদন করে।
কোকো গাছ
কোকো দিয়ে কি তৈরি হয়? - এর উত্তর সবাই জানে ! - চকোলেট!! ওঃ ভেবেই মুখে জল চলে আসছে, মন খুশি খুশি হয়ে আসছে, তাই না? চকোলেট বা চকোলেট স্বাদের অন্য যেকোন খাবার পছন্দ করে না, এমন মানুষ আমাদের চারিপাশে খুঁজলে মনে হয় পাওয়া যাবেনা। ওই যে প্রথমে আলির কথা বললাম, যে কিনা কাঁধে এক বিশাল বোঝা নিয়ে দিনে চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করে, সে আইভরি কোস্টের এক কোকো খামারে কাজ করে। সে ওই খামারের মালিকের কৃতদাস। আর ওর পিঠের ভারি বস্তা ভর্তি হয়েছে গাছ থেকে তোলা কোকো বীনে। যে কোকো দিয়ে তৈরি হয় চকোলেট। যে চকোলেট আলি জীবনে কোনদিন খেয়েই দেখেনি, জানেইনা তার মনভোলানো স্বাদের খবর...
কৃতদাস!! যাঃ! তা আবার হয় নাকি? আজকের দিনে? সে তো সেই কবে 'আঙ্কল টম'স্ কেবিনের' সাথেই শেষ হয়ে গেছে বলেই জানি। আমরা তো তাই ভাবি, আর তাই বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যি কথা কি জানো, আজকের পৃথিবীতে কিন্তু ক্রীতদাস বা স্লেভস্দের সঙ্খ্যা অনেক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশন (ILO) আমাদের জানাচ্ছে যে প্রায় ১০,০০,০০০ জন শিশু, যাদের বয়স পাঁচ থেকে চৌদ্দ বছরের মধ্যে, তারা আইভোরি কোস্টের বিভিন্ন ছোট বড় কোকো খামারে কাজ করে। তাদের বেশিরভাগকেই জোর করে ধরে বেঁধে কাজ করানো হয় এবং অনেকটাই বিনা পারিশ্রমিকে, বা খুব কম টাকার বিনিময়ে। এই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা নানা জটিল যন্ত্রপাতি দিয়ে খামারের কাজ করে, কোন রকম প্রতিরোধ ছাড়াই গাছের গায়ে ছড়ায় নানারকম বিষাক্ত কীটনাশক, যা অনেক সময় তাদেরই ক্ষতি করে। কাজে ক্লান্তি দেখলেই তাদের ওপর চলে অসহ্য অত্যাচার।
কোকো বাগানে কাজ করছে শিশু শ্রমিকরা
এইসব ছোট ছোট শিশুদের পাচার করে আনা হয় আশেপাশের আরো গরিব দেশগুলি - যেমন মালি, বারকিনা-ফাসো- এইসব জায়গা থেকে। খাবার, আশ্রয় আর টাকার লোভ দেখিয়ে মানুষপাচারকারিরা এদের নিয়ে আসে আইভরি কোস্টে, এবং বিক্রি করে দেয় খামার মালিকদের কাছে। কোন কোন ছেলে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায়। বেশিরভাগই পালাতে পারেনা। যদি বা তারা পালাতে পারে, বা তাদের উদ্ধার করা হয়, তারপরেও তারা সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে না। খামারে অমানুষিক অত্যাচারের ফলে আর টানা পরিশ্রম করে করে তাদের মনোবল ভেঙ্গে যায়, আত্মবিশ্বাস একদম নষ্ট হয়ে যায়, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই পারে না।
কিন্তু এই অন্যায় প্রথা আজকের পৃথিবীতে একটা দেশে বা অঞ্চলে চলতে পারে কি করে? ভাবছ নিশ্চয়...। আসলে আগেই বলেছি, আইভোরি কোস্ট খুব উন্নত দেশ নয়। এই দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ আন্তর্জাতিক দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।তার মধ্যে সেখানে নানারকম গৃহবিবাদ লেগেই থাকে। এখানে যারা কোকো চাষ করে, তারে কেউই খুব ধনী বা অনেক জমির মালিক নয়। তারা বেশিরভাগই ছোট এবং মাঝারি মাপের কৃষক। কোকো উতপাদন করার জন্য তারা অনেকটাই নির্ভর করে প্রকৃতির ওপর। মাঝে মাঝে পোকা লেগে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। তারা সহজে অর্থ-সাহায্য ও পায়না। তার ওপরে তাদের উতপাদন করা পন্যের সঠিক দাম তারা পায়না। তাই তাদের কাছে খরচা কমানোর সবথেকে সহজ উপায় হল চাষের পেছনে খরচা কমানো। তাই তারা আরো বেশি করে ছোট শিশুদের কাজে নেয়। আলির মত এইসব অসহায় শিশুরা প্রতিবাদ করতে পারেনা, শুধু মুখ বুজে খেটেই চলে। এইখানে একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন। এইরকম অন্যায় শিশু-শ্রম শুধুমাত্র আইভোরি কোস্টেই চলে না, পশ্চিম আফ্রিকার একগুচ্ছ ছোট-বড় দেশে চলে। বেনিন, বারকিনা-ফাসো, ক্যামেরুন, টোগো,গাবোন, ঘানা, মালি, নাইজেরিয়া-সমস্ত দেশেই কম বেশি শিশু পাচার ও শিশু-শ্রম নিয়মিত ভাবে চলে।
সারা বিশ্বের অনেক মানুষই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে সরব হয়েছেন। তৈরি হয়েছে ফেয়ারট্রেড (FAIRTRADE), অর্থাৎ কিনা যে সংস্থা পরিচ্ছন্ন উপায়ে, সঠিক দামে কৃষকদের থেকে সরাসরি তাদের ফসল কেনাবেচার দিকে লক্ষ রাখবে।
যে কৃষকরা শিশু শ্রমিক ব্যবহার করেন না, ফেয়ারট্রেড দায়িত্ব নিয়েছে তাদের উতপাদন যথাযোগ্য দামে বিক্রি করে দেওয়ার। কিন্তু যারা বিশ্বের সবথেকে বড় চকোলেট উতপাদনকারি সংস্থা, যেমন ক্যাডবারি, হার্শে, নেস্লে বা লিন্ডট, তারা কি করছে? তারা কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখনও অবধি ফেয়ারট্রেডের মাধ্যমে কোকো কিনতে উতসাহী নয়। ইন্টারন্যাশনাল কোকো অর্গানাইজেশন জানাচ্ছে, যে সারা বিশ্বের মোট কোকো উতপাদনের মাত্র ০.১% বিক্রি হয় ফেয়ারট্রেডের মাধ্যমে। অর্থাৎ, পরোক্ষ ভাবে, এইসব সংস্থা গুলি কিন্তু এই শিশু-শ্রম ব্যবহারে মদত দিচ্ছে।
অবশ্য সবাই এইরকম নয়। অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় সাতটি সংস্থা আছে , যারা এই ধরনের শিশু-ক্রীতদাসদের দিয়ে উতপাদন করানো কোকো ব্যবহার করেনা। ক্যাডবারি তাদের ব্লগে জানাচ্ছে যে তাদের সবথেকে জনপ্রিয় চকোলেট -'ডেয়ারি মিল্ক' -খুব তাড়াতাড়ি পেতে চলেছে 'ফেয়ারট্রেড'-এর লেবেল।
হয়তো এইভাবেই একদিন ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যাবে মানুষ-পাচার, ক্রীতদাস কেনাবেচা আর শিশুশ্রমের মত অপরাধগুলি। কিন্তু সেই দিনটা যাতে খুব তাড়াতাড়ি আসতে পারে, তার জন্য আমরা কি কিছুই করতে পারি না? এরপর যেদিন তুমি তোমার প্রিয় চকোলেট বারে কামড় বসাতে যাবে, তোমার মনে পড়বে না আলির কষ্টের কথা? আলির মত আরো বন্ধুদের অসহনীয় জীবনের কথা? সত্যি করে বলতো, যদি আলিও তোমার চকোলেটে ভাগ বসায়, আর সেই চকোলেট খেতে খেতে তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি, মুছে ফেলে চোখের জল, তাহলে কি তুমিও খুশি হবেনা?
সারা বিশ্বে শিশু-শ্রম আইন করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও, আমাদের আশে-পাশে কি আমরা শিশু-শ্রমিক দেখতে পাইনা? তোমার পাড়ার চায়ের দোকানে কাজ করে যে ছেলেটা, বা পাশের বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটে যে ছোট্ট মেয়েটা, তারাও তো তোমারই বয়সি, তাদেরও ইচ্ছা করে স্কুলে যেতে, খেলা করতে, চকোলেট খেতে...এইরকম হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আমাদের দেশে কাজ করে রাস্তার ধারের ধাবায়, চায়ের দোকানে, ইঁটভাটায় বা চিংড়ির ভেড়ীতে...সারা পৃথিবী জুড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের , নিজেদের স্বার্থে, নানান অন্যায় কাজে ব্যবহার করে কিছু খারাপ, স্বার্থপর মানুষ। তোমার কি মনে হয়না এইসব খারাপ লোকগুলির কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত?
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী, কলকাতা
ছবিঃইন্টারনেট
- বিস্তারিত
- লিখেছেন মহাশ্বেতা রায়
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা