লাস ভেগাস
একদল স্প্যানিশ ব্যবসায়ী চলেছে লস এঞ্জেলেস এর দিকে। সাল ১৮২৯। তাদের লক্ষ - যত তাড়াতাড়ি লস এঞ্জেলেস এ পৌঁছানো যায়। লস এঞ্জেলেস থেকে তারা এখনও ৩০০ মাইল দূরে। দলের নেতা আন্তোনিও। তার দলটা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটানা চলছে। দলের সবাই পরিশ্রান্ত, জল তেষ্টা আর খিদেতে সবাই ক্লান্ত। এভাবে চলতে থাকলে দলের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়বে , এমনকি মারাও যেতে পারে। কিন্তু চারিদিকে যতদূর দেখা যায় ধু-ধু মরুভূমি - শুধু ক্যাক্টাস আর কাঁটা গাছ, রুক্ষ্ম প্রান্তর। দলের বাকিদের সঙ্গে পরামর্শ করে আন্তোনিও ঠিক করলো এখানেই তাঁবু ফেলবে। দলের সাহসীদের দুটো দলে ভাগ করে দিয়ে পাঠালো দুই দিকে জলের সন্ধানে। দলের এক সাহসী সহ-নেতা, রাফায়েল ঠিক করলো সে দক্ষিণ-পশ্চিমে জলের খোঁজে যাবে। সে শুনেছে কাছাকাছি একটা মরুদ্যান আছে- যেখানে জল অফুরন্ত, গাছের পাতা সবুজ- যেখানে কান পাতলে এই রুক্ষ পরিবেশেও শান্তির বাতাস বয়ে যায়।
এর পরের ঘটনায় দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার ব্যবসায়ী ইতিহাস সম্পূর্ণ বদলে গেলো। যে রাস্তা দিয়ে আন্তোনিও যাচ্ছিল, তার নাম স্প্যানিশ ট্রেইল। ব্যবসায়ীরা স্প্যানিশ ট্রেইল ব্যবহার করে নিউ মেক্সিকো থেকে লস এঞ্জেলেস অবধি যেত তাদের পসরা নিয়ে। এই পথ ছিল রুক্ষ্ম মরুভূমি, সুউচ্চ পর্বতমালা এবং গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে।রাফায়েল মরুদ্যান খুঁজে পেল, তার ফলে তারপর থেকে সব ব্যবসায়ীরা এই মরুদ্যানের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত শুরু করলো। স্প্যানিশ ট্রেইলের নতুন রাস্তা হল মরুদ্যানের মধ্য দিয়ে। স্প্যানিশরা এই জায়গাটার নাম দিল 'লা ভেগা' ; যা বাংলা করলে দাঁড়ায় 'তৃণভূমি'। সেই জায়গাটাই আজকের লাস ভেগাস। মরুভূমির দেশে মরুদ্যান।
এর পরের ঘটনায় দক্ষিণ-পশ্চিম আমেরিকার ব্যবসায়ী ইতিহাস সম্পূর্ণ বদলে গেলো। যে রাস্তা দিয়ে আন্তোনিও যাচ্ছিল, তার নাম স্প্যানিশ ট্রেইল। ব্যবসায়ীরা স্প্যানিশ ট্রেইল ব্যবহার করে নিউ মেক্সিকো থেকে লস এঞ্জেলেস অবধি যেত তাদের পসরা নিয়ে। এই পথ ছিল রুক্ষ্ম মরুভূমি, সুউচ্চ পর্বতমালা এবং গভীর গিরিখাতের মধ্য দিয়ে।রাফায়েল মরুদ্যান খুঁজে পেল, তার ফলে তারপর থেকে সব ব্যবসায়ীরা এই মরুদ্যানের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত শুরু করলো। স্প্যানিশ ট্রেইলের নতুন রাস্তা হল মরুদ্যানের মধ্য দিয়ে। স্প্যানিশরা এই জায়গাটার নাম দিল 'লা ভেগা' ; যা বাংলা করলে দাঁড়ায় 'তৃণভূমি'। সেই জায়গাটাই আজকের লাস ভেগাস। মরুভূমির দেশে মরুদ্যান।
স্প্যানিশ ট্রেইল
১৮৩০ সালের সেই মরুদ্যান এর থেকে আজকের লাস ভেগাসের চেহারা সম্পূর্ণ আলাদা। পৌনে দুশো বছরের মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। এক সময়ে এই মরুদ্যান দুষ্ট লোকেদের আড্ডা হয়ে গেছিল। হেন অন্যায় কাজ নেই যা হতোনা। এমন অবস্থা ছিল যে পুলিশরাই ভয়ে ভয়ে ঐখান দিয়ে যেত। আজ লাস ভেগাসের চেহারা বদলে গেছে। স্টেফী গ্রাফ আর আন্দ্রে আগাসির বাড়ী এখানে। আরো অনেক নামি-দামী মানুষ এখানে বাড়ী নিয়ে আছেন।
তবে আমরা নামি-দামীদের কথা বলবো না আজ। আমরা যাব সেইসব জায়গায় যেখানে টুরিস্টরা ঘুরতে যায় বেশি। যুক্ত্ররাষ্ট্রের বিখ্যাত স্থপতিরা লাস ভেগাসে ভিড় জমিয়েছেন, তাঁদের তৈরি হোটেল আর হোটেলের কারুকার্য হাঁ করে দেখতে হয়। সমস্ত নামি-দামি শিল্পীরা এখানে আসেন তাঁদের শিল্পকলা প্রদর্শন করতে। দুই থেকে তিন বর্গমাইলের মধ্যে একটার পর আরেকটা হোটেল। চলো , আমরা হোটেল গুলোর সৌন্দর্য দেখি। এই লেখার সংগে ছবিগুলি আমার স্ত্রী পিউ আর আমার তোলা। পিউএর বাবা- মা, পিউ আর আমি একসঙ্গে বেড়াতে গেছিলাম, নেভাডায় অবস্থিত লাস ভেগাসে।
প্রথমেই দেখাই রাতের লাস ভেগাস শহরের ছবি। চারিদিকে শুধু আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
তবে আমরা নামি-দামীদের কথা বলবো না আজ। আমরা যাব সেইসব জায়গায় যেখানে টুরিস্টরা ঘুরতে যায় বেশি। যুক্ত্ররাষ্ট্রের বিখ্যাত স্থপতিরা লাস ভেগাসে ভিড় জমিয়েছেন, তাঁদের তৈরি হোটেল আর হোটেলের কারুকার্য হাঁ করে দেখতে হয়। সমস্ত নামি-দামি শিল্পীরা এখানে আসেন তাঁদের শিল্পকলা প্রদর্শন করতে। দুই থেকে তিন বর্গমাইলের মধ্যে একটার পর আরেকটা হোটেল। চলো , আমরা হোটেল গুলোর সৌন্দর্য দেখি। এই লেখার সংগে ছবিগুলি আমার স্ত্রী পিউ আর আমার তোলা। পিউএর বাবা- মা, পিউ আর আমি একসঙ্গে বেড়াতে গেছিলাম, নেভাডায় অবস্থিত লাস ভেগাসে।
প্রথমেই দেখাই রাতের লাস ভেগাস শহরের ছবি। চারিদিকে শুধু আলোর বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
আমরা সন্ধেবেলা যখন শহরটায় ঢুকছি, তখন সেই একশো বছর আগের ব্যবসায়ীদের মত আমরাও মরুভূমির মধ্য দিয়ে গেলাম। রাস্তাতে লেখা আছে পরবর্তী আশি মাইল কোন পেট্রল পাম্প নেই, তাই সবাই যেন গাড়ীতে তেল ভরে তবে মরুভূমির মধ্যে গাড়ী চালানো শুরু করে। আমরা ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে চললাম এক ঘন্টারও বেশি। হটাত, একেবারেই হটাত একটা বাঁক নিতেই মনে হল আমাদের চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল। যদিও শহর তখনো দূরে,কিন্তু আলোর ছটা তিরিশ মাইল দূর থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
আমরা প্রথমে গেলাম আমাদের হোটেলের দিকে- হোটেল স্ট্রাটোস্ফিয়ার। ওই যে হোটেলের মাথায় লাল অ্যান্টেনার মত উঠে আছে, ওটা আসলে একটা মজার জায়গা। ওটা একটা রাইড। নাগরদোলার মত চাপতে হয়। চাপলে রাইডটা সোজা ওপরে নিয়ে গিয়ে হটাত করে ছেড়ে দেয় ! ভাবো তুমি শূণ্যে ভাসমান অবস্থায় সোজা নিচের দিকে নামছো !! নিজেকে ভারহীন মনে হয় তখন! সারা শরীর সিরসির করে তখন, কিন্তু খুব মজাও লাগে।
ওখাণে আবার প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের আদলে একটা হোটেল আছে। আরো একটা মজার ব্যাপার হল - ছবিটায় দেখবে ফোয়ারার জল কত উঁচু অবধি উঠে গেছে।
এই জায়গা বেলাজিওর সামনে। ওখানে প্রত্যেক পনেরো মিনিট অন্তর ফোয়ারার খেলা হচ্ছে। গানের তালে তালে জল শূণ্যে লাফিয়ে উঠছে। ভিড় দেখে বুঝতে পারবে কত লোক দেখতে আসে। চারিদিকেধু ক্যামেরার শাটার আর ফ্লাশের ঝলকানি। সন্ধ্যেবেলা থেকে শহরটাকে মনে হবে এক মায়াময় জগত, যেখানে আঁধার নামলেই আলো ঝলমল করে ওঠে। ফোয়ারা গানের তালে তালে তিরিশ তলা অবধি নাচছে। চারিদিকে হাসি-গল্পের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তারপর চোখের সামনে একটা খুব উজ্জ্বল আলোর শিখা উঠে গেলো আকাশ অবধি। সেটা উঠলো একটা হোটেলের মাথা থেকে। এই হোটেলটা দেখতে পিরামিডের মত। নাম লাক্সর হোটেল। এই আলোর জোর এত যে আড়াইশো মাইল দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
আর লাস ভেগাস লেখা নিয়ন আলোটা সবাইকে আমন্ত্রন জানাচ্ছে লাস ভেগাসে আসার জন্য।
এবারে যাই ফ্রিমন্ট স্ট্রীট বলে একটা জায়গা। ফ্রিমন্ট স্ট্রীট হল পুরোনো দিনের লাস ভেগাস। আজও এখানে নিয়মিত শো হয়, অনেক সময় রাস্তায়ও শো হয়।ফ্রিমন্ট হোটেল, গোল্ডেন নাগেট তখনকার দিনের বিখ্যাত হোটেল।
এতক্ষন ঘুরে ক্ষিদে পেয়ে গেলে থামতে হবে চকোলেটের ঝরনার সামনে। সত্যি চকোলেট ঝরনা হয়ে গড়িয়ে আসছে। দেখলেই জিভে জল এসে যাবে।
পরের দিন আমরা দিনের বেলা বাকি হোটেল গুলো ঘুরে দেখলাম।প্রথমেই চোখে পড়বে হারাস- সোনা রঙের জোকাররা যেখানে বিভিন্ন সাজে আছে।
তারপর সীজার'স প্যালেস, যেখানে সব কিছু জুলিয়াস সীজারের প্রাসাদের অনুকরণে তৈরি।
তারপর ট্রেসার আইল্যান্ড এর সামনে জলদস্যুদের খেলা...
হোটেল দ্য মিরাজ -এর সামনে জলের তলা থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাত।
এরপর ইতালির ভেনিস শহরের আদলে তৈরি ভেনেশিয়ান। ভেনিস শহরে যেমন গন্ডোলা করে সবাইকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, এখানেও সেরকম গন্ডোলা ফেরি নিয়ে যায়। গোটা হোটেলটার মধ্যে পরিখা বানানো আছে। ছবি দেখে বলতো, আকাশটা আসল , নাকি নকল?
এই হল আজকের লাস ভেগাস- নিরন্তর আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠার, অবাক হয়ে মানুষের সৃষ্টি দেখার জায়গা- কোনও হোটেলে বড় শিল্পীর কাজের প্রদর্শনী চলছে, কোথাও সাদা বাঘের খেলা চলছে, কোথাও বা গানের তালে তালে ডলফিন জল থেকে লাফিয়ে উঠছে। এইসব দেখে শুনে আমরা ক্লান্ত হয়ে ঘরে এসে শোবার তোড়জোড় শুরু করলাম। পরের দিন বাড়ি ফিরতে হবে যে!
এখন শীত। আমি কাজের সূত্রে আছে নায়গ্রা ফলস্ থেকে মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে। এখানে বরফ পড়া শুরু হয়ে গেছে। শুনেছি এখানে নাকি শীতে খুব ঠাণ্ডা পড়ে। এত ঠাণ্ডার জায়গায় আমি এই প্রথম থাকছি। তোমাকে পরের বারে জানাবো কেমন শীত কাটালাম নায়গ্রার সাথে।
লেখা ও ছবিঃ
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
শিবঠাকুরের আপন দেশে
'জয় বাবা ফেলুনাথ' দেখেছ কি? না দেখে থাকলে শিগগির দেখে ফেল। ফেলুদা, তোপসে, জটায়ুর সাথে ক্যাপ্টেন স্পার্ক মিলে সমাধান করে ফেলে এক জটিল রহস্যের, আর পাকড়াও করে ফেলে দুষ্টু চোরাকারবারি মগনলাল মেঘরাজকে। এই ছবিতে অবশ্য ফেলুদা কোম্পানি ছাড়াও আরেকটা দেখার বিষয় আছে। সত্যি বলতে কি, 'জয় বাবা ফেলুনাথ' জুড়ে অর্ধেকটা যদি হয় ফেলুদা কোম্পানি, তাহলে বাকি অর্ধেক জুড়ে আছে এই গল্পের পটভূমি- বেনারস বা বারানসী। বেনারসের অলি-গলি, ঘাট, বাঙ্গালি হোটেল, গঙ্গা নদী, পুরোনো মহলবাড়ি- সব মিলে মিশে তৈরি করেছে এই জনপ্রিয় থ্রিলারের পটভূমি।
এই বেনারসে বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল গত শীতে। বেনারস সম্বন্ধে আগ্রহ তো আর শুধু 'জয় বাবা ফেলুনাথ' এর কারনে নয়। এই ছবিটি ছাড়াও অন্য অনেক ভালোলাগা ছবি ও গল্পেতে ফিরে এসেছে বেনারস।যেমন অনেকখানি এসেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা 'অপরাজিত' উপন্যাসে। যে গল্প নিয়ে আবার পরে ছবিও তৈরি করেছেন সত্যজিত রায়। সে ছবিতেও প্রথমদিকে বেনারসের অলি-গলি-ঘাটের দৃশ্য অনেক রয়েছে। তাই সেই বেনারস যাওয়ার সুযোগ পেয়ে বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠলাম আর ক্যামেরা, আই-পড, সোয়েটার, চাদর ব্যাগে পুরে একদিন সন্ধ্যায় বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে রওনা দিলাম ট্রেনে চেপে।
জানো তো, বারানসী বা বেনারস হল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন নগরী, যেখানে গত সাড়ে তিন হাজার বছরের মত সময় ধরে মানুষ বিরামহীন ভাবে বসবাস করে চলেছে (continually inhabited city)। প্রাচীনকালে এই নগরের নাম ছিল কাশী। কাশী শব্দের মানে হল -"আলোকিত স্থান"। প্রাচীণকালে কাশী ছিল শিক্ষা, ধর্ম, জ্ঞানের পীঠস্থান। গঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত এই নগরের দুই পাশে রয়েছে বরুণা ও অসি নদী। অনেকের মতে, এই বরুণা ও অসি মিলিয়েই এই নগরের নাম হয়েছে বারানসী। ভারতীয় ইতিহাসের আদি যুগে, কাশী ছিল ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। শুধুমাত্র হিন্দু নয়, বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও কাশী এক গুরুত্বপূর্ন পীঠস্থান।
ঘাটের আটকোনা চাতালে বসে কারা? তোপসে আর লালমোহন বাবু নাকি?
এইসব পড়াশোনা করে খুব আনন্দে সকাল বেলা ট্রেনের জানালা খুলে বসেই হটাত দেখতে পেলাম সেই ছবি - রেলের পুলের নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী, আর তার পশ্চিম পাড় বরাবর দাঁড়িয়ে সেই প্রাচীণ নগর- মন্দির, মহল আর একের পর এক ছোট-বড় ঘাট।
বারানসী রেল স্টেশন থেকে নদীর ঘাট এবং বিশ্বনাথের মন্দির বেশ দূরে। রিকশা করে যেতে হয়। রাস্তায় প্রচুর মানুষ এবং অসংখ্য যানবাহন, পায়ে হেঁটে এপাশ থেকে ওপাশ যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। সেই যে একটা কবিতা আছে -'শিবঠাকুরের আপন দেশে/আইনকানুন সর্বনেশে' - একেবারে সেই অবস্থা ! রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ আছে, ট্রাফিক সিগন্যাল ও আছে, কিন্তু সেইসব আইনকানুনের পরোয়া কেউ খুব একটা করে বলে মনে হয়না!
এই সর্বনেশে আইনকানুন না মানা রাস্তাঘাট পেরিয়ে, গোধুলিয়ার মোড় ছাড়িয়ে, বাঁহাতে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের তোরন ফেলে এগিয়ে, রিক্সা থেকে আমরা যেখানে নামলাম, সেটা দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি। আমি অবশ্য তখনও বুঝি নি সেটা। সেখান থেকে আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে চললো হোটেলের দিকে। তার জন্য আমরা ঢুকলাম একটা সরু গলির মধ্যে। গলির দুইদিকে নানারকমের দোকান - পান- মিষ্টি-জামাকাপড়-ক্যাসেট-বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি;দোকানগুলি সবই প্রায় দুই-তিন তলা বাড়ীর একতলায়। ফলে গলির মধ্যে রোদ্দুর প্রায় ঢোকেই না। গলিটা মাঝে মাঝে এত সরু যে ওপাশ থেকে একটা স্কুটার বা সাইকেল এলে একদম ধার ঘেঁষে দাঁড়াতে হচ্ছে। আর কি ভীষণ নোংরা!! আমি তো ভাবছি-আরেকটু এগোলেই মনে হয় পরিষ্কার বড় রাস্তা আসবে। ও হরি- কোথায় কি! এ যে পুরো সেই সুকুমার রায়ের ছড়াটার মত -অলি-গলি-চলি-রাম...ডানদিকে-বাঁদিকে বেঁকে চলেই চলেছে, চলেই চলেছে- মাঝে মাঝে এদিক ওদিক থেকে আরো গলি বেরিয়ে গেছে। আসলে আমি তখন হাঁটছিলাম কাশীর বিখ্যাত বাঙ্গালিটোলার ভেতর দিয়ে। চলতে চলতেই একসময়ে চোখ চলে গেল একটা বাড়ীর দেওয়ালে লাগানো একটা নীল রঙের ফলকের ওপর সাদা দিয়ে লেখা নামের দিকে -
এই সর্বনেশে আইনকানুন না মানা রাস্তাঘাট পেরিয়ে, গোধুলিয়ার মোড় ছাড়িয়ে, বাঁহাতে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের তোরন ফেলে এগিয়ে, রিক্সা থেকে আমরা যেখানে নামলাম, সেটা দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি। আমি অবশ্য তখনও বুঝি নি সেটা। সেখান থেকে আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে চললো হোটেলের দিকে। তার জন্য আমরা ঢুকলাম একটা সরু গলির মধ্যে। গলির দুইদিকে নানারকমের দোকান - পান- মিষ্টি-জামাকাপড়-ক্যাসেট-বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি;দোকানগুলি সবই প্রায় দুই-তিন তলা বাড়ীর একতলায়। ফলে গলির মধ্যে রোদ্দুর প্রায় ঢোকেই না। গলিটা মাঝে মাঝে এত সরু যে ওপাশ থেকে একটা স্কুটার বা সাইকেল এলে একদম ধার ঘেঁষে দাঁড়াতে হচ্ছে। আর কি ভীষণ নোংরা!! আমি তো ভাবছি-আরেকটু এগোলেই মনে হয় পরিষ্কার বড় রাস্তা আসবে। ও হরি- কোথায় কি! এ যে পুরো সেই সুকুমার রায়ের ছড়াটার মত -অলি-গলি-চলি-রাম...ডানদিকে-বাঁদিকে বেঁকে চলেই চলেছে, চলেই চলেছে- মাঝে মাঝে এদিক ওদিক থেকে আরো গলি বেরিয়ে গেছে। আসলে আমি তখন হাঁটছিলাম কাশীর বিখ্যাত বাঙ্গালিটোলার ভেতর দিয়ে। চলতে চলতেই একসময়ে চোখ চলে গেল একটা বাড়ীর দেওয়ালে লাগানো একটা নীল রঙের ফলকের ওপর সাদা দিয়ে লেখা নামের দিকে -
বেনারসের বাঙ্গালীটোলায় বাংলায় লেখা গলির নাম
একই সঙ্গে খুব আনন্দ আর উত্তেজনা অনুভব করেছিলাম। বাংলা থেকে এত দূরে, উত্তর প্রদেশে, যেখানে বেশিরভাগ মানুষ হিন্দি ভাষায় কথা বলেন, সেখানে একটা গলির নাম বাংলা অক্ষরে লেখা আছে! আর মজার কথা কি জানো- ওই বাড়ীটার ঠিক উল্টোদিকে একটা ছোট্ট রেস্তোঁরা আছে। খুবই সাদামাটা, গুটিকয়েক কাঠের চেয়ার টেবল পাতা। সেই রেস্তোঁরায় কিন্তু সাদা ভাত-ডাল-রুটির সাথে চাইনিজ-কোরিয়ান-স্প্যানিশ-কন্টিনেন্টাল-লেবানিজ সব রকমের খাবার পাওয়া যায়! ওই দোকানের দেওয়ালে চীনা-কোরিয়ান-ফরাসী-স্পেনীয় ভাষায় খাবারের মেনু আর দাম ও লেখা আছে। একই সঙ্গে এতগুলো ভাষাকে পাশাপাশি দেখে খুব অদ্ভুত লেগেছিল - ঠিক যেন সারা পৃথিবীটাই ছোট্ট হয়ে ঐটুকু জায়গার মধ্যে এসে গেছে!
বেনারসের আসল মজা হল বাঙ্গালীটোলার গলি গুলির মধ্যে, আর ঘাটগুলিতে। বেনারসে বড় ছোট মিলিয়ে আশিটি ঘাট আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দশাশ্বমেধ আর মণিকর্ণিকা। এছাড়া আছে মানমন্দির ঘাট, রানা মহল ঘাট, হরিশচন্দ্র ঘাট, চৌষট্টি ঘাট, রাজা ঘাট...। প্রত্যেকটা ঘাটের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে একেকটা করে গল্প। যদি একটা নৌকায় উঠে বস, তাহলে মাঝিভাই তোমাকে একের পর এক ঘাটের পাশ দিয়ে নিয়ে যাবে আর তাদের গল্প বলতে থাকবে -কোন গল্প সেই প্রাচীনকালের, কোনটা বা আবার একদম এই যুগের...
ভোরের কুয়াশা মাখা দশাশ্বমেধ ঘাট- বারানসীর সবথেকে জমজমাট ঘাট
মানমন্দির ঘাট- এই ঘাট তৈরি করিয়েছিলেন রাজা সওয়াই মান সিং। এখানে একটি ছোট অবসারভেটরি আছে।
বাবুয়া পান্ডে ঘাট-এটা হল ধোপাদের ঘাট। বাবুয়া পান্ডে নামের একজন মানুষ, যিনি নিজে পেশায় ধোপা ছিলেন, তিনি এই ঘাটকে দান করে যান সব ধোপাদের ব্যবহারের জন্য। এখানে রোজ সকালে গেলে দেখতে পাওয়া যায় কত মানুষ সার দিয়ে কাপড় কেচে-ধুয়ে পরিষ্কার করছেন।
এইসব ঘাটে ওঠা-নামার জন্য সিঁড়িগুলি কিন্তু খুব উঁচু উঁচু - তাই উঠতে নামতে গেলে প্রথমদিকে কিন্তু খুব পায়ে ব্যথা করতে পারে!
ঘাটের উঁচু উঁচু সিঁড়ি, উঠতে উঠতে পায়ে ব্যথা !
রংবেরং এর নৌকা, গেরুয়াবসন সন্ন্যাসী, গঙ্গাপুজোর উপকরন, বাঁশের ছাতা...এসব ছাড়া বারানসীর ঘাট অসম্পূর্ণ
বিকেলের দিকে এই ঘাট ভাল করে ধোয়া হয়। আর সন্ধ্যাবেলা এই ঘাটে হয় গঙ্গা আরতি। গান এবং শ্লোকের তালে তালে নানা রকমের উপাচার দিয়ে মা গঙ্গার আরতি করেন পাঁচজন পুজারী।
সন্ধ্যাবেলা দশাশ্বমেধ ঘাটে গঙ্গা আরতি
বারানসীর বিখ্যাত জিনিষগুলি কি কি বলতো? - আচ্ছা, আমিই বলি - কাঠের খেলনা, কাঁচের চুড়ি, বেনারসী শাড়ী, বেনারসী পান, রাবড়ি, প্যাঁড়া, পাথরের থালা-গেলাস...এইসমস্ত জিনিষ যদি একসঙ্গে দেখতে এবং কিনতে চাও, তাহলে কিন্তু বিশ্বনাথের গলিতে ঢুকতেই হবে। বিশ্বনাথের গলি মানে হল যে গলির শেষে বাবা বিশ্বনাথের মন্দির আছে। তা বলে মোটেও ভেবো না সেটা কোন ছোটখাটো গলি। আসলে বিশ্বনাথের মন্দিরের চারিপাশেই অনেকগুলি গলি আছে, এবং সে এক বড় মজাদার গোলোকধাঁধা। কি নেই সেখানে! এইসব নানারকমের চোখ ধাঁধানো জিনিষের সাথে কিন্তু রয়েছে গলিতে যত্র-তত্র দাঁড়িয়ে থাকা ষাঁড় আর দোকান এবং মন্দিরের মাথায় লাফ-ঝাঁপ দিয়ে বেড়ানো হনুমানের দল। ষাঁড় কিনা বাবা বিশ্বনাথের বাহন, আর হনুমান তো নিজেই পূজনীয়, তাই এদেরকে কেই কিছু বলেনা। তবে বেনারসের গলির ষাঁড়েরা খুবই শান্ত, তারা বিশেষ কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু হনুমানেরা ভয়ানক দুষ্ট, ঘরের দরজা খোলা থাকলে কিন্তু ঘরে ঢুকে জিনিষপত্র লন্ডভন্ড করে দেবে, বা মন্দিরের পথে প্রসাদের ঠোঙ্গা কেড়ে নেবে!!
ষাঁড়,রাবড়ি, কাঁচের চুড়ি, হনুমান... এই সব কিছু নিয়েই বারানসী
ভগবান বুদ্ধের প্রথম বানী লিখে রাখা আছে এই ফলকে
সারনাথে বেশ কয়েকটী বৌদ্ধ মন্দির আছে। আছে একটি বিশাল স্তূপ। কথিত আছে, ওই স্তূপের ভেতরে সম্রাট অশোক ভগবান বুদ্ধের দেহাবশেষ রেখেছিলেন।
ভগবান বুদ্ধের দেহাবশেষ রক্ষিত আছে এই স্তূপে ভেতর।
সারনাথ মিউসিয়াম বা বিশ্বনাথের মন্দিরে ক্যামেরা বা মোবাইল ফোন নিয়ে ঢোকা বারন। তাই এইসব জায়গার ছবি তোলা যায়নি।
যেদিন চলে আসব, সেদিন সকালে খুব মজা হল। তিন-চার দিন কুয়াশা থাকার পর সেদিন আকাশ পরিষ্কার হয়ে ঝকঝকে সোনালি রোদ্দুর উঠলো।
নদির বুকে সোনালী আলো
আমরা সবাই নৌকা চেপে গঙ্গায় বেড়াতে গেলাম। মাঝনদীতে পাশে এলো আরেকটি নৌকা। সেই নৌকার মাঝি বিক্রী করছিল সেউভাজা। কেন বলতো? - নদীর বুকের ওপর পাক খেয়ে বেড়ানো পরিযায়ী পাখিদের কাছে ডাকার জন্য ঐ সেউভাজা হল টোপ। যেই আমরা জলের ওপর সেউ ছড়িয়ে ডাক দিলাম- আ-আ-আ...
অমনি দূর থেকে কলরবলর করতে করতে আমাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে এল রাশি রাশি সী-গাল, ঘুরপাক খেতে লাগলো আমাদের নৌকার আশেপাশে, ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে, আবার ধেয়ে উঠে গেল আকাশে!
সীগাল দের সাথে
বেশ খানিক্ষণ সী-গাল দের সঙ্গে খেলা করে আমরা ফিরে এলাম অনেক বেলায়।
বারানসীর আরো দুটি দ্রষ্টব্য জায়গা হল রামনগর রাজবাড়ী আর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া আছে অসংখ্য ছোট বড় মন্দির। সব জায়গা আমার নিজেরই ঘোরা হয়নি। যে প্রাচীন নগরীর পরতে পরতে, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এত এত গল্প, তাকে কি মোটে চার-পাঁচ দিনে চিনে ওঠা যায়? তাই আমি সুযোগ পেলে আবার বেড়াতে যাব বারানসী। খুঁজে নেবো আরো অনেক গল্প, লোককথা আর পুরানকথা। আর আবার সন্ধেবেলা নৌকায় চেপে বেড়াতে বেড়াতে নিজের মনের ইচ্ছা চুপি চুপি ভগবানকে জানিয়ে দিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেব আলোর প্রদীপ...
সীগাল দের সাথে
বেশ খানিক্ষণ সী-গাল দের সঙ্গে খেলা করে আমরা ফিরে এলাম অনেক বেলায়।
বারানসীর আরো দুটি দ্রষ্টব্য জায়গা হল রামনগর রাজবাড়ী আর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া আছে অসংখ্য ছোট বড় মন্দির। সব জায়গা আমার নিজেরই ঘোরা হয়নি। যে প্রাচীন নগরীর পরতে পরতে, আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে এত এত গল্প, তাকে কি মোটে চার-পাঁচ দিনে চিনে ওঠা যায়? তাই আমি সুযোগ পেলে আবার বেড়াতে যাব বারানসী। খুঁজে নেবো আরো অনেক গল্প, লোককথা আর পুরানকথা। আর আবার সন্ধেবেলা নৌকায় চেপে বেড়াতে বেড়াতে নিজের মনের ইচ্ছা চুপি চুপি ভগবানকে জানিয়ে দিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেব আলোর প্রদীপ...
লেখা ও ছবিঃ
মহাশ্বেতা রায়
মহাশ্বেতা রায়
পাটুলী, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে