মারথোমা নাসরানিদের দেশে
তুমি তো নিশ্চয়ই 'কেরল' বা 'কেরালা'র নাম শুনেছো -দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটক আর তামিলণাড়ু সংলগ্ন যে ছোট্ট একটা রাজ্য, যেখানে সবাই "মলয়ালম" ভাষায় কথা বলে? প্রায় বছর ষাটেক আগে ঐ অঞ্চলের ত্রিবাঙ্কুর আর কোচিন - এই দুটো ছোট রাজ্য মিলে বর্তমান কেরলের জন্ম হয়, কারণ ওই দুটো অঞ্চলেই সমস্ত মানুষ এই মলয়ালম ভাষায় কথা বলতো।
পূর্ব্দিকে সুদীর্ঘ বিস্তৃত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর পশ্চিমে বিশাল সমুদ্র কেরল ভূখন্ডকে পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলো থেকে এমনভাবে লুকিয়ে আড়াল করে রেখেছে, যে বহু শতাব্দী ধরে মানুষজন এর অস্তিত্বের কথাই জানতো না। কিন্তু দেশের মানুষ না জানুক, বাইরের সুবিশাল জগতের সঙ্গে-বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সঙ্গে কেরলের ছিলো সুপ্রাচীণ বানিজ্যিক সম্পর্ক - আর সেই সূত্রেই বহু দেশের হরেক রকম সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের যাতায়াত ছিলো এই কেরলে, যাদের মধ্যে অনেকেই এখানে পাকাপাকিভাবে আস্তানাও গেড়েছিলো।
পূর্ব্দিকে সুদীর্ঘ বিস্তৃত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আর পশ্চিমে বিশাল সমুদ্র কেরল ভূখন্ডকে পার্শ্ববর্তী জায়গাগুলো থেকে এমনভাবে লুকিয়ে আড়াল করে রেখেছে, যে বহু শতাব্দী ধরে মানুষজন এর অস্তিত্বের কথাই জানতো না। কিন্তু দেশের মানুষ না জানুক, বাইরের সুবিশাল জগতের সঙ্গে-বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সঙ্গে কেরলের ছিলো সুপ্রাচীণ বানিজ্যিক সম্পর্ক - আর সেই সূত্রেই বহু দেশের হরেক রকম সংস্কৃতি ও ধর্মের মানুষের যাতায়াত ছিলো এই কেরলে, যাদের মধ্যে অনেকেই এখানে পাকাপাকিভাবে আস্তানাও গেড়েছিলো।
ব্যাকওয়াটার -কোট্টায়ম থেকে আলেপ্পি যাওয়ার পথে
এই যে ব্যাকওয়াটারের ছবি দেখছো, এগুলো হলো সমুদ্রেরই অংশ যা খাঁড়ির মতো মূল ভূখন্ডের অনেক ঢুকে গেছে। ভাবতে পারো, এর ওপর দিয়েই চলাচল করতো হাজার হাজার বছর আগের বহুদূর থেকে আসা সমস্ত বণিকদের জাহাজ-বজরা?কেরলে এই প্রবল বাণিজ্যিক আকর্ষণের অন্যতম মূল কারণ ছিল 'গোলমরিচ', যা সেই সময়ে ইউরোপে রপ্তানি করা হতো- এই গোলমরিচ পশ্চিমে পরিচিত ছিলো 'ব্ল্যাক গোল্ড' অর্থাৎ 'কৃষ্ণকায় স্বর্ণ' নামে। তাহলেই বুঝে দেখো, এর কদর! আর তার চেয়েও বড় কথা হলো এই যে এই প্রকান্ড বাণিজ্য কুক্ষিগত ছিলো কেরলের এক বিশেষ সম্প্রদায়ের হাতে, যারা হলো আমাদের আলোচনার মূল বিষয়।
ব্যাকওয়াটারের ধারে মানুষের বসতি; প্রত্যেক বাড়ির নিজস্ব ঘাট ও নৌকা আছে
প্রাচীনকাল থেকেই আরা পরিচিত সাধু থোমার খ্রীষ্টিয়ান নামে। এরাই আবার সিরিয়ান বা সুরীয় খ্রীষ্টিয়ান নামেও পরিচিত, কারণ এরা এখনও সিরিয়্যাক ভাষায় উপাসনা করে থাকে - যে ভাষায় কথা বলতেন স্বয়ং যীশু খ্রীষ্ট।যীশু খ্রীষ্টের বারোজন শিষ্যের অন্যতম সাধু থোমা বা সেন্ট টমাস প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (আনুমানিক ৫২ খ্রীষ্টাব্দে) কেরল উপকূলে উপস্থিত হন এবং তাঁর প্রচার ও আশ্চর্য কাজে মুগ্ধ হয়ে বহু মানুষ খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয় - এরাই হলো কেরলের সুরীয় খ্রীষ্টিয়ান সম্প্রদায়। আমাদের দেশের বহু বিখ্যাত মনীষীই এই সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত। সেন্ট টমাসের কেরলে আগমনকে কেন্দ্র করে প্রচলিত আছে বহু প্রাচীণ উপাখ্যান, পুরাণ -কথা ও বিভিন্ন গীতিমাল্য, নাচ - যা সবই হলো কেরল তথা ভারতবর্ষের এই সুপ্রাচীন খ্রীষ্টিয়ান সম্প্রদায়ের সুমহান ঐতিহ্যের শরিক। এওসব নিয়ে আমরা পরে সুযোগ পেলে আলোচনা করবো।
