টিয়াপাখিদের দেশে
ভাবো তুমি দাঁড়িয়ে আছ আর তোমার পাশে হঠাত একটা টিয়াপাখি উড়ে এসে বসল। তুমি ভাবছ সেটা আর এমন কি কথা? কথাটা হল - পাখিটা তিন ফুটের বেশি লম্বা!!-মানে হতে পারে তোমারই সমান লম্বা!!গায়ে উজ্জ্বল লাল-হলুদ আরে নীল রঙের পালক। আমার পাশে যখন এত বড় একটা পাখি উড়ে এল, আমি তো চমকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার যোগাড়! তারপর অবাক হয়ে পাখিটার রঙের বাহার দেখতে থাকলাম। এই পাখিটার নাম স্কারলেট ম্যাকাও। এরা মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকার বাসিন্দা।
স্কারলেট ম্যাকাও -উজ্জ্বল লাল, আকাশী নীল রঙের পালক
ভাবতে অবাক লাগে এদের গায়ের এত রঙের বাহার এল কোথা থেকে! পাখিগুলো রীতিমত পাখিদের স্কুলে পড়া -শিক্ষিত, প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। স্কুলে পাখিগুলোকে শেখান হয়েছে কি ভাবে মানুষের সাথে মেলা মেশা করতে হয়। এরা মজার খেলাও দেখাতে পারে। পাখিদের মধ্যে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা হলে স্কারলেট ম্যাকাও সেরা পছন্দের মধ্যে একজন হবেই হবে।
স্কারলেট ম্যাকাও খাবার নিচ্ছে আমার বন্ধু প্রদীপের হাত থেকে
কি, কেমন আছ? আগের সংখ্যায় আমরা গেছিলাম যেখানে প্রাকৃতিক বিস্ময় আছে। আজ এসেছি যেখানে শুধু অনেক ধরনের টিয়া পাখি আছে!জায়গাটার নাম প্যারট জাঙ্গল - স্থান- মিয়ামি, ফ্লোরিডা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই জায়গাটা হল চুটিয়ে মজা করার জায়গা। জায়গাটা ফ্লোরিডা তে একটা দ্বীপের মধ্যে। সেখানে এই পাখিরা খাঁচার মধ্যে নয়, খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ায়। সেই ১৯৩৬ সাল থেকে শুরু। অস্ট্রিয়ার ফ্রানজ শের এর স্বপ্ন ছিল এমন একটা জায়গা বানানোর, যেখানে পাখিরা খাঁচায় নয়, খোলা আকাশের নিচে থাকবে।ওনার পরিবারের লোকেরা এই ভাবনাকে হেসে উড়িয়ে দেয়। তারা বলে যে পাখিরা সব উড়ে চলে যাবে। দমে না গিয়ে ফ্রানজ শের ২৫ টা পাখি নিয়ে শুরু করেন প্যারট জাঙ্গল। এখন এখানে ১১০০ ক্রান্তীয় পাখি আর ২০০০ ধরনের গাছপালা আছে। সত্যি, একজন মানুষ নিজের মনের জোরে এগিয়ে গেলে কত কি করতে পারে!
দ্বীপে ঢুকলেই চোখে পড়বে রং-বেরঙ্গের টিয়াপাখি। পাখিদের কলরবে কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়। অধিকাংশ পাখি আবার কথা বলতে পারে। সামনেই একটা বড় স্কারলেট ম্যাকাও এর সিমেন্টের মূর্তি বসান আছে। জায়গাটা সবুজ গাছপালা, অর্কিড, আর জানা-অজানা পশু-পাখিতে ভর্তি। চিড়িয়াখানাই বলা যায়। কিন্তু এইখানে সব ধরনের পশু পাখি নেই যা চিড়িয়াখানায় থাকে।
স্কারলেট এর লাল রঙ থেকে চোখ ফেরালেই এবারে নীল সোনা রঙের টিয়াপাখি। নাম ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও। এদের পিঠের রঙ শরতকালের আকাশের মত নীল, আর পেটের দিকের রঙ উজ্জ্বল সোনার মত হলুদ।
ব্লু-গোল্ড ম্যাকাও-পিঠের রঙ নীল আর বুকের পালক হলুদ
সবচেয়ে অবাক করা কথা হল, লজ্জা পেলে বা রেগে গেলে, এই পাখিদের গালের রঙ বদলে যায়!! ভাবা যায়!!ঠিক যেন মানুষের মত। এরাও লম্বায় প্রায় আড়াই ফুট হয়। এরাও মধ্যে এবং দক্ষিন আমেরিকার বাসিন্দা। এরা সবসময় দল বেঁধে থাকতে ভালবাসে। একা থাকতে একদম পছন্দ করে না। এরা মানুষের গলা ভাল নকল করতে পারে। এদের কাছে গিয়ে কথা বললেই এরা সহজেই কথা বলে।
নারকেল কিনতে যাই চল এবার। দোকানের একপাশে একটা নীল রঙের বেশ বড়সড় টিয়াপাখি রাখা আছে। তুমি ভাবছ এখানে টিয়াপাখি কেন? তুমি বললে নারকেলটা ভেঙ্গে দিতে। দোকানদার নারকেলটা নিয়ে পাখিটার দিকে এগিয়ে গেল। তুমি অবাক হয়ে ভাবছ- হচ্ছেটা কি? তারপর অবাক হয়ে দেখলে টিয়াপাখিটা এক চঞ্চুর ধাক্কায় নারকেলটা ফাটিয়ে দিল!!
হায়াসিন্থ ম্যাকাও- এই পাখি চঞ্চুর একধাক্কায় নারকেল ফাটাতে পারে
আমি কিন্তু একদম সত্যি কথা বলছি। এই টিয়াপাখিটা উড়তে পারা টিয়াদের মধ্যে সবথেকে বড়। রাজকীয় চেহারা। গোটা শরীর নীল রঙের পালকে ঢাকা। ঠোঁটের কাছে এক চিলতে হলুদ। কুচকুচে কালো চঞ্চু। যারা টিয়াপাখি ভালবাসে, তাদের নয়নের মণি- হায়াসিন্থ ম্যাকাও। এরা সাড়ে তিন ফুট অবধি লম্বা হতে পারে। ডানা মেললে এরা চার থেকে পাঁচ ফুট লম্বা হতে পারে, অর্থাৎ প্রায় একজন বড় মানুষের সমান লম্বা!!
এবার আমরা গেলাম অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে বড় কাকাতুয়া দেখতে। ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়া। এদের চঞ্চু কাকাতুয়াদের মধ্যে সবথেকে লম্বা। মজার ব্যাপার হল, দেখলে মনে হবে যেন জিভ ভ্যাঙ্গাচ্ছে।আসলে, এদের ওপরের চঞ্চু আর নিচের চঞ্চুর গঠন আলাদা বলে মুখ পুরোপুরি বন্ধ হয়না, তাই লাল জিভটা সবসময় দেখা যায়। তাই মনে হয় জিভ ভ্যাঙ্গাচ্ছে। এদের ও রাগ বা উত্তেজনা হলে গালের রঙ বদলে যায়।
ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়া
প্যারট জাঙ্গল এর পাখিরা খেলা দেখাতে ওস্তাদ। টিয়াপাখি সাইকেল চেপে ব্যালান্স এর খেলা দেখায়। এমু, ময়ূর, বাজপাখি ও খেলা দেখায়।
টিয়াপাখি সাইকেলে চেপে খেলা দেখাচ্ছে
বাচ্চাদের খেলার জায়গায় অনেক গৃহপালিত পশু-পাখি আছে। আমার অবাক লেগেছে চাইনিজ সিল্কি চিকেন দেখে।
চাইনিজ সিল্কি চিকেন
এছাড়াও আছে পেঙ্গুইন, ক্যাসোওয়ারিস আর টার্কি। টার্কির ছবি পাঠালাম তোমার জন্য। আমি আগে কোনদিন টার্কি দেখিনি। তুমি কি দেখেছ? টার্কির গলার কাছে কি ঝুলছে বলত?
টার্কি -গলায় কি ঝুলছে বলত?
এছাড়া আছে ফ্লোরিডার বিখ্যাত কুড়ি ফুট লম্বা কুমির- নাম ক্রকোসরাস। ক্রকোসরাসের চোয়ালটাই চার ফুট এর বেশি লম্বা।
বিশাল লম্বা ক্রকোসরাস
আরো দেখলাম জলের ধারে ঘুলে বেড়াচ্ছে গোলাপি ফ্লেমিংগো। ফ্লেমিংগোদের ছবি দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। এদের গায়ের সব পালক গোলাপি। এরা শুধু চিংড়ি মাছ খায়। সবসময় দল বেঁধে থাকা এই পাখিদের সবথেকে বেশি দেখতে পাওয়া যায় কেনিয়াতে।
গোলাপি ফ্লেমিংগো
এবার ছবিগুলো কিন্তু আমার তোলা নয়। আমার কম্প্যুটর কিছুদিন আগে খারাপ হয়ে গিয়ে সব ছবি নষ্ট হয়ে যায়। আমার বন্ধু দেবযানী দাশগুপ্ত তাঁর তোলা ছবিগুলি আমাকে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
কেমন লাগল বল তোমার? আমি এবার তৈরি হচ্ছি মনার্ক প্রজাপতিদের পরিযান দেখব বলে। আমার বাড়ির খুব কাছ দিয়েই এপ্রিল মাস নাগাদ মনার্ক প্রজাপতিরা উড়ে যায়। তাদের যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে এবার ছবি তোলার ইচ্ছা আছে। জানাব তোমায়, ছবি তুলতে পারলাম কিনা।
দেবাশীষ পাল
ওকলাহোমা সিটি, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র
ছবিঃ
দেবযানী দাশগুপ্ত
ব্ল্যাক পাম কাকাতুয়ার ছবিঃ ফ্লিকার
- বিস্তারিত
- লিখেছেন দেবাশীষ পাল
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
টোকিও না টাকি- কোথায় থাকি?
দেখতে দেখতে ব্যাংকক এর সুবর্নভূমি বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। এই বিমানবন্দর এত বড় যে এর মধ্যে আমাদের কলকাতার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অন্তত গোটা বিশেক ঢুকে যাবে। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত এত দূর যে অন্তত গোটা দশেক ফ্ল্যাট এস্কেলেটর আছে।
লম্বা ফ্ল্যাট এস্কেলেটর চলে গেছে কতদূর!
ব্যাংকক থেকে টোকিও পৌঁছে গেলাম সময়ের একটু আগেই। প্রথমেই যা চোখে পড়বে তা হল ঝকঝকে পরিচ্ছন্নতা। অসম্ভব রকমের ভীড়, কিন্তু সব কাজকর্মই হচ্ছে সুশৃংখলভাবে। হোটেলে পৌঁছে স্নান সেরে বেরোলাম রাস্তায়। টোকিওর সব রাস্তা বাধঁনো। কোথাও মাটি দেখা যায় না। চেনা বলতে একমাত্র ম্যাকডোনাল্ড এর দোকান। সেখানেই রাতের খাওয়া সেরে এলাম।
টোকিওর ফুটপাথ -মাটি দেখা যায়না
১৬ তারিখ সারাদিন কাজের পর সন্ধ্যেবেলা অন্যান্য দেশের বন্ধুদের সাথে কাছাকাছি বাজারগু্লো ঘুরতে গেলাম। টোকিওর সব রাস্তাই এত ঝকঝকে যে হারিয়ে যাওয়ার ভয় আছে।
টোকিও শহর
রাতে হোটেলে ফেরার পর পাকিস্তানের বন্ধু সইদ আমাকে দিয়ে গেল ওর দেশ থেকে আনা প্যাকড চিকেন বিরিয়ানি। বাথরুমের গরম জলের কলে প্যাকেট গরম করে নিয়ে খেতে খেতে মনটা ভাল হয়ে গেল। কেমন যেন এক আত্মীয়তার অনুভব হল।
১৭ তারিখ সকালবেলা শিনাগাওয়া রেল স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করলাম ফুকুই নামের এক ছোট শহরের দিকে। চাপার সুযোগ হল সেই বহু শোনা বুলেট ট্রেনে। ভেবেছিলাম এমন জোরে যায় যে ট্রেনে বসেও তা বুঝতে পারব। কিন্তু ও হরি!!- ট্রেনগুলো এমন সুন্দর আর আধুনিক যে কোন ঝাঁকুনিই নেই। মনে হয় শিয়ালদহের লোকাল ট্রেনে যাচ্ছি। এই ট্রেনটার নাম হিকারি সুপার এক্সপ্রেস। এটা মাত্র পাঁচ ঘন্টায় ১০০০ মাইল যায়।সবচেয়ে বেশি স্পিড হচ্ছে ঘন্টায় ২৮৫ কিমি।
বুলেট ট্রেন
১৮ তারিখ সারাদিন কেটে গেল কাজেকর্মে। বিকেল বেলা ফেরার ট্রেন ধরলাম। আগের বারের মতই একদম ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ট্রেন ছাড়ল। এই ট্রেনেও আগের বারের মত মাত্র একজন সুসজ্জিত হকার তরুনী। কোল্ড কফি, জুস, কেক, এইসব পন্য তার। ট্রেনের কাঁচ তুলে হাওয়া খাওয়ার কোন গল্প নেই, চা গরম বলে কোন হকার নেই, নেই ঝালমুড়ি বা বাদামওয়ালা।
ট্রেনের ভেতর- চা, ঝালমুড়ি, বাদামভাজা...কিছুই নেই!
কাজকর্ম শেষ হয়ে গেল। ২১ তারিখ ফিরে এলাম কলকাতায়। ঠিক নয়দিন বাদে গেলাম টাকি, নিছক বেড়ানোর জন্য। এবার সঙ্গে আমার স্ত্রী। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে এসে হাসনাবাদ লোকাল ধরে দুই ঘন্টা পরে টাকি। টাকি হাসনাবাদের ঠিক আগের স্টেশন। মাঝে যে সব স্টেশনগুলো পড়ল, তাদের নামগুলো অদ্ভূত - ভ্যাবলা হল্ট, লেবুতলা হল্ট, কড়েয়া কদম্বগাছি, ভাসিলা, মালতিপুর - নামগুলোর মধ্যেই কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা!! ট্রেনে যেতে যেতে নানারকম টুকটাক খাওয়ার মধ্যে একটা বিশেষ খাবার হল 'মাখা সন্দেশ'।
টাকির পাশে ইছামতী নদী। ইছামতীর পাশের রাস্তাটি সরু, কিন্তু পিচের রাস্তা, এবং পরিষ্কার ও বটে! এই রাস্তাটির কোন নাম আছে কিনা কেউ বলতে পারল না।
টাকিতে নদীর ধার বরাবর রাস্তা
নদীর ধার বরাবর বেশ কটি খাবারের দোকান আছে। বাঁশের বেঞ্চে বসে নদীর দিকে মুখ করে বসলে মনে হবে সারা পৃথিবীটা আমার। হটাত করে মনে পড়ে গেল টোকিওর কথা। এই মুক্ত চেহারাটা ওখানে ছিল না।
ইছামতী নদী
দুপুরবেলা ভ্যান রিকশা চেপে বেড়াতে গেলাম। প্রথমেই গেলাম বাংলাদেশ সীমান্তের সব থেকে কাছে যে জায়গাটা, সেই গোলপাতার জঙ্গলে। আরো দেখলাম রামকৃষ্ণ মিশন আর স্থানীয় বাজারহাট।
পরদিন দুপুরে বেড়তে গেলাম হাসনাবাদ। উল্টোদিকে পার-হাসনাবাদ যাবার জন্য দুই-তিন মিনিট অন্তর লঞ্চ ছাড়ছে। ভাড়া মাত্র পঞ্চাশ পয়সা!! একটু ভালোভাবে যেতে গেলে এক টাকা বেশি দিতে হবে। বিজয়া দশমীর দিন টাকির যে বিখ্যাত ভাসান হয় তার মূল অনুষ্ঠান হয় এখানেই।
কিন্তু বেশি কাছে যাওয়া বারন। তাই নদীর মাঝ বরাবরই থাকতে হল। দেখতে গেলাম মাছরাঙা দ্বীপ। এই দ্বীপে বিভিন্ন বিরল প্রজাতির ভেড়া চাষ করা হয়।
দূরে ওই দেখা যায় বাংলাদেশ
দুপুরবেলা আমাদের ফেরার পালা। ভ্যান চেপে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ভাবলাম এই যে এভাবে ভ্যান এ চেপে যাওয়া, খোলা মাঠ, নদীর সঙ্গ, এরকম কি টোকিওতে পাওয়া যায়!! হয়ত জাপানেও এরকম জায়গা আছে, কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গিয়ে সেই জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়না। এমনও হতে পারে, এইরকম আড়ম্বরহীন ভাবে হয়ত খুব উন্নত দেশগুলোতে ঘোরা যায়না। আহা, এমনটা যদি হত যে আমার শহরটার পরিকাঠামো আর ব্যবস্থা টোকিওর মত ঝকঝকে সুন্দর হত, আবার টাকির মত প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়া যেত, তবে কেমন হত ?
বালি, হাওড়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অঞ্জন দাস মজুমদার
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে