নাকাই আর পিপিলীকাভূক

একটা ছোট্ট ছেলে, নাম তার –নাকাই। বয়স কত বলো তো - মাত্র বারো বছর বয়স। উত্তর জিম্বাবোয়ের মুরেওয়া শহরের কাছে সে তার মা, বাবা, আর ছোট ছোট ভাইবোনদের সাথে থাকে একটা চালাঘরে । খুব গরীব তো তাই ছাগল চড়ায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত । সময় পেলে বই পড়ে নয়তো ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে। একদিন কি হয়েছে জানো?
এমনি ছাগল চড়াতে চড়াতে একদিন সে একটা অদ্ভুত প্রাণী দেখতে পেল। সে কিন্তু ভয় পায় নি , ভাবলো মনে মনে ওটা বোধহয় একটা সজারু- ওই যার সারা গায়ে কাঁটা কাঁটা থাকে ।
নাকাই যে জন্তুটাকে দেখল তার গায়ে কিন্তু কাঁটা নেই আবার কোন পড়ার বইতেও সে এরকম জন্তুর ছবি দেখে নি । ওকে দেখে জন্তুটা এক নিমেষে বড় বড় ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে পড়লো।
দৌড়ে দৌড়ে বাড়িতে গেল নাকাই আর গ্রামের সব মানুষকে , চিতকার করে ডাকতে লাগলো, "শিগগির এসো, আমি একটা অদ্ভুত জন্তু দেখেছি । তোমরা কেউ কোনোদিন এরকম জন্তু দেখোনি। আমার বইতেও এরকম কোন জন্তুর ছবি নেই।"
নাকাই এর মুখে জন্তুটার বর্ণনা শুনে, গ্রামের যারা বয়স্ক মানুষ, তাঁরা বুঝতে পারলেন নাকাই একটা প্যাঙ্গোলিন দেখতে পেয়েছে।
সবাই ছুটে ছুটে এল আর অর মা বাবাও এল। কিন্তূ কেউই কিছু দেখতে পেল না। সবাই ভাবলো নাকাই বোধহয় ওদের সাথে দুষ্টুমি করছে!
সবাই খুঁজতে আরম্ভ করলো । কেউ বা গাছে চড়ে বসলো, কেউ বা বড় বড় ঘাসের মধ্যেই খুঁজতে থাকলো। শেষে একদিক থেকে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ডাক শুনে সবাই সেইদিকে দৌড়ালো। সবার আগে গিয়ে পৌঁছালো মানোকা নামে একজন ওদের গ্রামেরই মানুষ। মানোকা দেখলো, একটা অদ্ভুত জন্তু একটা গর্তের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করছে। জন্তুটার দাঁত নেই, দেখতে যেনো খানিকটা ডায়নোসরের মত । সারা গায়ে একটা বাদামী রঙের মাছের আঁশের মত আঁশ ঢাকা খোলস। মুখটা ছুঁচালো ও সরু আর ল্যাজটা বড় ।

প্যাঙ্গোলিন
গেম ওয়ার্ডেনরা কেনো এলেন বলতো? আসলে প্যাঙ্গোলিন হল একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রানী বা endangered species। অর্থাৎ কিনা, এই প্রানীর সংখ্যা পৃথিবীতে ক্রমশঃ কমে আসছে। তাই প্যাঙ্গোলিন কে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার। যে প্যাঙ্গোলিনটিকে খুঁজে পাওয়া গেলো, সেটিকে যাতে ঠিকমত যত্ন করা হয়, তার তদারক করতেই এলেন ওই দুইজন গেম ওয়ার্ডেন।
প্যাঙ্গোলিন সাধারনতঃ পাওয়া যায় দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু অংশে। এই নিরীহ স্তন্যপায়ী প্রানীগুলি কি খায় জানো? এদের প্রধান খাবার হল পিঁপড়ে , উইপোকা এইসব। প্যাঙ্গোলিনের দাঁত নেই, কিন্তু আছে একটা লম্বা আঠালো জিভ - সেইটা একবার পিঁপড়ের বাসায় ঢুকিয়ে দিলেই হল! সেই আঠালো জিভে লেগে যায় রাশে রাশে পিঁপড়ে। এতটা পড়ার পর তুমি প্যাঙ্গোলিনের বাংলা নাম নিশ্চয় মনে করে ফেলেছো? - একদম ঠিক- পিপীলিকাভূক!! প্যাঙ্গোলিন মাটির তলায় গর্ত করে এতোটাই বড় বাসা বানায় যে তার ভেতরে একটা বড় মানুষ ঢুকে দাঁড়িয়ে যেতে পারে!! শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই লাজুক প্রানী তার পেট আর মুখ গোল করে গুটিয়ে পিঠের শক্ত আঁশের ভেতর নিয়ে নেয়। প্যাঙ্গোলিনের পিঠের আঁশগুলি তাকে আত্মরক্ষায় সাহায্য করে। যদি দুট আঁশের ফাঁকে তোমার আঙ্গুল ঢুকে যায়, তাহলে সে সঙ্গে সঙ্গে আঁশ দিয়ে চেপে ধরবে, আর জোরে চিমটি কাটার মত ব্যথা লাগবে কিন্তু! পৃথিবিতে আট রকমের প্যাঙ্গোলিন প্রজাতি আছে, যার মধ্যে বেশিরভাগ গুলোই কিন্তু লুপ্তপ্রায় বা বিপন্ন অস্তিত্ব। মালয় শব্দ 'পেঙ্গুলিং' - মানে' যা গুটিয়ে যায়' - থেকেই প্যাঙ্গোলিন [pangolin] নামটা এসেছে।

প্যাঙ্গোলিনের ছানা
নাকাই এর দেশ জিম্বাবোয়ের সরকার ঘোষনা করেছিলেন যে কেউ যদি প্যাঙ্গোলিন দেখতে পায় আর সেটাকে সরকারের হাতে তুলে দেয়, তাহলে তাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হবে, এমনকি টেলিভিশনে তার ছবিও দেখানো হবে। আর সেই উদ্ধার করা প্যাঙ্গোলিনকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কোন অভয়ারন্যে-যেখানে সে শান্তিতে, নির্ভয়ে থাকতে পারবে। নাকাই এর এই প্যাঙ্গোলিন উদ্ধারের ঘটনার কথা ২০০৭ সালে লেখেন সিসিল ডেওওয়া। তিনি লেখেন, সে সময়ে নাকাই এর গ্রামের এক বৃদ্ধ মানুষ বলেছিলেন "আমার ভাগ্য ভাল আমি সত্তর বছর পরে এই জন্তুটাকে আবার দেখতে পেলাম!" এটা শুনেই নিশ্চয় বুঝতে পারছ জিম্বাবোয়েতে প্যাঙ্গোলিনের সংখ্যা কত কমে গেছে।
সবাই ভাবতে বসলো- কে পাবে সম্মান- নাকাই না মানোকা? শেষমেষ মানোকা বললো - নাকাই সবথেকে আগে প্যাঙ্গোলিনটাকে দেখতে পেয়েছে, তাই সম্মান ওরই প্রাপ্য।

মায়ের পিঠে চেপে বেড়াতে যাচ্ছে ছানা প্যাঙ্গোলিন
জিম্বাবোয়েতে মনে করা হয়, প্যাঙ্গোলিন দেখতে পেলে ভাগ্য খুলে যায়। নাকাই আর অন্যান্য গ্রামবাসীদের ভাগ্য তো ভাল হবে নিশ্চয়, কিন্তু বড় কথা হল এই প্যাঙ্গোলিনটার ভাগ্যটাও ভালো- যে ওকে সবাই মিলে রক্ষা করলো, তাই না? তুমি কি জানো- এইরকম আরো অনেক প্রানী আছে সারা পৃথিবী জুড়ে, যাদের অনেকেরই অস্তিত্ব বিপন্ন, শুধুমাত্র মানুষের ভাবনা চিন্তাহীন কাজকর্মের জন্য? আমাদের দেশের অলিভ রিডলী কচ্ছপ, বনবিড়াল, শেয়াল, চীনের প্যান্ডা, সাইবেরিয়ার তুষার ভালুক...এমন আরো অনেক প্রজাতি কিন্তু ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। এদের সবাইকে আমরা যদি সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবেই তো পৃথিবী আরো সুন্দর হয়ে ঊঠবে, কি বলো?
সীমা ব্যানার্জ্জী
ড্যালাস, টেক্সাস
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা
বৈঠকী রবি ঠাকুর

রবি ঠাকুর, মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেন তো? তুমি তো ঘাড় নেড়ে বলবে -হ্যাঁ। কিন্তু সত্যি কি পুরোপুরি চেনো? তাঁর গান, কবিতা, নাটক, নোবেল প্রাইজ, জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতন এইসব গল্প তো সকলের জানা। আমি বরং তোমায় কিছু বৈঠকী গল্প শোনাই, যা হয়ত তোমার অজানা।
১
একদিন রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে একদল ছেলে এসেছে পুজোর চাঁদা নিতে। তিনি তাদের বসতে বললেন। তারপর বাড়ির কাজের লোককে ডেকে বললেন "যা তো এনাদের জন্য চা নিয়ে আয়"। ওনাদের দলের একজন বললেন-"না, না, আমরা চা খাই না"। সঙ্গে সঙ্গে কবি বললেন, "ওঃ এঁরা নাচার দলে"; ওনারা ভারি অপ্রস্তুত। ওনাদের আরেকজন বললেন,"We mean, we don't take tea." কবি সঙ্গে সঙ্গে আবার বললেন "ওরে ভুল বলেছি ওনারা [no tea] নটীর দলে..."
২
আরেকদিন কবির বৈঠকখানায় একঘর লোক বসে আছে। কবি হটাৎ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন " এ ঘরে একটা বাঁদর আছে।" সক্কলে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করল। কবি কাকে বাঁদর বলছেন রে বাবা! দম বন্ধ করা কয়েক মূহুর্ত! হটাৎ কবি হেসে উঠলেন হা হা করে। বললেন, "ওরে বাবা, এ ঘরে যেমন একটা ডান দোর [দরজা] আছে, তেমন এই দিকে একটা বাঁ দোর ও আছে!"
৩
রবি ঠাকুর নীল রঙের বড় ভক্ত ছিলেন। বলতেন "সব রঙের মধ্যে নীল রংটাই আমার মনকে বেশি করে নাড়া দেয়। কারণ নীল রংটা যে পৃথিবীর রঙ, আকাশের শান্তির রঙ, ওটার মধ্যে আমার চোখ ডুবে যায়। লাল রংটা হল, রক্তের রঙ, আগুনের রঙ, প্রলয়ের রঙ, মৃত্যুর রঙ, কাজেই বেশি দেখতে না পেলে দোষ কি?"
আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল উনি রঙ কানা ছিলেন!
৪
দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর কবি শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে, ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে। সেই ঘরেই এক কোনায় বসে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী পানের বাটা নিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পান সাজছিলেন আর খাচ্ছিলেন; আর কোনও এক গল্পের ছলে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছিলেন। কবি তক্ষুনি কাগজ কলম নিয়ে বসলেন, লিখলেন -
"ওলো সই, ওলো সই,
আমার ইচ্ছা করে তোদের মত মনের কথা কই,
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি
কোনে বসে কানাকানি
কভু হেসে কভু কেঁদে নীরব হয়ে রই..."
এইরকম আরো নানা সরস গল্প আছে রবি ঠাকুরের বিষয়ে। আবার অন্য কোন বারে, বলব, কেমন? এই গল্পগুলি কেমন লাগল আমায় চিঠি লিখে জানিও কিন্তু।
কোয়েলী গঙ্গোপাধ্যায়
ফরতাবাদ, কলকাতা
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: জানা-অজানা