প্রথমেই বলেছি যে সেই কত হাজার বছর আগে থেকেই কেরলে কত বিচিত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এসেছে স্থায়ী বসবাসের উদ্দেশ্যে। তাই বহু প্রাচীন কাল থেকেই এখানে যেমন ছিলো স্থানীয় হিন্দু মন্দির, তেমনি সুরীয় খ্রীষ্টানদের গীর্জা, ইহুদী সিনাগগ, মুসলমানদের মসজিদ, বৌদ্ধদের প্যাগোডা, এমনকি গ্রীক ও রোমানদের মন্দির ! বেশ কিছু বছর আগেই কেরলের সমুদ্র উপকূলে খননকার্য চালিয়ে প্রত্নতাত্বিকেরা খুঁজে পেয়েছেন একটি বিশালকায় গ্রীক দেবতা আপোল্লোর মন্দির ! তাই বহুযুগ ধরেই কেরলে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে এমন এক সমন্বয় ও আদান-প্রদান ভিত্তিক সম্পর্ক দেখা গেছে তার সত্যিই জুরি মেলা ভার। অনেক সময় দেখা যায়,কেরলের মন্দির ও প্রাচীন গীর্জাগুলি একই রকম পাথরে তৈরি আর অবিকল এক দেখতে। কারণ হলো, একই স্থপতি সব কিছু তৈরি করতো।
কোট্টায়মের প্রাচীন গীর্জা; পাশেই উঁকি দিচ্ছে মসজিদের মিনার
ছবিতে তুমি দেখতে পাচ্ছো যে কোট্টায়মে (মধ্য কেরালায়) একই স্থানে সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান গির্জা (কমপক্ষে ১০০০-১২০০ বছর প্রাচীন) , হিন্দু মন্দির ও মুসলিম মসজিদ। উত্তর কেরালার পালায়ুরে গেলে দেখবে একই চাতালের মধ্যে রয়েছে প্রাচীণ মন্দির, গির্জা,মসজিদ ও ইহুদীদের সিনাগগ। এখনও বিশেষ বিশেষ উৎসব বা পর্বদিনে এই বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্মীয় বিভিন্ন আচারের আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
কোচিনে প্রাচীন মন্দির; পাশেই রয়েছে ইহুদীদের সিনাগগ; চূড়া দেখা যাচ্ছে
সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান গীর্জার সামনে গোপুরম বা পতাকাস্তম্ভ; প্রতিটি মন্দিরের সামনেও থাকে। পর্বদিনে পতাকা উত্তোলন করা হয়।
কেরলের এই প্রাচীণ খ্রীষ্টিয়ানেরা নিজেদের মলয়ালম ভাষায় বলে থাকে 'মারথোমা নাসরানিঙ্গল' বা 'মারথোমা নাসরানি'। সিরিয়্যাক ভাষায় 'মার' মানে প্রভু বা সন্ত আর 'নাসরানি' হলো আরবী শব্দ যার মানে খ্রীষ্টিয়ান, কারণ যীশু খ্রীষ্টের পৈতৃক ভিটে ছিলো 'নাসরৎ' নামক গ্রামে। অর্থাৎ এরা নিজেদের 'সাধু থোমার খ্রীষ্টিয়ান'- এই নামে অভিহিত করে। তাই সাধু থোমা বা সেন্ট টমাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছেন - যেন এক রূপকথার চরিত্র। সেন্ট টমাস, যিনি তাদের পূর্বপুরূষদের দীক্ষা দিয়েছিলেন দুহাজার বছর আগে, তাদের কাছে কোন নিছক প্রবাদবাক্য নয়। সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান পরিবারের প্রতিটি শিশুই আম, নারকোল, বাগদা চিংড়ি আর নানারকম মসলার স্বাদ-গন্ধের মতোই সেন্ট টমাসের কাহিনী তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করতে করতেই বেড়ে ওঠে।
চেঙ্গান্নুরে প্রাচীন সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান গীর্জা; বলা হয়, ১৭০০ বছরের পুরোনো,অর্থাৎ চতুর্থ শতাব্দীতে নির্মিত
গীর্জার সামনে প্রাচীন গ্র্যানাইট ক্রুশ; গায়ে রয়েছে খোদাই করা পশু, পাখি্, মানুষ, নক্সা
ফাদার ভার্গিজ, একজন সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান মালপান ( সিরিয়্যাক ভাষার শিক্ষক)-এর সাথে আমি
কথিত আছে, কেরলদেশের সাতটি স্থানে সাধু থোমা স্থাপন করেছিলেন পবিত্র ক্রুশ -পরবর্তীকালে যেখানে গড়ে ওঠে সাতটি গির্জা। এইগুলো হলো যথাক্রমে - কোড্ডুঙ্গাল্লুর (বা ক্রাঙ্গানোর), কোল্লাম, পালায়ুর, পারুর, নিরানাম, কোক্কমংগলম আর চায়াল। সিরিয়ান খ্রীষ্টিয়ান রা ছড়িয়ে আছেন সমগ্র কেরল জুড়ে, বিশেষ করে মধ্য ও দক্ষিণ কেরালায়। পরের সংখ্যায় আমরা এইরকম বিভিন্ন জায়গায় ও প্রাচীণ পীঠস্থানে যাবো, অনেক ছবি দেখবো আর আরও অনেক চমকপ্রদ বিষয়ে কথা শুনবো। আমাদের যাত্রা শুরু হবে মধ্য কেরালার সিরিয়ান খ্রীষ্টান অধ্যুষিত ছোট্ট শহর কোট্টায়াম থেকে।
(ক্রমশঃ)
আবীরলাল মিত্র
মানিকতলা, কলকাতা
আবীরলাল মিত্র
মানিকতলা, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা