অকাল বোধন
ভারি মুশকিলে পড়েছেন রাম। কি যে করবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছেন না। দারুণ বিক্রমে যুদ্ধ করছে রাবণ। শেষে নিরুপায় হয়ে রাম ভীষণ এক চক্র ছুঁড়ে মারলেন। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে রাবণের দশটা মুন্ডু কেটে গেলো। কিন্তু ও মা! মুন্ডুগুলো কাটতে না-কাটতেই আবার জুড়ে গেলো। এবার খুব শক্তিশালী অর্ধচন্দ্র বাণ ছুঁড়লেন। সেই একি ঘটনা। অনেক চিন্তা করে রামচন্দ্র ডেকে পাঠালেন বিভীষণ কে। বিভীষণের সঙ্গে পরামর্শ হলো। রাম বুঝতে পারলেন দেবী দুর্গাকে সন্তুষ্ট করতে না পারলে রাবণকে বধ করা যাবে না। তখন শরৎকাল। দুর্গাপুজো হয় বসন্তকালে। কিন্তু বসন্তকাল অবধি তো আর অপেক্ষা করা যায়না। শরৎকাল দেবদেবীদের নিদ্রাকাল। এ সময়ে তাঁরা ঘুমিয়ে কাটান। শেষ পর্যন্ত রামের অকাল বোধনে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দেখা দিলেন। রামায়ণের এই গল্পটা বোধ হয় তোমার জানা। কিন্তু একথাটা কি জানো যে এটা সত্যি সত্যি একটা গল্প। সংস্কৃত ভাষায় আসল যে রামায়ণ বাল্মিকী লিখেছিলেন, সেখানে এরকম কোন ঘটনার বর্নণা নেই। রাবণ বধের জন্য রামের দেবী পুজোর কথাও সেখানে নেই। শরৎকালে দেবীর অকাল বোধনের এই গল্পটা জানা যায় মূলতঃ কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে। পনেরোশো শতাব্দীতে বাঙালী কবি কৃত্তিবাস ওঝাই প্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণের অনুবাদ করেছিলেন। তবে কৃত্তিবাস কিন্তু নিজে এ গল্প বানাননি। তাঁর রামায়ণের অনুবাদের প্রায় তিনশো বা চারশো বছর আগে থেকেই রাবণ কে বধ করবার জন্য রামের দুর্গাপুজোর কথা, অকালবোধনের কথা প্রচলিত ছিলো। কালিকা-পুরাণ, দেবী-ভাগবত, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ প্রভৃতি উপপুরাণে শরৎকালে দুর্গাপুজোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই উপপুরাণগুলোতে আবার অকাল বোধন করেছিলেন রাম নয়, স্বয়ং ব্রহ্মা। কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে ব্রহ্মা রাত্রিবেলা দেবীর বোধন করেন, তাই এ বোধন অকাল বোধন। আসলে দেবতাদের দিন-রাত্রির হিসেবটা তো ঠিক আমাদের মতো নয়। একুশে জুন থেকে বাইশে ডিসেম্বর অর্থাৎ এই ছ'মাস সূর্যের যখন দক্ষিণায়ন হয়, সেই পুরো সময়টাই দেবতাদের কাছে এক রাত্রি। আর উত্তরায়ণের ছ'মাস হলো দেবতাদের একদিন বুঝতে পারছো তো কেনো একে অকাল বোধন বলা হয়?
কিন্তু সে যাই হোক, পন্ডিতেরা আবার মনে করেন যে এসব উপপুরাণগুলো সব পূর্বভারতেই লেখা হয়েছিলো। অর্থাৎ শরৎকালে দুর্গাপুজোর কথা পূর্বভারতেই প্রচলিত ছিলো। আসল রামায়ণে দুর্গাপুজোর কথা না থাকলেও পরবর্তীকালে এইসব গল্প-কাহিনী যুক্ত হয়েছে। আসলে রামায়ণকে তো শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বিদেশেও বহু ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। তার ফলেই এক এক দেশে এক এক রকম রামায়ণের গল্প শোনা যায়। সংস্কৃত ভাষাতেই একটা রামায়ণ আছে, তার নাম "অদ্ভূত রামায়ণ"। তাতে কি বলা হয়েছে জানো? রাম নয়, রাবণকে নাকি মেরেছিলেন সীতা।
আমাদের বাংলাতে শরৎকালে যখন দুর্গাপুজো হয়, তখন সারা উত্তর ভারতে পালিত হয় নবরাত্রি আর দশেরা উৎসব। আরও মনে করে যে রাম রাবণকে আশ্বিন মাসের সশুক্লপক্ষের নবমীর দিন বধ করেছিলেন আর লঙ্কা জয় করে রাম দশমীর দিন অযোধ্যা যাত্রা করেন। কিন্তু তোমাকে তো আগেই বলেছি বাল্মিকীর রামায়ণে কোথাও শরৎকালের কথা নেই। আসলে শরৎকালটাও ঠিক যুদ্ধের সময় নয়।প্রাচীনকালে দেব-দানবের যে সব যুদ্ধ হয়েছিলো সেগুলিও শরৎকালে হয়নি। সে যুগে যুদ্ধের সময় ছিলো হেমন্ত ও বসন্তকাল। তখন তো আর বন্দুক কামান ছিলো না। তখন যুদ্ধের প্রধান অস্ত্রই ছিল তীর ধনুক। আর তীর ধনুকের যুদ্ধ অনেকটাই প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। মনে করো, যদি বেশি জোর হাওয়া দেয় বা খুব বৃষ্টি হয় তাহলে তো তীর কে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। লক্ষবস্তুতে আঘাত করাও সহজ হবেনা। আর আশ্বিন মাসে শ্রীলঙ্কায় ও দক্ষিণ ভারতে প্রকৃতি কিন্তু খুব শান্ত থাকে না । ঝড়বৃষ্টির উৎপাত মাঝে মধ্যেই দেখা দেয়। আচ্ছা ধরা যাক সেই সময় অর্থাৎ রাম-রাবণের যুদ্ধের সময়ে প্রকৃতি শান্তই ছিলো। কিন্তু তা হলেও আশ্বিন মাসে যুদ্ধ করতে হলে রামকে সাগর পেরোতে হয়েছিলো কোন সময়ে? শ্রাবণ বা ভাদ্র মাসে। আর ওই মাসগুলোতে সমুদ্র থাকে উত্তাল।আর ওই উত্তাল সমুদ্রে সেই সময়ে সেতুবন্ধন করা প্রায় অসম্ভব। নল যতই দক্ষ স্থপতি হোন, আর সুগ্রীবের বানরসেনা যতই কর্মঠ হোক না কেনো, ঐ সময়ে সেতু বাঁধার ব্যাপারটা আমরা কি মানতে পারি?
আসল রামায়ণে যদিও কোথাও দুর্গাপুজোর কথা নেই। তবে মহাভারতে দুর্গাস্তবের খোঁজ পাওয়া যায়। বিরাটপর্বে আর ভীষ্মপর্বে। আরো এক আশ্চর্য কথা আছে মহাভারতের বনপর্বের ২২৯ অধ্যায়ে। সেখানে বলা হয়েছে দুর্গা নয়, মহিষাসুরকে বধ করেছেন কার্তিক।
সে যাই হোক প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দুর্গার পায়ের তলায় মহিষাসুরকেই আমরা দেখে থাকি। তাকে দুর্গা বধ করেছেন, তাই তিনি মহিষাসুরমর্দিনী। আর এই মোষের কথাতেই বলে রাখি আরো একজন দেবীর কথা। তিনিও দুর্গার মতোই যুদ্ধের দেবী। তার নাম ব্যাইরগো (Virgo) । ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের অধিবাসীরা মন্খমের জাতিকে জয় করেছিলেন। আর এই মন্খমের মানুষদের কাছে মোষ ছিলো খুব পবিত্র আর মূল্যবান পশু। তাই ব্যাইরগো দেবীও মোষ মেরেছিলেন বলে তিনিও মহিষমর্দিনী।
ফিরে আসি আবার সেই পুরোনো কথায়। আমরা কেনো শরৎকালে দুর্গাপুজো করি? আসলে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে - বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লী প্রভৃতি চিরকালই কৃষির জন্য বিখ্যাত। কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে ধান-ই হলো প্রধান ফসল। আমাদের বাংলাতেই এক কি দেড় হাজার বছর আগে এক ফসলের দেবী ছিলেন। তিনি কিন্তু বাঙালীর আসল দুর্গাদেবী। সে যুগে আউশ, আমন, বোরো এরকম বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রকম ধানের চাষ হতো না, শুধুমাত্র 'সাটি' বা 'সটি' ধানের চাষ হতো। বর্ষার শুরুতে এই ধান লাগানো হতো। বর্ষার জলে ষাট দিনের মধ্যেই এই ধান পেকে যেতো। শরৎকাল ছিলো ঐ ধানকাটার সময়, এখন আমরা এই ধানগুলোকেই 'কলমা' বা 'শালি' ধান বলি। জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কবিতায় তুমি 'রূপশালি' ধানের নাম পাবে, আর এই ধান কাটার পর যখন বাঙালীর গোলা ভরে যেতো তখনই বাঙালীরা উৎসবে মেতে উঠতো। এই ধান্যমাতা দেবীর পুজোই শারদীয়া পুজো। আর এই দেবীর-ই নাম শারদা।
গুজরাটেও শরৎকালে নতুন সূর্যের বন্দনা করা হয়। এই সময় সেখানকার মেয়েরা গর্বা নাচে মেতে ওঠে। বর্ষার শেষে শরৎকালকে নিয়ে উৎসবের এই রীতি বহু পুরোনো। আজ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর ধরে মানুষ শরৎকালে শারদোৎসবের সঙ্গে দুর্গাপুজোকে মিলিয়ে দিয়ে যেমন দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছে তেমনটি কেউ করেনি।
শুভ্রজিত চক্রবর্তী
বালী, হাওড়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন শুভ্রজিৎ চক্রবর্তী
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত
পুজোর চিঠি
সারা রাতের ট্রেনের ধকল ছিলো। ঘুমও হয়নি ভালো করে। ঝম ঝমে বৃষ্টির মধ্যে যখন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ছিলাম তখন ভাবতেও পারিনি রাত দশটা পাঁচের দার্জিলিং মেলটা ধরতে পারবো। শিয়ালদহ থেকে তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠে দেখি গোটা কামরা জলে থৈ থৈ। জল পরিষ্কার করে, আমার জিনিসপত্র রেখে, সব দিক দেখে শুনে, ধীরে-সুস্থে বসতে বসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। তখোনো তোমার চিঠিটা আমার ব্যাগে সিরাজুল। খোলা হয়নি নীল খামটাও।
রফিকুল ক্যানিং লোকাল থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে এসেছিলো। ভেবেছিলো আমার ট্রেন হয়তো ছেড়ে গেছে। হাঁপাচ্ছিলো রফিকুল। ও এবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। শুনলাম তোমাদের গ্রামে আবার নদীর জল ঢুকছে হু হু করে। তোমার ছোট্ট বোনকে নিয়ে মা চলে গেছেন মামার বাড়ি,পবিত্র রমজানে আনন্দের ছিটেফোঁটাটুকু নেই। রফিকুলের দেওয়া টুকরো টুকরো খবরে আমার মন যখন একটু একটু করে কষ্ট পাচ্ছে তখন দেখি ট্রেনের কামরার সহযাত্রীরা একটুখানি জল দেখেই কি হই-চই বাধিয়ে ফেলেছে। আর আমার মনে পড়ছে তোমার গ্রামকে। সুন্দরবনের সেই ছোট্ট গ্রাম পাখিরালার কথা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম সিরাজুল।
সকাল ঠিক আটটার সময় দার্জিলিংমেল আমাদের নামিয়ে দিলো নিউ জলাপাইগুড়ি স্টেশনে। সারা রাতের ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও হলো যখন দেখতে পেলাম ঝকঝকে শরতের রোদে ভেসে যাচ্ছে স্টেশন চত্ত্বর। বেশ কিছু বিদেশী ট্যুরিস্ট নিজেদের মধ্যে হৈ-হৈ করছে। আর ছোট ছোট জিপ থেকে চালকরা জোরে জোরে হাঁক দিচ্ছে "কালিম্পং, দার্জিলিং,ফুন্টসিলিং..."। তোমার বয়সী একদল স্কুলের ছেলে মেয়ে কালিম্পঙের বাসটায় উঠলো। আর ঠিক তখনি আমার গাড়ির চালক জয়কে দেখতে পেলাম। হাসি-খুশি জয় সবসময় আমার সফর-সঙ্গী।
আমরা যাবো শিলিগুড়ির খুব কাছেই সরস্বতীপুরে। সেখানে কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের পাশেই থাকে মালতী নার্জিনারী। ঠিক ধরেছো সিরাজুল, মালতী তোমার মতো ক্লাস সেভেনে পড়ে। যাওয়ার পথে হঠাত গাড়ি থামালো জয়। তাকিয়ে দেখি তিস্তার চর সেজে উঠেছে কাশফুলে। মনে পড়ে গেলো পুজো্র আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি।
তিস্তার চরে কাশফুল
কাঁঠালগুড়িতে গিয়ে মালতীর দেখা পেলাম না। শুনলাম মামার বাড়ি গেছে। অতদূর থেকে এসেছি বুঝতে পেরে শুক্লা ওরাঁও বললেন,"একটু বসুন, আমি আপনাদের গ্রামটা ঘুরে দেখাই।" তিস্তার পাশে জঙ্গল আর চা বাগানে ঘেরা মেচ আর ওরাঁও জনজাতির গ্রাম। শুক্লার সাথে গ্রাম ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সবাই চা-পাতা তোলার কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ জঙ্গল থেকে বয়ে নিয়ে আসছেন শুকনো কাঠ।
চা বাগান
খুব তাড়াতাড়ি আমরা আবার চলা শুরু করলাম। যেতে হবে অনেকটা পথ। রাজাভাতখাওয়া ছাড়িয়ে আরও ঘন্টা দুয়েকের পথ। সন্ধ্যা নামছে। বড় রাস্তা থেকে জঙ্গলে ওঠার মুখে জয় আবার গাড়ি থামালো। আমরা সবাই চুপ। আকাশে নানা রকমের রঙ ছড়িয়ে সূর্যিমামা পাটে নামছেন। এরপরে জঙ্গল, পথে পড়বে রায়ডাক নদী।
সিরাজুল, তোমার গ্রামে যখন রাতে ছিলাম তখন মনে আছে বাজারের সেই অন্ধকার পথটা? তুমি আমাকে চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলে। অনেক রাতে ঘুম থেকে তুলে আমাকে শুনিয়েছিলে হাড় হিম করা বাঘের ডাক। মাগো, সেদিন কি ভয় পেয়েছিলাম! মনে আছে সিরাজুল? আর সেই লস্কর মন্ডল, টাইগার রিজার্ভের বনরক্ষী। যিনি আমাদের সেই রাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন নৌকাতে। আর সারা রাত আমরা ছোট ছোট খাঁড়ি ঘুরে বেড়ালাম বাঘের খোঁজে। লস্করকাকু আলো নিয়ে খুঁজতে থাকলেন বাঘের পায়ের ছাপ। আর বলতে থাকলেন সেই দুষ্টু কুমীরটার গল্প। যে শুধু ওত পেতে থাকে কখন কার ছাগলটা, বাছুরটা তার নাগালে আসবে। সত্যি সেই রাতের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না সিরাজুল।
রাতের নৌকা
অনেক রাতে একশো বছরের পুরনো রায়ডাক বন বাংলোয় এসে যখন পৌঁছোলাম তখন চারিদিকে পটকা ফাটার শব্দ...টিন পেটানোর আওয়াজ...। বুড়ো চৌকিদার এসে বললেন পাশের গ্রামে হাতি ঢুকেছে। আজ বোধহয় একটা ধানও থাকবে না। সারা রাত ধরে হাতি তাড়ালো গ্রামের মানুষ। সকালে ঘুম ভাঙলো একটা চেনা মিষ্টি গন্ধে। বারান্দায় এসে দেখলাম, সিঁড়ির কাছে ছোট্ট মাঠে ছড়িয়ে আছে শিউলি ফুল।
শিউলি ফুল
পশ্চিম চ্যাংমারী গ্রামে থাকে ঊষা নার্জিনারী। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা গ্রামে কোনো বিদ্যুত নেই। পাকা শৌচাগার নেই। ঠিকমতো রাস্তা নেই। সবার হাতে কাজ নেই। খুব চেনা লাগছে কি সিরাজুল? এই গ্রামটাও কিন্তু তোমার গ্রামের মতোই। তোমার গ্রামটা যেমন ঘিরে থাকে নদী, তোমার গ্রামে এখন যেমন নোনা জলে সব নষ্ট ঠিক তেমনই এখানে বেশ কয়েকদিন বৃষ্টি নেই। বছরে একবার এখানে ধান হয়। তাও বৃষ্টির জলকে ভরসা করে। এই গ্রামটাকেও ঘিরে থাকে জঙ্গল, পাহাড়। আর ঘিরে থাকে ভয়। কখন হাতি আসে। তবুও ঊষা আর তার বন্ধুরা এখান থেকে বেশ কিছু দূরের স্কুলে গিয়ে পড়াশুনো করে। চেষ্টা করে এই প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার। তোমার চিঠিটা আমার সবটা পড়া হয়ে গেছে সিরাজুল। একবার নয় অনেকবার। ধান ক্ষেতের পাশে বসেই তোমাকে লিখছি। আর কোথা থেকে একটা নীলকন্ঠ পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে যাচ্ছে ছবির মতো গ্রামটার দিকে।
সবুজে ঘেরা গ্রাম
ঊষা এসে খবর দিলো নাচের দল রেডি। কেতকী, আশা, রেবা আজ আর কাউকেই চিনতে পারছি না। সবাই নিজেদের অর্থাত মেচ জনজাতির ট্রাডিশনাল পোষাকে সেজেগুজে এসেছে। শুরু হল 'বাগারুম্বা'(মানে নাচ)।
বাগারুম্বা
নাচ দেখে জঙ্গলের পথ ধরলাম আমরা। বিশ্বেশ্বর শৈব্য বললেন,"হাতিপোতায় আজ হাট বসেছে স্যার, দেখতে যাবেন?" লোভ সামলাতে পারলাম না সিরাজুল। প্রায় একঘন্টা হেঁটে হাতিপোতায় যখন পৌঁছোলাম তখন একটু একটু অন্ধকার হতে শুরু করেছে। রিঙ্কুর সাথে পরিচয় হল। রিঙ্কু হাটে বিক্রি করতে এসেছে কাঁচা সবজী। ক্লাস ফোরে পড়ে। বাড়ি ফিরে তেলের কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসবে। সামনেই পরীক্ষা তার।
রিঙ্কু
যে ছবিগুলো তোমাকে পাঠালাম, যাদের কথা তোমাকে বললাম সবাই তারা পিছিয়ে পড়া গ্রামে থাকে। হ্যাঁ ঠিক তোমার মতনই ওরা কষ্ট করে পড়ছে সিরাজুল। আর আমি কি ভাবছি জানো? একদিন তুমি, রিঙ্কু, ঊষা, মালতী যখন অনেক বড় হবে- বলতে শিখবে নিজের গ্রামের কথা, নদীর কথা, সমস্যার কথা। নিজেরাই এগিয়ে আসবে সামনের সারিতে...সেদিন সত্যি শরত তার অরুণ আলোর অঞ্জলীতে ভরিয়ে দেবে চারিদিক। সেদিন পবিত্র ঈদে সবাই পাবে প্রাণের জোয়ার...বাগুরাম্বায় থাকবে মনের আনন্দ...আর ঠিক তখনই শুরু হবে সত্যিকারের উতসব। যে উতসবে আমরা মেতে উঠবো সবাই।
ভোরের আলো
মন দিয়ে পড়াশুনো কোরো। মা আর বাবাকে আমার প্রণাম জানিও। আশা করছি হেমন্তের কোনো এক সকালে আবার তোমার সাথে দেখা হবে সিরাজুল। তখন আবার আমরা ছোট্ট নৌকা নিয়ে বেড়িয়ে পড়বো খাঁড়িতে, কাঁকড়া ধরতে।
ভালো থেকো।
কল্লোল
- বিস্তারিত
প্রথম পাতাঃশরত সংখ্যা ২০০৯
জানো তো, লৌকিক মতে, মা দুর্গা প্রতি বছর বিভিন্ন বাহনে করে মর্ত্যে আসেন এবং কৈলাশে ফিরে যান। এবার দুর্গা বাপের বাড়ি আসছেন দোলায় চেপে, যার ফল কিনা মড়ক। সত্যি করে মড়ক হোক আর না হোক, আমাদের চারিদিকে কিন্তু অনেক মানুষই খুব কষ্টে আছেন। খবরের কাগজে হয়ত পড়ে থাকবে, বা টেলিভিশনে দেখে থাকবে - সারা দেশের নানা জায়গায় হচ্ছে ভয়ানক বন্যা, ডুবে গেছে ঠিক তোমার মত কত ছোটদের ঘর-বাড়ি। অন্যদিকে কোথাও আবার অনাবৃষ্টি, খরা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের পাকা ধান, জলের তোড়ে ভেসে গেছে কমলি গাই, ভাংছে নদির পাড়, নেই তেষ্টার জল বা মাথার ওপরে ছাত। পুজোর আনন্দের মাঝে মাঝে কিন্তু এইসব মানুষদের ভুলে যেওনা। অষ্টমীর সকালে যখন মা দুর্গার কাছে অঞ্জলি দিয়ে মনে মনে নিজের পরীক্ষার ভালো রেজাল্ট বা নতুন সাইকেল অথবা ভিডিওগেম চাইবে, তখন কিন্তু এইসব অগুন্তি মানুষের জন্যেও চেয়ে নিও মুখের হাসি, পেট ভরা খাবার, মাথা গোঁজার আশ্রয়। তবেই না তোমার পুজো হয়ে উঠবে সত্যিকারের আনন্দ উতসব।
তাই বলি, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, ধূপ-ধুনো আর ফুলের গন্ধ, প্রসাদ আর ভোগের স্বাদ, ঢাকের বাদ্যি আর সমবেত মন্ত্রের শব্দ, নতুন জামা আর বেলুনের রঙ, সব মিলে মিশে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক এক নতুন আলো, কেটে যাক সব অন্ধকার।
দুগগা ঠাকুর ভালো
তাঁর রূপে ভুবন আলো
এসো, সেই আলোয় পথ দেখে, মায়ের হাত ধরে, আরেকবার নতুন করে সবাইকে ভালোবাসতে শিখি আমরা...
চাঁদের বুড়ি
- বিস্তারিত
- ক্যাটfগরি: নিয়মিত