ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক
সামনের জমি থেকে প্রচুর ধোঁয়া উঠছে। কোনো কোনো গর্ত থেকে হিস্হিস্ গরম জল বেরিয়ে আসছে। জল এত গরম যে কাছাকাছি গেলে গরম হল্কা টের পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে তাকালে জল ফোয়ারা হয়ে বেরিয়ে আসছে। কোনো ফোয়ারাটা এতো জোরে মাটি থেকে বেরোচ্ছে যে ফোয়ারার জল কুড়ি থেক তিরিশ তলা উঁচু বাড়ি ছাড়িয়ে চলে যাবে। জায়গাটার নাম ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক। আমেরিকার ওয়াইওমিং রাজ্যের পশ্চিম কোণে। আমরা গাড়ি থামিয়ে, সামনের মাঠটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সন্ধ্যে নেমে আসছে। গাড়ি নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে থাকলাম আমদের হোটেলের দিকে যেখানে আমরা রাত কাটাবো। যাবার পথে একদিকে দেখি মাঠের মধ্যে মোটা মোটা বাইসন ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইসনগুলো ঘুরে ঘুরে ঘাস খাচ্ছে আবার মাঝে মাঝে মাটিতে জোরে জোরে খুর ঠুকছে। আর তখন চারপাশ ধুলোয় ভরে যাচ্ছে। বাইসনকে দেখতে শান্ত, নিরিহ মতো। কিন্তু মুখটা গম্ভীর যেন বলে দিচ্ছে-আমাকে ঘাঁটিও না। অবশ্য তার সিং ও চেহারা দেখলে ঘাঁটানোর সাহস হবে না। বাইসন নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে পরে বলছি। এই বাইসনটা রাস্তার ধার ধরে হাঁটছিলো।
রোদ পড়ে এসেছে,সময়টা অগষ্ট মাস। এই সময়ে রোদ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাত চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তাই আবার আমরা রওনা দিলাম। সামনে একটা উঁচু পাহাড়। সেটা পেরোলেই আমাদের হোটেল। গাড়িটা পাহাড়ের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম সামনে উঁচু পাহাড়টার ওপরে কিছু নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। বাইনাকুলারটা চোখে লাগিয়ে দেখতে পেলাম-হরিণ,প্রচুর হরিণ। এতো হরিণ আগে কখোনো দেখিনি। বাচ্চা হরিণ, শিংওলা হরিণ, শিং বিহীন হরিণ সবাই মিলে দঙ্গল বেঁধে পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছে। আর একটু কাছে যাবার পর খালি চোখে দেখা গেলো। ছবি তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু অন্ধকার হয়ে গেছে বলে আর ছবি তোলা গেল না। আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের হোটেলের দিকে।
অন্ধকার নেমে আসলো। এতো অন্ধকার যে এক হাত দূরের জিনিষ দেখা যায় না। শুধু চারিদিকে মাটি থেকে হিসহিস করে গরম জল ওঠার শব্দ শোনা যায়। কান পাতলে মনে হবে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। সেই অন্ধকারে গা ছমছম করে ওঠে। হোটেলের বাইরে আলো ছাড়া ঘুরতে যাওয়া নিরাপদ নয়। আমরা রাতের খাবার খেয়ে গল্প করতে করতে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম...আমি যেন এক স্বপ্নের দেশে চলে গেছি। রূপকথার রাজপুত্রের মতো আমাকেও তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে হবে। সামনে ধোঁয়া ভরা মাঠ। বাইসনগুলো চোখে চোখে রাখছে। আমাকে বাইসনের মধ্যে দিয়ে ফুটন্ত গরম ফোয়ারার মধ্যে দিয়ে মাঠ পেরোতে হবে। আমি হাঁটবো না দৌড়াবো ঠিক করতে পারছি না। হঠাত বাইসনগুলো হেসে বললো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এ কোন জায়গায় এলাম যেখানে বাইসন কথা বলে!
পরের দিন সকালে উঠে প্রথমেই যেটা চোখে পড়লো সেতা এই নীচের ছবিটার মতো। নাম জানলাম ফিউমারোল [fumarole]। জায়গাটা দেখে মনে হলো এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা।
এখানে মাটি এতো গরম যে জল বাষ্প হয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বাষ্প আর অন্যান্য গ্যাস বেরিয়ে আসছে ওপরের ছবিটাতে। চারিদিকে একটা তীব্র রাসায়নিক রাসায়নিক গন্ধ। কাছাকাছি আরো অনেক জিনিষ দেখলাম ও জানলাম যা আগে কখোনো দেখিনি। নাম জানলাম গীজার ( geyser)- উষ্ণ প্রস্রবণ এবং মাডপট। নীচের ছবিটা ওল্ড ফেইথফুল গীজারের। ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক সবচেয়ে জনপ্রিয় দেখার স্থান।
জলটা ১৮০ থেকে ১৯০ ফুট উঠে যায়। প্রত্যেক ৯০ মিনিট অন্তর এই গীজার টা থেকে গরম জল ফোয়ারা হয়ে বেরিয়ে আসছে। ৯০ মিনিট অন্তর ফোয়ারার জল আসে বলে একে পুরোনো বিশ্বস্ত (old faithful) বলে। একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে মেলানো যাবে।
জায়গাটা রূপকথার দেশ। প্রত্যেক পদে পদে নতুন জিনিষ দেখার,নতুন জিনিষ জানার। ইয়েলোস্টোন পার্কে পৃথিবীর সবচেয়ে জিওথার্মাল বিষয়ক জিনিষ দেখার আছে। আমি ভারতে বেশি জায়গা ঘোরার সুযোগ পাইনি। তোমাদের জানা যদি কোনো জায়গায় তোমরা এই ধরনের জিনিষ দেখে থাকো তাহলে আমাকে জানিও। পরেরবার ভারত গেলে আমি সেখানে বেড়াতে যাবো।
জায়গাটাতে বন্য জন্তু আছে অনেক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভাল্লুক। আমরা ভাল্লুক দেখতে পেয়েছি। এটা চিড়িয়াখানার ভাল্লুক নয়। তাই কখোনো ভাল্লুক দেখা যায়,আবার কখোনো দেখা যায় না। গ্রিজলি ভাল্লুক আর কালো ভাল্লুক দুটোই আছে এখানে। আমাদের
ভাগ্য খুব ভালো ছিলো, দুধরনের ভাল্লুক দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু তারা এতোটাই দূরে আছে আর আমার কাছে দূরের ছবি তোলার
লেন্স ছিলো না। নীচের দুটো ছবি ইয়োলোস্টোন ন্যাশানাল পার্কের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। ছবি গুলি সবার ব্যবহারের জন্য অনুমতি
প্রাপ্ত।
নীচের ছবিটা কালো ভাল্লুকের। গায়ের রঙ কালো। আর পিঠে কোনো কুঁজ নেই।
এটা গ্রিজলি ভাল্লুকের ছবি। এর পিঠে বড় কুঁজ আছে। এই কুঁজ দেখে বোঝা যায় কোনটা গ্রিজলি আর কোনটা ব্ল্যাক বা কালো ভাল্লুক। দুজনেই কিন্তু সমান ভাবে ভয়ঙ্কর।
এবারে বাইসনের মজার গল্পটা বলে আমার লেখা শেষ করি। সকালবেলা বেরিয়ে ভাল্লুক, হরিণ, এল্ক এইসব বন্য জন্তু দেখে আমদের মনটা বেশ খুশি খুশি। আমি ড্রাইভ করছিলাম আর আমার পাশে আমার বউ পিউ বসেছিলো হাতে ক্যামেরা নিয়ে। একটা জায়গায় এসে রাস্তা দু দিকে ভাগ হয়ে গেছে। আমি বাঁ দিকের রাস্তাটা নিলাম। গাড়ি ঘোরাতে সামনে অবাক হবার পালা। রাস্তা জুড়ে বাইসনের দল। আমাদের যাবার জায়গা নেই। তাই আমরা গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাইসনের দলটা আমাদের থেকে ২০-৩০ ফুট দূরে। আমাদের আগে বা পেছনে কোনো গাড়ি নেই।
এইভাবে পাঁচ মিনিট কাটলো। বাইসনের দল নড়ার কোনো ইচ্ছা দেখাচ্ছে না। আমরা ভাবছি হর্ণ বাজাবো কিনা। আবার হর্ণ বাজালে আমাদের গাড়ির দিকে যদি ছুটে আসে ! কি করবো ঠিক রতে পারছি না।
এমন সময় একটা বাইসন দলছুট হয়ে আমাদের গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। আমাদের গাড়ির দিকে বাইসনের হাঁটার গতি যত বেড়ে যাচ্ছে ততই আমাদের বুকের ভেতর জোরে জোরে ড্রাম বাজতে শুরু করেছে। গাড়ি ঘোরানোর জায়গা নেই। আমি ফিসফিস করে পিউকে বললাম, ছবি তোলো...ছবি তোলো। তিন-চারবার বলার পর পিউয়ের ছবি তোলার কোনো আওয়াজ পাচ্ছি না বলে পিউয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি পিউ ক্যামেরা অন করার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত কাঁপার জন্য ক্যামেরা অন আর হচ্ছে না। আমিও ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। আমার গা,হাত,পা সব অবশ। বাইসনটা
পাঁচ-ছয় ফুট দূরে চলে এসেছে। এরমধ্যে সে তার হাঁটার দিক পরিবর্তন করেনি, সোজা আমাদের গাড়ির দিকেই আসছে। আরো কাছে চলে এসেছে। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। যে কোনো মুহূর্তে সংঘর্ষ হবে। কোনো আওয়াজ না পেয়ে সাহস করে চোখ খুলে দেখি বাইসনটা মাত্র দু ফুট দূরে। হঠাত বাইসন হাঁটার দিক পরিবর্তন করলো। বাঁদিকে ঘুরে গিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
বাইসন আমাদের ফেলে চলে গেলে আমরা আবার নিশ্বাস নিতে নিতে পারলাম। পরে জানতে পেরেছিলাম বাইসনের দৃষ্টি শক্তি তেমন প্রখর হয় না। তাই দূরের কিছু দেখতে পায় না। বাইসনটা আমাদের তাড়া করেনি, হয়তো আমাদের দেখতেও পায়নি। কাছে এসে গাড়িটা দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমরা ভয়ে নড়তে পারছিলাম না। এখন হাসি পায়, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমরা ভয়ে মরে যাচ্ছিলাম।
জায়গাটাতে বন্য জন্তু ছাড়াও আরো অনেক কিছু দেখার আছে। ভূপ্রাকৃতিক জিনিষ যেমন জলপ্রপাত, ক্যানিয়ন আছে। ইয়োলোস্টোনে গোটা পৃথিবীর অর্দ্ধেক জিওথার্মাল দ্রষ্টব্য জিনিষ আছে। পার্কে আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের বাস করার নিদর্শন আছে। সেটা নিয়ে অন্য একদিন গল্প করা যাবে। বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে পার্কের ওয়েব সাইটে( http://www.nps.gov/yell/index.htm)
আগামী সংখ্যাতে আমি এমন একটা জায়গা নিয়ে লিখবো যেখানে অনেক ধরনের টিয়া পাখি আছে। সে এক মজার জায়গা। এই লেখাটা পড়ে তোমাদের প্রশ্ন থাকলে জানিও। আর অবশ্যই জানিও কেমন লাগলো। ভালো থেকো সবাই।
লেখা ও ছবি-
দেবাশিস পাল
ওকলাহোমা সিটি
- বিস্তারিত
- লিখেছেন দেবাশীষ পাল
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে
হারবিন
চিনের উত্তর-পুর্বে রাশিয়ার গায়ে গা লাগিয়ে রাজহাঁসের মতো আকারের একটা প্রভিন্স যার নাম হেইলংজিয়ান(heilongjian)। হারবিন সেই রাজহাঁসের গলায় যেন একটা উজ্জ্বল মুক্ত - মধ্যমনি শহর। সংহুয়া নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই শহরটিকে বলা হয় ‘আইস সিটি’ বা ‘বরফের শহর’। ‘হারবিন’ কথাটার আঞ্চলিক মানে ‘মাছ ধরার জাল শুকানোর জায়গা’।
বছরের অর্ধেক সময় এই শহরের তাপমাত্রা থাকে শূন্যের নীচে। শীতকালে এই শহর ঢেকে থাকে তুষারে। সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পৌঁছয় -৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। পাশের সংহুয়া নদীর জল জমে বরফ হয়ে যায়। সেই বরফ আর তুষার কাজে লাগিয়ে তৈরী হয় নিপুন ভাস্কর্য। সারা পৃথিবীর নানা দেশ থেকে নামী দামী দক্ষ শিল্পী ও ভাস্কররা ভাস্কর্য তৈরী করতে উপস্থিত হন এখানে । নদীর বুক জুড়ে মুক্তাঙ্গন মেলা বসে। নানা জায়গায় শুরু হয় বরফ আর তুষারের চোখধাঁধানো ভাস্কর্য প্রদর্শনী - ‘আইস এন্ড স্নো ফেস্টিভ্যাল’।
উপরের সব কটি ছবিতে মূর্তি এবং বাড়িটি বরফ দিয়ে তৈরি
বরফ আর তুষার দিয়ে তৈরী করা হয় অসংখ্য সুন্দর সুন্দর বাড়ি, মূর্তি, পৃথিবীর নানা বিখ্যাত স্থাপত্যের প্রতিলিপি । এমনকি পায়ে চলা রাস্তা আর প্রাচীরও তৈরী করা হয় বরফ দিয়ে। বরফের ভেতরে নানা রঙের উজ্জ্বল চকচকে আলো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো থাকে। অন্ধকার রাত্রে সেই দৃশ্য দেখার মতো।
রাতের আঁধারে আলোয় সাজানো বরফের তৈরি স্থাপত্য
এই প্রদর্শনী দেখতে দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভীড় হয়। প্রদর্শনী ছাড়াও নানা আইস স্পোর্টস শুরু হয় এই সময়। হয় নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কিছু মানুষ নদীর ওপর বরফ কেটে সেই বরফ গলা জলে স্নান করে। কুকুরে টানা স্লেজ ও ঘোড়ায় টানা নানান গাড়ি চেপে ঘোরা যায় নদীর বরফে।
বরফে ঢাকা নদী
হারবিনের আর এক অন্যতম আকর্ষন সাইবেরিয়ান ব্যাঘ্র পার্ক। সাইবেরিয়ান বাঘ এখন বিলুপ্তপ্রায়। তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখার এমন প্রচেষ্ঠা। প্রায় ৩৫৬ একর জায়গা জুড়ে তৈরী এই পার্কে পাঁচশ-র বেশি বাঘ আছে।
সাইবেরিয়ান বাঘ
বাঘ ছাড়াও দেখা মেলে কিছু সিংহ, লেপার্ড, পুমা এমন কি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। ইকোট্যুরিজিমের সৌজন্যে দর্শনার্থীদের গাড়িতে করে ঘোরান হয় পার্কে – বাঘেদের কে খুব কাছ থেকে দেখতে পাওয়ার বিরল সৌভাগ্য মেলে। দর্শনার্থীদের জন্যে আলাদা করে কিছু ভিউইং গ্যালারী করা আছে। সেখান থেকে যে কেউ বাঘদের মাংস খেতে দিতে পারে নিজে হাতে। বাঘদের শিকার করা দেখার ইচ্ছে করলে জ্যান্ত মুর্গী কিনে ছুঁড়ে দিতে পারে বাঘেদের মাঝে।
১৯০৭ সালে রাশিয়ানদের তৈরী কাঠের ১৭৫ ফুট লম্বা সেন্ট সোফিয়া চার্চটাও অসাধারন সুন্দর।
সেন্ট সোফিয়া চার্চ
‘সেন্ট সোফিয়া’ কথাটার মানে ভগবানের wisdom । চার্চটা দেখলে মনে হবে সত্যিই ভগবানের হাতের তৈরী।
লেখা ও ছবি -
রুচিরা
বেইজিং
- বিস্তারিত
- লিখেছেন রুচিরা
- ক্যাটfগরি: দেশে-বিদেশে